সুষম উন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসেবে শান্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তা বজায় রাখতে বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন শেখ হাসিনা।
Published : 27 Sep 2014, 09:31 PM
শান্তিরক্ষায় নেতৃত্ব দিতে সক্ষম বাংলাদেশ: হাসিনা
যুদ্ধমুক্ত পৃথিবী গড়তে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান
হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসায় মুন-বিসওয়াল
সমরাস্ত্রে নয়, ব্যয় করতে হবে শিক্ষায়: হাসিনা
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৯তম অধিবেশনে শনিবার দেওয়া ভাষণে এই আহ্বান জানান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
বাংলায় দেওয়া ভাষণে শেখ হাসিনা আবারও বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানান।
সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তার সরকারের অনমনীয় নীতির কথা তুলে ধরে বাংলাদেশে তা মোকাবেলার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন তিনি।
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের চলমান বিচারে বিশ্ব সম্প্রদায়ের পূর্ণ সমর্থন চেয়ে হাসিনা বলেন, অত্যন্ত স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে গঠিত স্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এই বিচার হচ্ছে।
সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের (এমডিজি) অর্জনের সময়সীমা উত্তীর্ণ হতে যাওয়ায় পরবর্তী ১৫ বছরের জন্য নতুন লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করার ক্ষেত্রে ভারসাম্যমূলক একটি প্যাকেজ গ্রহণের পরামর্শ দেন তিনি।
বৈশ্বিক উন্নয়নের জন্য শান্তির বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “স্থায়ী শান্তি এবং নিরাপত্তা ব্যতিত আমরা টেকসই উন্নয়ন অর্জন করতে পারব না। আন্তর্জাতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অস্থিতিশীল বৈশ্বিক নিরাপত্তা অবস্থা এখনও বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে।
“বাংলাদেশ বিশ্বাস করে, বিশ্বের যে কোনো স্থানে শান্তি বিঘ্নিত হলে তা গোটা মানবজাতির জন্য হুমকিস্বরূপ।”
এই প্রসঙ্গে চার দশক আগে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রথম ভাষণ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, “বাঙালি জাতি শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান, সামাজিক ন্যায়বিচার, এবং দারিদ্র্য-ক্ষুধা-আগ্রাসনমুক্ত এবং বৈষম্যহীন একটি সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে অঙ্গীকারাবদ্ধ।”
মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতি বাংলাদেশের দৃঢ় অবস্থানের কথা জানিয়ে তাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও সমর্থন প্রত্যাশা করেন হাসিনা।
সন্ত্রাসবাদ এবং চরমপন্থাকে বিশ্বশান্তি ও উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায় হিসেবে তুলে ধরে তিনি বলেন, প্রতিবেশী বা অন্যদের বিরুদ্ধে যে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠির কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রমে বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে না দেওয়ার ক্ষেত্রে তার সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি এখনো রাষ্ট্রের প্রগতিশীল এবং উদার চরিত্রকে নস্যাৎ করতে সদা তৎপর বলে বিশ্ব সম্প্রদায়কে জানান হাসিনা।
“তারা সুযোগ পেলেই ধর্মীয় উগ্রবাদ এবং সহিংসতা ছড়িয়ে দেয়। বিএনপি-জামাত জোট সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বোমা ও গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে অসংখ্য উদার রাজনৈতিক নেতা-কর্মী হত্যা করেছে।”
“এসব নৃশংস হামলা আমাকে দেশ থেকে সব ধরনের সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করতে আরও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করেছে,” বলে সন্ত্রাসবাদ ও উগ্রপন্থা নির্মূলে আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরেন হাসিনা।
শান্তি ও আইনের শাসন সমুন্নত এবং দণ্ড অব্যাহতির সংস্কৃতি থেকে বের হওয়ার প্রতি অঙ্গীকার থেকে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার হচ্ছে বলে বিশ্ববাসীকে জানান তিনি।
“এজন্য ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছিল, ধর্ষণ এবং গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদেরকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে।”
বাংলাদেশের জনগণের দীর্ঘদিনের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষায় এই বিচার হচ্ছে জানিয়ে এর প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পূর্ণ সমর্থন চান প্রধানমন্ত্রী।
