মাইকে গুজব ছড়িয়ে পরিকল্পিতভাবে কুমিল্লার হোমনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির-বাড়িঘরে হামলা চালানো হয়েছে, যার নেতৃত্বে ছিলেন তিন উপজেলার আট মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক।
Published : 05 May 2014, 10:22 AM
গত ২৭ এপ্রিল ফেইসবুকে নবীকে নিয়ে কটূক্তি করার গুজব রটিয়ে হোমনা উপজেলার বাঘসীতারামপুর গ্রামের দক্ষিণ পাড়ার হিন্দুপল্লীতে চালানো এই হামলায় ২৮টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
রামু, ফটিকছড়ি, হাটহাজারী এবং নারায়ণগঞ্জেও প্রায় একই পদ্ধতি অনুসরণ করে হামলা চালানো হয়েছিল।
হোমনায় সাম্প্রদায়িক এই হামলায় হিন্দুদের মন্দির ও বাড়িঘরে হামলা চালিয়েই ক্ষান্ত হননি তারা, দরিদ্র মৎসজীবী মানুষদের সর্বস্ব লুট করা হয়েছে। এই লুটপাটে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে ওই গ্রামের মন্টি রানী দাসের, আর চারদিন পরেই যার বিয়ের দিন ঠিক ছিল।
দরিদ্র মৎস্যজীবী বাবা মেয়ের বিয়ের জন্য বিশ হাজার টাকা ও দুই ভরি স্বর্ণ জোগাড় করেছিলেন, রোববারের হামলায় তাও লুটে নেয়া হয়েছে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই হামলায় প্রধানত অংশ নিয়েছেন বাঘসীতারামপুরের পাশের রামপুর গ্রামের জামিয়া আরাবিয়া ইসলামীয়া এমদাদুল উলুম মাদ্রাসাসহ হোমনা, মুরাগনগর ও বাঞ্ছারামপুর উপজেলার আটটি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষরা।
গ্রামবাসীরা জানান, রামপুরের ওই মাদ্রাসার মাইক থেকেই রোববার দুপুরে হামলার আহ্বান জানানো হয়। তার কয়েকদিন আগে নবীকে কটাক্ষ করার গুজব নিয়ে লিফলেট ছাপিয়ে ওই মাদ্রাগুলোতে বিতরণ করা হয়।
হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে ইতোমধ্যে মুরাদনগরের বাগমারা মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল নুরুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
তবে সাম্প্রদায়িক উস্কানির চিঠি বিতরণকারী ও পুলিশের অভিযোগপত্রে প্রধান আসামি নজরুল ইসলাম এখনো গ্রেপ্তার হয়নি।
হামলা পরিকল্পিত
পুলিশ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও আক্রান্তদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ২৭ এপ্রিল সন্ধ্যায় বাঘসীতারামপুরের হিন্দুপল্লীতে হামলা চালানোর আগে ওই গ্রামের দুই যুবকের বিরুদ্ধে পাশের গ্রামের তিন ব্যক্তি কটূক্তির অভিযোগ তোলে।
আগের দিন ওই অভিযোগ নিয়ে শালিস ডাকা হলেও তা পরদিনের জন্য মুলতবি রাখা হয়। কিন্তু এর মধ্যেই মাইকে প্রচার করে লোক জড়ো করে হামলা চালানো হয়।
হামলার শিকার বাঘসীতারামপূর গ্রামের ইন্দ্রজিত দাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শনিবার বিকেলে উত্তর পাড়ার আল আমিন, রবিউল্লাহ ও গিয়াসউদ্দিন আমাদের পাড়ায় এসে উদ্ভব দাস ও শ্রীনিবাস দাসের বিরুদ্ধে নবীর নামে বাজে কথা লিখেছে বলে অভিযোগ তুলে বিচারের কথা বলে।
“আমরা এর বিচারের কথা বললে তারা বলে, তোমাদের বিচারে কাজ নেই। আজ সন্ধ্যায় সালিশ হবে, উদ্ভব ও শ্রীনিবাসকে নিয়ে তোমরা সালিশে হাজির থাকবে।”
তিনি বলেন, অভিযোগের বিষয়ে প্রমাণ দেখতে চাইলে তারা বলে, প্রমাণ সালিশে দেখাবে।”
২৬ এপ্রিল সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত গ্রামে সালিশ চলে। তাতে অভিযুক্ত উদ্ভব উপস্থিত থাকলেও শ্রীনিবাস ঢাকায় ছিল। তাই রোববার বিকাল ৪টা পর্যন্ত সালিশ মুলতবি করা হয়। কিন্তু সালিশের ঘণ্টাদুয়েক আগে হামলা চালানো হয় হিন্দুপাড়ায়।
