আশরাফ-মুঈনুদ্দীনই বাবার অপহরণকারী: মুনীর চৌধুরীর ছেলে

একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে অপহরণকারীদের মধ্যে চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান ছিলেন বলে ট্রাইব্যুনালে জানিয়েছেন তার ছেলে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 July 2013, 02:52 PM
Updated : 19 July 2013, 05:59 AM

বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ বৃহস্পতিবার জবানবন্দি দেন প্রসিকিউশনের দ্বিতীয় সাক্ষী আসিফ মুনীর চৌধুরী তন্ময়।

তিনি বলেন, “১৯৭২ সালে সে সময়ের পত্রিকা পূর্বদেশ দেখে আমার চাচা, মা, ভাই নিশ্চিত হন আল-বদর বাহিনীর অপরেশন-ইন-চার্জ চৌধুরী মুঈনউদ্দীন এবং চিফ এক্সিকিউটর আশরাফুজ্জামান আমার বাবাসহ অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ, গুম এবং পরবর্তীতে হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলো। পত্রিকায় ছবি দেখে আমার রুশো কাকা চিনতে পারেন যে, ৩/৪ তরুণের মধ্যে এই দুইজন আমার বাবাকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল।”    

মঙ্গলবার সাক্ষ্য দেয়া শুরু করেন আসিফ মুনীর। তবে বুধবার জামায়াতে ইসলামী নেতা মুজাহিদের মামলার রায় ঘোষণার তারিখ থাকায় সাক্ষ্য নেয়া অসমাপ্ত রেখেই মামলার কার্যক্রম মুলতবি রাখে ট্রাইব্যুনাল।

সাক্ষ্যে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনার বর্ণনা দেন তিনি। ঘটনার সময় তার বয়স ছিলো চার।

জবানবন্দিতে তিনি জানিয়েছেন তার বাবাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা মা, মেজো ভাই মিশুক মুনীর এবং রুশো কাকার কাছে শুনেছেন।

আসিফ মুনীর বলেন, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বেলা ১টার দিকে জানালায় কাদামাখানো এবং ছাদে গাছের ডালপালা দিয়ে ঢাকা একটি মিনিবাসে করে তিন/চারজন তরুণ এসে হাতিরপুলের সেন্ট্রাল রোডে তার দাদার বাড়ির লোহার গেইটে ধাক্কা দেয়।

“আমার চাচা শমসের চৌধুরী রুশো গেইটের দিকে এগিয়ে গেলে উনাকে তারা প্রশ্ন করে, ‘আপনি কি মুনীর চৌধুরী’। তিনি বলেন, মুনীর চৌধুরী আমার বড় ভাই। তারা তখন বাবাকে ডেকে দিতে বলে।”

“তিনি দোতলায় গিয়ে বাবাকে খবর দিলে বাবা লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরা অবস্থায় কাকাকে নিয়ে নিচে নামেন। বাবা ও কাকার সঙ্গে আমার মাও নিচে নেমে আসেন।”

“কাকা গেইটের তালা খুলে দিলে বাবা ওই যুবকদের জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমরা কী চাও?’ ওই যুবকরা তাকে বলে, ‘স্যার আমাদের সঙ্গে আপনাকে যেতে হবে’। তখন বাবা তাদের জিজ্ঞেস করেন ‘তোমাদের কাছে ওয়ারেন্ট আছে?’। তখন তাদের মধ্য থেকে একজন ‘আছে’ বলেই বাবার পেছনে বন্দুক ধরে।

“তখন আমার বাবা কাকার দিকে তাকিয়ে শুধু বলেছিলেন, ‘রুশো, তাহলে যাই”। ওরাই আমার বাবাকে ঠেলে গাড়ির দিকে নিয়ে যায়। বাবাকে আমাদের সেই শেষ দেখা।”

একাত্তরে চার বছর বয়সি আসিফ মুনীর বলেন, তার মেজো ভাই মিশুক মুনীর কাকার হাতে গেইটের চাবি দিয়ে উপরে এসে লুকিয়ে পুরো ঘটনাটি দেখেছিলেন।

২০১১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন মিশুক মুনীর। তিনিও এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে জবানবন্দি দিয়েছিলেন বলেও জানান আসিফ মুনীর।

