লতিফ সিদ্দিকী ‘বাদ’

হজ নিয়ে মন্তব্যের জন্য সমালোচনার মধ্যে থাকা আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীকে মন্ত্রিসভা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম হানিফ।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Oct 2014, 12:20 PM
Updated : 14 Oct 2014, 12:17 PM

বুধবার ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে হানিফ বলেন, “বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এ ধরনের বক্তব্যকে কখনো সমর্থন করে না। এই বক্তব্যের কারণে প্রধানমন্ত্রী তাকে মন্ত্রিসভা থেকে তাৎক্ষণিক অব্যাহতি দিয়েছেন।”

যুক্তরাষ্ট্রে রোববার এক অনুষ্ঠানে ঝড়তোলা মন্তব্যের পর মেক্সিকোতে যান টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী, তার সঙ্গে প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকও যান।

বুধবার বাংলাদেশ সময় ভোরে মেক্সিকোর গুয়াদালাহারা শহরে তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক বিশ্ব সম্মেলনে প্রতিমন্ত্রী পলক সরকারের পক্ষ থেকে ‘গ্লোবাল আইসিটি এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড’ পুরস্কার নেন বলে মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

হানিফ বলেন, “সেই পুরস্কার আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর গ্রহণ করার কথা ছিল। তবে তাকে মন্ত্রিসভা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার কারণে সেই পুরস্কার প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক গ্রহণ করেছেন। এতেই প্রমাণিত হয় প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত সঙ্গে সঙ্গেই কার্যকর হয়েছে।”

মঙ্গলবার দিনভর লতিফ সিদ্দিকীকে অব্যাহতি দেওয়ার গুঞ্জন চললেও সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছিল না।

একদিন বাদে ক্ষমতাসীন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানালেও সরকারের আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা এখনও আসেনি।

বিকালে হানিফের সংবাদ সম্মেলনের পর এই বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্ম-সচিব আব্দুল ওয়াদুদ সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীকে অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো নির্দেশনা নেই।”

মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা হজ পালনে বর্তমানে সৌদি আরব রয়েছেন। 

সমালোচনার মধ্যে থাকা আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লতিফ সিদ্দিকী মঙ্গলবার বিবিসি বাংলাকে বলেন, তিনি কোনো ধরনের চাপের মুখে পদত্যাগ করবেন না। তবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী সব কাজ করবেন।

লতিফ সিদ্দিকীর বিষয়ে সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে শেখ হাসিনার ৫১ সদস্যের মন্ত্রিসভা থেকে নয় মাসের মধ্যে এই প্রথম কেউ বাদ পড়লেন।

হাসিনার গত সরকারে বাদ পড়তে হয়েছিল পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে সমালোচনায় থাকা সৈয়দ আবুল হোসেন। এছাড়া অর্থ কেলেঙ্কারিতে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পদত্যাগ করলেও তাকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করে রাখা হয়েছিল।

প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা লতিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত নিউ ইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে হজ ও তাবলিগ জামাত নিয়ে বক্তব্য থেকে।

সেদিন টাঙ্গাইল সমিতির এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “আমি কিন্তু হজ আর তাবলিগ জামাতের ঘোরতর বিরোধী। আমি জামায়াতে ইসলামীর যতটা বিরোধী তার চেয়ে হজ আর তাবলিগের বিরোধী।”

তার পুরো বক্তব্যের ভিডিও ক্লিপ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।

ওই ভিডিওতে তাকে বলতে দেখা যায়, “এ হজে যে কত ম্যানপাওয়ার (জনশক্তি) নষ্ট হয়। এই হজের জন্য ২০ লাখ লোক আজ সৌদি আরবে গেছেন। এদের কোনো কাজ নাই। কোনো প্রডাকশন নাই, শুধু ডিডাকশন দিচ্ছে। শুধু খাচ্ছে আর দেশের টাকা বিদেশে দিয়ে আসছে।”

অনুষ্ঠান তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও তার তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, “কথায় কথায় আপনারা জয়কে টানেন কেন। ‘জয় ভাই’ কে?

“জয় বাংলাদেশ সরকারের কেউ নয়। তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ারও কেউ নন।”

তার এই বক্তব্য তাৎক্ষণিকভাবে ফেইসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে আলোচনার ঝড় তোলে। এরপর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বক্তৃতা-বিবৃতিও আসতে থাকে।

সরকারের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এরশাদ মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর গ্রেপ্তার দাবি করেন। বিএনপি তাকে বরখাস্তের দাবি জানায়। ইসলামী দলগুলো এই মন্ত্রীর বিচারের দাবিতে আন্দোলনের হুমকিও দিয়েছে।

ভিনদেশে করা ওই বক্তব্য নিয়ে বুধবার বাংলাদেশের কয়েকটি আদালতে লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। পাঁচটি মামলায় তাকে তলব করে আদালত সমনও জারি করেছে।

এর মধ্যেই বুধবার বিকালে দলীয় প্রধানের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসে আওয়ামী লীগ নেতা হানিফ বলেন, মন্ত্রীর বক্তব্য আওয়ামী লীগ সমর্থন করে না।

“নিউ ইয়র্কে হজ নিয়ে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা অত্যন্ত দুঃখজনক। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি জানার সাথে সাথে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়েছেন।”

লতিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে ব্যাপক আলোচনার মধ্যে সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মঙ্গলবার বলেছিলেন, মন্ত্রিসভায় তার এই সহকর্মীর বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার পর নেবেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সফর করে এখন যুক্তরাজ্যে রয়েছেন। ২ অক্টোবর তার দেশে ফেরার কথা।

নিজের বক্তব্য থেকে সরে আসার সম্ভাবনা নাকচ করে লতিফ সিদ্দিকী মেক্সিকো থেকে বিবিসি বাংলাকে বলেন, একজন ‘স্বাধীন ও আধুনিক মানুষ’ হিসেবে হজ সম্পর্কে ওই মন্তব্য করেন।

টাঙ্গাইলে প্রভাবশালী সিদ্দিকীদের জ্যেষ্ঠ ভাই ৭৭ বছর বয়সী লতিফ সিদ্দিকী রাজনীতিতে স্পষ্টভাষী হিসেবে যেমন পরিচিত, তেমনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তীর্যক বক্তব্য দিয়ে এর আগেও আলোচনায় এসেছেন তিনি।

নিজের ভাই আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর ‘হঠাৎ জামায়াত ঘনিষ্ঠতাকে’ যেমন তিনি ‘বীর উত্তমের রাজাকার হওয়ার শখ’ বলে সমালোচনা করেছেন, তেমনি বাড়িতে ডেকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের এক প্রকৌশলীকে পেটানোর অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতি) আসন থেকে পাঁচবার সংসদে যাওয়া লতিফ সিদ্দিকী গত মহাজোট সরকারের পাট ও বস্ত্রমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। শেখ হাসিনা টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর চলতি বছরের শুরুতে ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান তিনি।

তবে এই লতিফ সিদ্দিকীই ১৯৮০ এর দশকে প্রবাসে থেকে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সভাপতি হওয়ার বিরোধিতা করেছিলেন, আবার ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর বঙ্গবন্ধুকন্যার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেন।

ষাটের দশকে বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামের দিনগুলোতে একাধিকবার কারাগারে যেতে হয় বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য লতিফ সিদ্দিকীকে।

ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে ১৯৬৪-৬৫ সালে করটিয়া সাদত কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। ৬৬ ছয় দফা ও ৬৯ এর গণঅভ্যূত্থানে সক্রিয় এই নেতা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে সংগঠক হিসাবে ভূমিকা রাখেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধা লতিফ সিদ্দিকীকে প্রায় ছয় বছর কারাগারে কাটাতে হয়। এরশাদের আমলে স্ত্রী লায়লা সিদ্দিকী জাতীয় পার্টির নারী সাংসদ হওয়ার পর মুক্তি পান তিনি।

গত সরকারের শুরুর দিকে এক অধিবেশনে সংসদের প্রথম সারিতে মন্ত্রী ও সরকারি দলের সাংসদের অনুপস্থিতি দেখে তখনকার স্পিকার ও বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ক্ষোভ প্রকাশ করলে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতেই তার জবাব দেন লতিফ।

সংসদে তিনি বলেন, “স্পিকার হচ্ছেন সংসদের সেবক। তিনি প্রভু নন। কোনো সাংসদের পয়েন্ট অফ অর্ডারেই শুধু রুলিং দিতে পারেন স্পিকার।”

২০১১ সালে পাট নিয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ‘যথাযথ মর্যাদা’ না দেওয়ার অভিযোগ তুলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের উপস্থিতিতেই আয়োজকদের তুলোধুনা করেন তখনকার পাটমন্ত্রী লতিফ।

বাংলাদেশে সব পোশাক কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন চালুর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মধ্যেই গত বছর রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনাকে একটি চিঠি লেখেন তখনকার বস্ত্রমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী, যে চিঠির শিরোনাম ছিল ‘ট্রেড ইউনিয়ন প্রশ্নে আপনি বলার কে?’