সালিশের অন্যতম বিচারক ছিলেন বাঘসীতারামপুর নিবাসী ও চান্দের চর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নাঈম উল্লাহ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, সালিশে বারবার জিজ্ঞাসাবাদে উদ্ভব অভিযোগ অস্বীকার করে।
“আমি একপর্যায়ে বাদী পক্ষকে বললাম- তোমরা প্রমাণ দেখাও। তারা বলল, প্রমাণ তাদের কাছে আছে, আগামীকাল (রোববার) সালিশে তা দেখানো হবে।”
হামলার বিষয়ে এই ইউপি সদস্য বলেন, “রোববার দুপুর ১২টার দিকে চান্দের চর জামে মসজিদের ইমাম আমাকে ফোন করে জানান, বাজারে বেশ কিছু মানুষ জড়ো হয়েছে, তারা বাঘসীতারামপুর গ্রামে আসতে চাচ্ছে।
“আমি সেখানে গিয়ে বিভিন্ন বয়সী প্রচুর মানুষকে জড়ো হওয়া দেখলাম, সবাইকে চিনি না। সেখানে আমি রামপুর মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষক হেদায়েত উল্লাহ মওলানা ও শাহ আলম মওলানাকে সনাক্ত করতে পেরেছিলাম। হামলার সময়ও তারাই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
“আমরা যখন সালিশের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, তার আগেই এই ঘটনা ঘটল। আমরা আগে থেকে কিছুই টের পাইনি।”
এদিকে মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল নুরুজ্জামানকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ বলছে, তিন চারদিন আগে থেকে হামলার প্রস্তুতি চলছিল।
কুমিল্লার সহকারী পুলিশ সুপার (মুরাদনগর সার্কেল) নজরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মূলত তিন/চার দিন আগে থেকেই হামলার প্রস্তুতি চলছিল।
“ওই সময় নজরুল ইসলাম আটটি মাদ্রাসায় চিঠি দিয়ে জানায় যে, ফেসবুকে নবীর বিরুদ্ধে আজে বাজে কথা লেখা হয়েছে। মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের সংগঠিত করার প্রাথমিক কাজটা সে-ই শুরু করে।
“এখন পর্যন্ত তদন্তে আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি, এই হামলার সঙ্গে একটি চক্র যুক্ত, যাদের একজন নজরুল।”
এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ইংরেজি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র নজরুল ইসলামই মাইকে হামলার আহ্বান জানায়।”
এই নজরুল ‘ছাত্রদল কিংবা শিবিরের’ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে- পুলিশের কাছে এরকম তথ্য আছে বলে জানান তিনি।
এসপি নজরুল বলেন, “হোমনা, মুরাদনগর ও বাঞ্ছারামপুরের আটটি মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকরাই মূলত হামলার অগ্রভাগে ছিল। কিছু গ্রামবাসী ছিল, কিন্তু নেতৃত্বে ছিল মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকরা।”
যেভাবে হামলা হলো
বাঘসীতারামপুর গ্রামের কয়েকজনের কথা বলে জানা যায়, পাশের রামপুর গ্রামের জামিয়া আরাবিয়া ইসলামীয়া এমদাদুল উলুম মাদ্রাসার মাইক থেকেই হামলার আহ্বান জানানোর পর দুপুর ২টা থেকে আড়াইটার মধ্যে দক্ষিণ পাড়ায় হামলা হয়। প্রায় আধাঘন্টাব্যাপী এই হামলায় অংশগ্রহণ নেয় আড়াই থেকে তিন হাজার মানুষ।
হামলার বিষয়ে ওই গ্রামের কৃষক দূর্গাপদ দাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুপুরে ক্ষেতে কাজ করছিলাম। হঠাৎ দেখলাম, চান্দের চর বাজার থেকে একদল মানুষ মিছিল করে আসছে। তাদের সবার হাতে লাঠিসোটা ছিল। অধিকাংশের পরণে ছিল পাঞ্জাবী, পাজামা ও টুপি।”
দুর্গাপদ দাস জানান, হামলা পরপরই তিনি বাড়ির দিকে ছুটে যান এবং পথে যাকেই পেয়েছেন তাকেই এই সংবাদ দিয়েছেন। এরপর হিন্দুপাড়ার লোকজন কেউ ধানক্ষেতে, কেউ বা গ্রামের মুসলমানদের পাড়ায় আত্মগোপন করেন।
