নম্বর বাড়িয়ে পাস করিয়ে দেয়াসহ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন কাজে কোটি কোটি টাকার অবৈধ লেনদেন হয় বলে একটি বেসরকারি সংস্থার গবেষণায় বেরিয়েছে।
Published : 30 Jun 2014, 02:54 PM
সোমবার রাজধানীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্যই তুলে ধরা হয়।
‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষণা ও কৌশল পরিচালক মোহাম্মদ রফিক হাসান ও ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার নীনা শামসুন নাহার।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেয়া থেকে শুরু করে অ্যাসাইনমেন্ট, অডিট, ভুয়া সনদ, পাঠ্যক্রম, বিভাগ অনুমোদন ও অনুষদ অনুমোদন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ নিষ্পত্তি, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য পরিদর্শন, ভিসি, প্রো-ভিসি, ট্রেজারার নিয়োগের অনুমোদন এবং বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমোদনসহ বিভিন্ন কাজে ৫০০ থেকে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে গবেষণায়।
এছাড়া অনুমোদনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (ইউজিসি) সংরক্ষিত তহবিলের ভুয়া রশিদে ৩ কোটি টাকা দেয়ারও প্রমাণ পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু খাতটি যেখানে নন প্রফিট হওয়ার কথা সেখানে মুনাফা অর্জনের উপায় হিসেবে দেখা হচ্ছে। এর ফলে উচ্চ শিক্ষা বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত হয়েছে।”
বেসরকারি শিক্ষাখাতের অনিয়ম-দুর্নীতিতে ‘উদ্বেগ’ প্রকাশ করে তিনি জানান, এসব অনিয়মে মন্ত্রণালয়, ইউজিসি, তদারকি সংশ্লিষ্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অংশ জড়িয়ে পড়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৯২ সাল থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেওয়া শুরুর পর ২০০৩ ও ২০১২ সালে সর্বোচ্চ ১৬টি করে অনুমোদন দেওয়া হয়। ১৯৯৪, ৯৭, ৯৮, ও ৯৯ সালে এবং ২০০৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেওয়া হয়নি।
টিআইবি নির্বাহী পরিচালক বলেন, আইন উপেক্ষা করে প্রভাবশালীদের নামে বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে, যা দুর্ভাগ্যজনক। এক্ষেত্রে যারা তা নিয়ন্ত্রণ করে তারাই এখন ভঙ্গ করছেন আইন।
গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তাদের মধ্যে ২৯ দশমিক ৬ শতাংশই ব্যবসায়ী। ২২ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষাবিদ ও ৮ দশমিক ৫ শতাংশ রাজনীতিবিদ পাওয়া গেছে।
আর ইউজিসির প্রতিবেদনে, ট্রাস্ট্রি বোর্ডের সদস্যদের বেশির ভাগ সদস্য ব্যবসায়ী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পর্যায়ক্রমে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে উল্লেখ করে টিআইবি পরিচালক রফিক হাসান বলেন, “পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে প্রতিবছর। সাধারণত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না পাওয়ার পরই অভিভাবকরা সামর্থ্য বিবেচনায় তাদের সন্তানদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দিচ্ছেন। পাশাপাশি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট ও রাজনৈতিক পরিবেশটাও মাঝে মাঝে বিবেচনায় এসেছে বলে জানায় কয়েকজন অভিভাবক।”
অনিয়ম-দুর্নীতিতে ট্রাস্টি বোর্ড
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল, অর্থ কমিটি কার্যক্রম ট্রাস্টি বোর্ডের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে নিয়ন্ত্রিত হয়। এছাড়া অন্য ব্যবসা পরিচালনায় বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবহার, ইউজিসিকে না জানিয়ে তহবিলের টাকা ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার, বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে এবং স্বাক্ষর জাল করে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ, শিক্ষকদের পারফর্মেন্স মূল্যায়নে প্রভাব বিস্তার, কম যোগ্য ব্যক্তিকে বিভাগীয় প্রধান করাসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে রয়েছে ট্রাস্টি বোর্ডের কোনো কোনো সদস্য।
প্রতিষ্ঠার ১২ বছরের মধ্যে স্থায়ী সনদ নেওয়ার বিধান থাকলেও এ পর্যন্ত দুটি বিশ্ববিদ্যালয় সব শর্ত পূরণ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সনদ পেয়েছে। ৭৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১৭টি স্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
ট্রাস্টি বোর্ডে শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন এমন ব্যক্তি ও পরিবারের সদস্যদের প্রাধান্য রয়েছে। দীর্ঘদিন অস্থায়ী ভিসি, প্রোভিসি, ট্রেজারার দিয়ে (৭৯টির মধ্যে ভিসি ৫২, প্রোভিসি ১৮টি ও ৩০টিতে ট্রেজারার আছে) পরিচালিত হচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দুর্নীতি
ইউজিসির নির্দেশনা অনুযায়ী, দুটির বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করা নিষিদ্ধ থাকলেও শিক্ষকরা জড়িয়ে পড়েছে নানা দুর্নীতিতে।
একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্পৃক্ততা, পরীক্ষার আগে শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন ফাঁস করে দেওয়া, পাঠদান না করে শিক্ষার্থীদের ডিগ্রি দিতে কর্তৃপক্ষকে সহায়তা ও অর্থ নেওয়া, যৌন হয়রানি ও মানসিক চাপ সৃষ্টি, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে উপঢৌকন ও নগদ অর্থ নিয়ে পাস করিয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
পরীক্ষা ছাড়া সার্টিফিকেট দেওয়ার বিষয় গোপন রাখা, নম্বর বাড়াতে শিক্ষকদের চাপ প্রয়োগ, শিক্ষকদের অন্যায়ভাবে চাকুরিচ্যুতির হুমকি এবং সার্টিফিকেট কেনা-বেচার দুর্নীতিও রয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, তদারকি ও সমন্বয়হীনতার ফলে এবং ত্রিপক্ষীয় আঁতাতের কারণে দুর্নীতির প্রসার হওয়ায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খাত হুমকির সম্মুখীন হয়েছে।
“এথেকে পরিত্রাণ পেতে বেসরকারি খাতের সুশাসন নিশ্চিত করার অন্য কোনো বিকল্প নেই।”
১৬ দফা সুপারিশ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েং সুশাসনের সার্বিক চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করে তা উত্তরণে ১৬ দফা সুপারিশ করেছে টিআইবি।
এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ এর প্রয়োজনীয় সংশোধনী ও পূর্ণাঙ্গ বিধিমালা প্রণয়ন, অবিলম্বে অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল গঠন, ইউজিসির জনবল ও সক্ষমতা বাড়িয়ে তদারকি ব্যবস্থা শক্তিশালী করা, আইন লঙ্ঘনে দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, শুধুমাত্র উচ্চ রেটিংপ্রাপ্ত বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নির্ধারিত শর্ত মেনে শাখা ক্যাম্পাস পরিচালনা, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় সব ক্ষেত্রে বোর্ড অব ট্রাস্টির একচ্ছত্র ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ, ভিসি ও প্রেভিসি নিয়োগে রাজনৈতিক প্রভাব দূরীকরণ, একাডেমিক কাউন্সিলের মূল ভূমিকা নিশ্চিতকরণ, অডিট প্রতিবেদন তথ্য উন্মুক্ত করা এবং খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগে সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করে বাস্তবায়ন করা।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “এসব সুপারিশ আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে পৌঁছে দেব। যাতে চিহ্নিত অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করে এ খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা যায়।”
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ৭৯টি। এর মধ্যে দৈবচয়ন ভিত্তিতে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের ২২টি বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন করে ২০১২ সালের জুন থেকে ২০১৪ সালের মে পর্যন্ত সময়ে এ গবেষণা করা হয়েছে।
অন্যান্যের মধ্যে টিআইবির উপনির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া খায়ের ও পরিচালক রিজওয়ান-উল-আলমও সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।