বৈশ্বিক দারিদ্র্য বিমোচনে এমডিজিকে সফল উল্লেখ করলেও এই অগ্রগতি বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে এমনকি দেশের অভ্যন্তরেও সমানভাবে সম্পন্ন হয়নি বলে মত জানান হাসিনা।
সমষ্টিগতভাবে এমডিজির আওতায় দারিদ্র্য বিমোচনের গড় লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলেও বিশ্বের প্রায় ১৩০ কোটি মানুষের এখনও চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাসের কথা উঠে আসে তার ভাষণে।
২০১৫ সালের পর ১৫ বছরের জন্য নতুন কর্মসূচি ঠিক করতে বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করে দারিদ্র্য বিমোচনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেন বাংলাদেশের সরকার প্রধান।
“এ নতুন কাঠামোয় টেকসই উন্নয়নের তিনটি স্তম্ভের মধ্যে ভারসাম্য থাকতে হবে। ... আমরা মনে করি, নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রাগুলো হবে সযত্নে নির্বাচিত ভারসাম্যমূলক একটি প্যাকেজ।”
ভবিষ্যৎ উন্নয়ন এজেন্ডায় স্বল্পআয়ের উন্নয়নশীল দেশগুলোর সম্পদ এবং সক্ষমতা সংশ্লিষ্ট দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা সমাধানের উপায় সংক্রান্ত বিষয়গুলোর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিতের আহ্বান জানান হাসিনা।
উন্নত কয়েকটি দেশ প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাদের সামষ্টিক জাতীয় আয়ের শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ এবং ওডিএ হিসেবে জাতীয় আয়ের শূন্য দশমিক ২ শতাংশ স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে দিলেও অধিকাংশ দেশই সেই প্রতিশ্রুতি না রাখায় হতাশা প্রকাশ করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
উন্নত দেশগুলোর বাজারে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সব ধরনের পণ্যের শুল্কমুক্ত এবং কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার দাবিও জানান তিনি।
জলবায়ু পরিবর্তন-জনিত জটিল ও ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে পর্যাপ্ত এবং অতিরিক্ত অর্থায়ন দেওয়ার গুরুত্বও বিশ্বনেতাদের কাছে তুলে ধরেন হাসিনা।
“সরকারের সময়োচিত নীতি গ্রহণের ফলে তৃণমূল পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত নারী নেতৃত্ব বিকশিত হচ্ছে। বাংলাদেশ সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র দেশ যেখানে প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, সংসদের স্পিকার একজন নারী, বিরোধীদলের নেতা এবং সংসদ উপনেতাও নারী।”
সরকারের সাফল্যের মধ্যে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ১৯৯১ সালের ৫৭ শতাংশ থেকে বর্তমানে ২৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার কথা বলেন হাসিনা।
২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি জ্ঞানভিত্তিক প্রযুক্তিনির্ভর মধ্যম-আয়ের দেশ হিসেবে পরিণত করতে সরকারের প্রচেষ্টার কথাও তুলে ধরেন তিনি।
বিশ্বমন্দার মধ্যে গত পাঁচ বছরে জিডিপির গড় প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে রাখা, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, রিজার্ভ বৃদ্ধির কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশের উন্নয়নের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনে পদ্মা সেতু নির্মাণ, সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপনসহ কয়েকটি বড় প্রকল্প গ্রহণের কথাও জানান তিনি। বিনিয়োগ আকর্ষণে বাংলাদেশে ১৮টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কথাও বলেন তিনি।
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনি কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশের জনসংখ্যার ২৪ শতাংশ মানুষকে আনার কথা জানিয়ে তাদের জন্য নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপও তুলে ধরেন হাসিনা।
অধিবেশন কক্ষে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীরা ছাড়াও টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও জয়ের স্ত্রী ক্রিস্টিন ওভারমায়ার উপস্থিত ছিলেন।
স্থানীয় সময় সকাল ১১টা ২২ মিনিটে সকলের করতালির মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা তার বক্তব্য শুরু করেন।
শেখ হাসিনা যখন গাজায় ইসরাইলের হামলার তীব্র নিন্দা জানান, তখনও অধিবেশন কক্ষে উপস্থিত বাংলাদেশিরা করতালি দেন।
সকলের করতালির মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার আহবান জানান।
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের সময় জাতিসংঘ সদর দপ্তরের বাইরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পাল্টাপাল্টি সমাবেশ করেছে বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের নিউ ইয়র্ক প্রতিনিধি জানিয়েছেন।