হামলার প্রত্যক্ষদর্শী নির্মল দাস বলেন, প্রথমে গ্রামে ঢোকে পরনে পাজামা, পাঞ্জাবী ও টুপি পরা ১০ থেকে ১৩ বছর বয়সী শিশুরা, যাদের সবার হাতেই লাঠিসোটা ছিল। পাড়ায় ঢুকে প্রথমেই তাদের লক্ষবস্তু হয় মন্দিরটি।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শিশুরা যখন মন্দির ভাঙচুর করছিল ওই সময়ই পাড়ায় ঢোকে একই পোশাকধারী বয়স্কদের একটি দল। তাদের লক্ষ্যবস্তু ছিল হিন্দুদের বসতবাড়ি। বাড়িতে মূল্যবান কিছু পেলে তারা লুটে নিয়েছে; আসবাবপত্র ও বাড়িঘর ভাংচুর করেছে।”
হামলাকারীদের সংখ্যা ও পোশাক সম্পর্কে গ্রামবাসীদের বক্তব্যের সত্যতা স্বীকার করে হোমনা থানার ওসি আসলাম শিকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জোহরের নামাজের পর তারা হামলা করে। হামলাকারীদের বেশিরভাগই ছিল রামপুর ও আশপাশের মাদ্রাসার শিক্ষক এবং ছাত্র।”
হোমনা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে চান্দের চর বাজার। সেখান চান্দের চর থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার পায়ে হাঁটাপথ পেরিয়ে বাঘসীতারামপুর গ্রামের দক্ষিণ পাড়ায় ৪৭টি হিন্দু পরিবারের বাস। এই পাড়ার অধিকাংশের পেশা কৃষি, কয়েকঘর রয়েছে জেলে। পুরো হিন্দুপল্লীতে মন্দির ছাড়া অধিকাংশ বাড়িই মাটি ও টিনের তৈরি।
হামলার ক্ষতিগ্রস্ত মন্টি রানী দাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ২৫ বৈশাখ তার বিয়ের তারিখ ঠিক ছিল। বিয়ের জন্য তারা বাবা বিশ হাজার টাকা ও দুই ভরি স্বর্ণ জোগাড় করেছিলেন। রোববারের হামলায় তা লুটে নেওয়া হয়েছে।
নারায়ন দাস বলেন, চাকরির জন্য ছেলেকে বিদেশে পাঠাতে চাষের জমি বিক্রি করে তিনি একলাখ টাকা বাড়িতে রেখেছিলেন। এই টাকাও লুটে নিয়েছে মৌলবাদীরা।
বুধবার দক্ষিণ পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ ঘর ভাঙাচোরা, জিনিসপত্র ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। পাড়ার একমাত্র মন্দিরটির বিগ্রহ ভেঙে ফেলেছে হামলাকারীরা, তছনছ করেছে পূজার সামগ্রীগুলোও।
পাড়ার বৃদ্ধ জেলে পরাণ দাস বলেন, “আমার জীবনে আমি কখনো এই গ্রাম বা আশপাশের এলাকায় এধরনের হামলা দেখিনি। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সময়ও আমাদের পাড়ায় কিছু হয়নি।”
মাদ্রাসায় তালা, ছাত্র-শিক্ষকরা আত্মগোপনে
যেই মাদ্রাসার মাইক থেকে হামলার আহ্বান জানানো হয়, সেই জামিয়া আরাবিয়া ইসলামীয়া এমদাদুল উলুম মাদ্রসার অবস্থান বাঘসীতারামপুর গ্রাম থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে রামপুর গ্রামে।
বুধবার এই মাদ্রাসায় গিয়ে সবগুলো ঘর তালাবদ্ধ দেখতে পাওয়া গেছে; আশপাশে কোনো দারোয়ান বা কর্মচারীকে দেখা যায়নি।
এসময় মাদ্রাসার আশে পাশে কিছু লোকজনকে ইতস্তত ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। মাদ্রাসার বিষয়ে তারা কেউ-ই কথা বলতে চাননি।
তবে রামপুর গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রোববারের পর থেকেই এই মাদ্রাসাটি বন্ধ আছে। মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্ররা কোথায় আছেন সে বিষয়ে কেউ মুখ খুলতে রাজি হননি।
একজন গ্রামবাসী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মাদ্রাসার বড় হুজুর, ছোট হুজুর এবং ছাত্ররা এই গ্রাম ও তার আশপাশের গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে আত্মগোপন করে আছেন।