সোমবার সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘সংবিধান (ষোড়শ সংশোধন) আইন, ২০১৪’ এর খসড়ায় ভেটিং সাপেক্ষে চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়।
বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা সাংবাদিকদের বলেন, ১৯৭২ সালের সংবিধানে দুই তৃতীয়াংশ সাংসদের অনুমোদনের ভিত্তিতে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের যে বিধান ছিল, সংবিধান সংশোধন করে সেটিই আবার ফিরিয়ে আনা হচ্ছে।
পাশাপাশি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচারক অপসারণের নিয়মটি বাদ পড়ছে।
আইন মন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হতে যাওয়া সংসদ অধিবেশনেই এ সংক্রান্ত বিলটি পাস হবে। কোন পদ্ধতিতে একজন বিচারককে অপসারণ করা যাবে তার বিশদ ব্যাখ্যাসহ একটি আইন করা হবে বিল পাসের তিন মাসের মধ্যে।
তবে সরকারের এই উদ্যোগের সমালোচনা করে বিএনপি বলেছে, ‘একদলীয় শাসন’ প্রতিষ্ঠা করতেই বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেয়া হচ্ছে।
১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের সময় উচ্চ আদালতের বিচারকদের পদের মেয়াদ নির্ধারণ ও তাদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে ছিল।
১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনের মাধ্যমে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়।
চতুর্থ সংশোধন বাতিল হলে জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকারের আমলে এক সামরিক আদেশে বিচারপতিদের অভিশংসনের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা হয়।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা বলেন, “সামরিক ফরমান বলে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হয়। সংশোধন করে এই ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে অর্পণ করা হয়। এটি করা হয়েছিল জাতীয় সংসদের অনুপস্থিতিতে, ১৯৭৮ সালে।”
১৯৭২ সালের সংবিধানে ‘বিচারকদের পদের মেয়াদ’ শীর্ষক ৯৬ অনুচ্ছেদে ২ দফায় বলা হয়- ‘প্রমাণিত ও অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতা দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোনো বিচারককে অপসারিত করা যাইবে না।’
৯৬ অনুচ্ছেদের ৩ দফায় বলা ছিল, “এই অনুচ্ছেদের ২ দফার অধীন প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করিতে পারিবে।”
সচিব বলেন, বাহাত্তরের সংবিধানের এই বিধান দিয়ে বর্তমান সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদটি প্রতিস্থাপিত করা হবে।
আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ এ প্রস্তাবটি মন্ত্রিসভায় নিয়ে আসে। এতে বলা হয়, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের যে বিধান বর্তমান সংবিধানে রয়েছে তা ৭ নম্বর অনুচ্ছেদের পরিপন্থি।
“একজন অভিযুক্ত বিচারক ও কাউন্সিলের সদস্য একই প্রতিষ্ঠানে অনেকদিন কাজ করার কারণে তারা যে সিদ্ধান্ত দেবেন তার যথার্থতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। তাছাড়া সংসদে রাষ্ট্রপতির অভিশংসন ও স্পিকারকে অপসারণ করার বিধান রয়েছে; ৫৭(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব গ্রহণেরও বিধান রয়েছে।”
মোশাররাফ হোসাইন বলেন, অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারনের ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকার বিষয়টি আইন মন্ত্রণায়রে প্রস্তাবে তুলে ধরা হয়েছে।পাশাপাশি আইন কমিশনও বিচারপতিদের অপসারণ সংক্রান্ত বাহাত্তরের মূল বিধানটি পুনর্বহালের পক্ষে মত দিয়েছে।
“সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের এ বিধানটি আর থাকবে না, যদি বাহাত্তরের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল হয়।”
সচিব জানান, মন্ত্রিসভার অনুমোদন পাওয়ায় খসড়াটি এখন বিল আকারে সংসদে তোলা হবে। সংসদের অনুমোদনের পর আরেকটি আইন করা হবে, তাতে বিচারকদের অসামর্থ্য, অসদাচরণ ও অভিযোগ সম্পর্কে কীভাবে তদন্ত হবে, সংসদ কীভাবে প্রস্তাব নেবে এবং রাষ্ট্রপতি কোন প্রক্রিয়ায় তা অনুমোদন করবেন- এসব বিষয়ে বিস্তারিত বলা থাকবে।
অনুমোদন দেয়ার আগে মন্ত্রিসভার বৈঠকে অন্যান্য দেশের নজির নিয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে মোশাররাফ হোসাইন বলেন, প্রতিবেশী দেশ ভারতে দুই কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের দুই কক্ষেই সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য অনুমোদন দিলে রাষ্ট্রপতি অপসারণের আদেশ দিতে পারেন।
যুক্তরাজ্যের নিয়ম হলো, পার্লামেন্টের দুই কক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে প্রস্তাব পাস হতে হবে, তারপর রানি তাতে অনুমোদন দেবেন।
অভিশংসনের ক্ষমতা পার্লামেন্টের হাতে দেয়া আছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানেও। প্রতিনিধি সভা ও সিনেটে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যদের সম্মতি পেলে বিচারকদের অপসারণ করা যায়।
এছাড়া অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকা, জার্মানি, নিউজিল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের সংবিধানে একই বিধান রয়েছে বলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান।
উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেয়ার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে আওয়ামী লীগের গত সরকারের মেয়াদে।
২০১২ সালে তৎকালীন স্পিকার ও বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের একটি রুলিংকে কেন্দ্র করে কয়েকজন সংসদ সদস্য হাই কোর্টের একজন বিচারপতিকে অপসারণের দাবি তোলেন। সে সময়ই বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনার দাবি জোরালো হয়।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দেয়ার পক্ষে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেন।