ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনায় স্থানীয় দুই আওয়ামী লীগ নেতার সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে র্যাব।
Published : 24 May 2014, 10:35 AM
এই হত্যাকাণ্ডে ‘জড়িত’ সাতজনকে গ্রেপ্তারের পর তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে শনিবার র্যাব মুখপাত্র এটিএম হাবিবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, আধিপত্য বিস্তার ও দলীয় কোন্দলের জের ধরেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে তাদের ধারণা।
গ্রেপ্তার সাতজনের মধ্যে ফেনী সদরের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজামউদ্দিন হাজারীর মামাত ভাই আবিদুল ইসলামও (২২) রয়েছেন। আবিদের মা জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
গ্রেপ্তারকৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে আওয়ামী লীগের দুই নেতার নাম জানিয়ে বলেছেন, তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছেন তারা।
এরা হলেন- ফুলগাজী উপজেলা শাখার যুগ্মসম্পাদক জিহাদ চৌধুরী এবং ফেনী পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও ওই ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল্লাহিল মাহমুদ শিবলু।
গত ২০ মে ফেনী শহরে যে এলাকায় প্রকাশ্যে একরামকে গুলি চালানোর পর গাড়িসহ পুড়িয়ে হত্যা করা হয়, শিবলু ওই এলাকার কাউন্সিলর এবং জিহাদের বাসাও ওই এলাকায়।
ঘটনার পর থেকে জিহাদ পলাতক, অন্যদিকে শিবলু শনিবার ফেনী পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন।
আবিদসহ গ্রেপ্তার যে আটজনকে শনিবার উত্তরায় র্যাব সদর দপ্তরে সাংবাদিকদের সামনে আনা হয়, তাদের সবাই বয়সে যুবক।
গ্রেপ্তার অন্যরা হলেন- কাজী শানান মাহমুদ (২৩), জাহিদুল ইসলাম সৈকত (২২), চৌধুরী মো. নাফিজ উদ্দিন (২০), শাহজালাল শিপন (২২), মো. জাহিদ হোসেন, সাজ্জাদুল ইসলাম পাটোয়ারি সিফাত (২৩) এবং হেলালউদ্দিন (২৩)।
এদের মধ্যে হেলাল ছাড়া বাকি সবাই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন বলে র্যাব দাবি করছে। জাহিদকে ফেনী থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
অন্য সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয় ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় হেলালের বাড়ি থেকে। ছয় খুনিকে আশ্রয় দেয়ায় হেলালকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে র্যাব জানায়।
ফুলগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি একরামকে হত্যার পর তার ভাইয়ের করা মামলায় বিএনপি নেতা মাহতাব মিনারকে আসামি করা হলেও দলের একটি অংশ নিজাম হাজারীর দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছিল।
তবে নিজাম এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে তার আসনে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য জয়নাল আবেদীন হাজারী ও বিএনপিকে দায়ী করেন।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, ফুলগাজীতে একরামের সঙ্গে জিহাদের দ্বন্দ্ব ছিল। আর এক্ষেত্রে নিজামের সমর্থন ছিল জিহাদের দিকে।
জিহাদের রাজনৈতিক পরিচয়ের বিষয়ে র্যাব মুখপাত্র হাবিব বলেন, “কে কোন দল করে, সেটা আমরা জানি না। যারা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, তারা অপরাধী। এটাই তাদের বড় পরিচয় র্যাবের কাছে।”
কাউন্সিলর শিবলুর বিষয়ে তিনি বলেন, “শিবলু আবিদদের তথ্য দিয়েছিল যে একরামের গাড়ি একাডেমি এলাকায় প্রবেশ করেছে। তার বিষয়ে আপাতত এতটুকুই জানা গেছে।”
পরিকল্পনা জানিয়ে ‘পিস্তল দেন’ জিহাদ
দিনের বেলায় ব্যস্ত সড়কে সশস্ত্র হামলা চালিয়ে একরামকে হত্যাকাণ্ডে ৪০ থেকে ৫০ জন অংশ নিয়েছিল বলে র্যাবের ধারণা।
হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো জিহাদই দিয়েছিল বলে গ্রেপ্তার সাতজন র্যাবকে জানিয়েছে। “পরে তারা নিজেদের কাছে থাকা পিস্তল জিহাদের কাছে জমা দেয় বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে,” বলেন র্যাব মুখপাত্র হাবিব।
ঘটনার দিন একরাম ফেনী শহরের মাস্টার পাড়ার বাসা থেকে তার প্রাইভেটকারে আরো চারজনকে নিয়ে ফুলগাজীর পথে রওনা হয়েছিলেন।
সকাল ১১টার দিকে একাডেমি এলাকায় বিলাসী প্রেক্ষাগৃহের সামনে একটি ইজিবাইক দিয়ে প্রথমে তার গাড়ি আটকে ফেলা হয়েছিল। এরপর গাড়িতে থাকা অন্যদের কুপিয়ে ও পিটিয়ে বের করে আনা হয়।
একরামকে গুলি চালানোর পর ভেতরে আটকে রেখে গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল বলে পুলিশ জানায়। আগুনে একরামের দেহ পুরোপুরি পুড়ে যায়।
গ্রেপ্তার আবিদ র্যাব কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, সেদিন সকালেই তারা ঘটনাস্থলের আশপাশে জড়ো হয়েছিলেন। সকাল ৮টার দিকে শিফাত, শানান, সানি, রাহাত, মোহন, অনিক ও সৈকত তার কাছে আসেন।
“রুটি সোহেল নামে আমাদের এলাকার এক বড় ভাই তিনটা পিস্তল নিয়ে আসে। আমাকে আর শানানকে দুটা দিয়ে নিজে একটা রাখে। রুটি সোহেল আমাকে বলে, কেউ সামনে এলে গুলি চালাবি।”
“ঘটনার দিন রুটি সোহেল আমাকে বলে, ‘জাহিদ ভাই বলেছেন, একরাম চেয়ারম্যানের গাড়িতে থাকা লোকজনের সঙ্গে আমরা ঝগড়া করব। গাড়ির কাচ ভেঙে দেব। ওরা আক্রমণ করলে আমরাও করব’।”
হামলার বর্ণনা দিয়ে আবিদ বলেন, “সকাল ১১টার দিকে একাডেমির সামনে একরাম ভাইয়ের গাড়ি আসে। আমি, মানিক, রুটি সোহেলসহ কয়েকজন একটা ইজিবাইক নিয়ে সে গাড়ির গতিরোধ করি।
“সেখানে থাকা অন্তত ৪০/৫০ জন গাড়িতে ইট ছুড়তে থাকে, রামদা দিয়ে গাড়িতে কোপাতে থাকে। আমি ও শানান ওপরের দিকে গুলি ছুড়ি। রুটি সোহেল গাড়ির ভেতরে গুলি চালায়।”
পাপন, নয়ন ও তাদের কয়েক বন্ধু পাশের একটা দোকান থেকে কেরসিন এনে গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় বলে আবিদের দাবি।
শাহজালাল শিপন সাংবাদিকদের বলেন, “সকালে ছাত্রলীগের একটা শোডাউন আছে বলে সোহেল ভাই (রুটি সোহেল) আমাকে জানিয়েছিল। তাই রামদা নিয়ে আমরা ৪০/৫০ জন ছাত্রলীগকর্মী একাডেমি এলাকায় শোডাউন দিই।
“একরাম ভাইয়ের গাড়ি এলে হঠাৎ তাতে আক্রমণের ঘটনা ঘটে। কারা তাকে গুলি করেছে আমি জানি না। আমি শোডাউনের অনেক পেছনে ছিলাম।”
সোহেলসহ অন্য যাদের নাম আবিদ বলেছেন, তাদের গ্রেপ্তারে তৎপরতা চলছে বলে র্যাব মুখপাত্র হাবিব জানান।
তিনি বলেন, “জিহাদ চৌধুরী একরাম হত্যার আগের রাতে সালাম জিমনিশিয়ামে আবিদ, রুটি সোহেলসহ কয়েকজনের কাছে হত্যার পরিকল্পনা জানিয়েছিল।
“এজন্য আবিদ, শানান, সিফাত, সানী ও সৈকতকে পাঁচটি পিস্তল দিয়েছিল। হত্যার পর তাদের আত্মগোপনে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল জিহাদ চৌধুরী,” বলেন হাবিব।
এই হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত কোনো অস্ত্র এখনো উদ্ধার করা যায়নি।