আসিফ মুনীর বলেন, ১৬ ডিসেম্বরের পরে মিরপুর ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে অনেক বুদ্ধিজীবীর লাশ পড়ে আছে জানতে পেরে রুশো কাকা ও বড় চাচা অধ্যাপক কবীর চৌধুরী রায়েরবাজারে তার বাবাকে খুঁজতে যান। তবে সেখানে পড়ে থাকা বিকৃত, আধা বিকৃত বুদ্ধিজীবীদের লাশগুলোর মধ্যে তার বাবার লাশ সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।

পরবর্তীতে তারা জানতে পারেন, ১০ থেকে ১৩ ডিসেম্বরের মধ্যে সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, নিজামুদ্দীন আহমেদসহ বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে অপহরণ করা হয়।

এছাড়া ১৪ ডিসেম্বর শহীদুল্লাহ কায়সার, অধ্যাপক আবুল খায়ের, অধ্যাপক মুনিরুজ্জামান, ডাক্তার মর্তুজা, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক রাশেদুল হাসানসহ আরো অনেক বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়।

“পরবর্তীতে বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করতে সুনির্দিষ্ট তালিকা প্রস্তুত করে বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই তালিকার একটি কপি ‘জল্লাদের ডায়েরি’ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ওই ডায়েরির পাতায় অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীসহ বেশ কিছু বুদ্ধিজীবীর নাম ছিল।”

আসিফ মুনীর জানান, পরবর্তীতে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে ঘাতকের গুলি থেকে প্রাণে বেঁচে আসা দেলোয়ার নামের একজনের সঙ্গে তার দেখা হয়। ওই লোকের কাছে তিনি জানতে পারেন, ৪ ডিসেম্বর তাকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাকে মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে অনেক বন্দির সঙ্গে রাখা হয়েছিল। সেখানে তিনি বার বার মুনীর চৌধুরী ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর নাম উচ্চারিত হতে শুনেন এবং তাদের নির্মম নির্যাতনের দৃশ্য দেখেন।

চৌধুরী মাঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান

“বিভিন্ন সময়ে আমরা আরো জেনেছি, শহীদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে চিনতে পেরেছিলেন এবং তার নামও উচ্চারণ করেছিলেন।”

সাক্ষ্য শেষে আসিফ মুনীরকে জেরা করেন আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আব্দুস শুকুর খান ও সালমা হাই টুনি।

গত ২৪ জুন এই দুই ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করা হয়।

এর আগে গত ৪ জুন বিদেশে অবস্থানরত এই দুই ব্যক্তির অনুপস্থিতিতেই বিচারকাজ শুরু করার আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। এরপর ১৬ জুন তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি হয়।

গত ২ মে আশরাফুজ্জামান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল। সম্ভাব্য ঠিকানায় তাদের পাওয়া যায়নি বলে প্রসিকিউশন বিভাগ জানানোর পর ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারকে দুটি জাতীয় দৈনিকে এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে বলা হয়।

বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ১০ দিনের মধ্যে আশরাফুজ্জামান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেয়া হলেও উল্লেখিত সময়ের মধ্যে তারা আদালতে হাজির না হওয়ায় তাদের অনুপস্থিতিতেই বিচারকাজ শুরুর নির্দেশ দেয়া হয়।

গত ১৫ জুলাই এ মামলার প্রথম সাক্ষী ও শহীদ অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিনের ভাগ্নি মাসুদা বানু রত্না সাক্ষ্য দেয়।

আশরাফুজ্জামান বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে এবং চৌধুরী মুঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যে রয়েছেন।

এর আগে আবুল কালাম আযাদের অনুপস্থিতিতেই বিচার হয় এবং যুদ্ধাপরাধের দায়ে তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়েছে।

গত ২৫ এপ্রিল তদন্ত প্রতিবেদন জমা হওয়ার পর ২৮ এপ্রিল আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল।

আনুষ্ঠানিক অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করে দেয়ার নীলনকশা অনুযায়ী স্বাধীনতার ঠিক আগে ১৯৭১ সালের ১১ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত আলবদর বাহিনীর চিফ এক্সিকিউটর ছিলেন আশরাফুজ্জামান খান। চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ছিলেন সেই পরিকল্পনার অপারেশন ইনচার্জ।

তারা দুজনেই জামায়াতে ইসলামীর তখনকার সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা ছিলেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে সক্রিয় অবস্থান নেন।

আশরাফুজ্জামানের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের বেজড়া ভাটরা (চিলেরপাড়) গ্রামে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত করেন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তা মো. শাহজাহান কবীর। চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের বাড়ি ফেনীর দাগনভুঞার চানপুরে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত করেন মো. আতাউর রহমান।