হেফাজতে ইসলাম কর্মীদের দেয়া আগুনে আয়ের একমাত্র অবলম্বন দোকানটি হারিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন পল্টন ও বায়তুল মোকাররম এলাকার ফুটপাতের হকাররা।
Published : 07 May 2013, 07:51 AM
পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন পাঁচ শতাধিক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। নতুন করে আবার দোকান করার সঙ্গতিও নেই তাদের অধিকাংশেরই।
রোববার ঢাকা অবরোধ শেষে মতিঝিলে সমাবেশে যোগ দিতে আসা হেফাজতের কর্মীরা নির্বিচারে আগুন দেয় পল্টন মোড় থেকে দৈনিক বাংলা হয়ে মতিঝিলের ফুটপাতের দোকানে। বায়তুল মোকাররমের তিন দিকের ফুটপাতের দোকানগুলোও পুড়ে ছাই হয় তাদের আগুনে।
তাদের কয়েক ঘণ্টার ধ্বংসযজ্ঞে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির ভবন, হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন, ওই ভবনে থাকা জনতা ব্যাংকের শাখা, বায়তুল মোকাররম মার্কেটের বেশ কয়েকটি জুয়েলারি দোকানও হয় ক্ষতিগ্রস্ত।
চোখের সামনেই জীবিকার একমাত্র অবলম্বন ফুটপাতের দোকানটি পুড়ে যেতে দেখেছেন অনেক হকার। অসহায়ভাবে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না তাদের। দোকান হারিয়ে পরিবার নিয়ে টিকে থাকার অনিশ্চয়তার কথা উঠে এসেছে তাদের কথায়।
সোমবার ধ্বংসস্তূপের সামনে কথা হয় বায়তুল মোকাররম মসজিদ সংলগ্ন ফুটপাতের হকার হাফেজ মো. তৈয়বুর রহমান।
১৯৮৯ সাল থেকে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ পাশের ফুটপাতে জায়নামায, তসবি আর আতরের দোকান করছিলেন বলে জানান তৈয়ব।
তিনি বলেন, এমনিতে তার দোকানে নিয়মিতই দুই লাখ টাকার মালামাল মজুদ থাকত। আসন্ন শবেবরাত উপলক্ষে দোকানে বাড়তি এক লাখ টাকার মাল তুলেছিলেন তিনি।
মা, বাবা, ভাই, স্ত্রী ও দুই ছেলে নিয়ে ছয় জনের পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী তৈয়বুর রহমান জানান, তার কোনো সঞ্চয় নেই। ফুটপাতের কয়েকজন হকারের কাছে কিছু টাকা পেতেন। কিন্তু তাদের অবস্থাও একই। তাই এখন তিনি নিঃস্ব।
শুধু তৈয়ব নয়, বায়তুল মোকাররম এলাকার ফুটপাতের প্রায় সবকটি দোকানই হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা জ্বালিয়ে দেয়।
সোমবার ওই এলাকায় কিছু দূর পরপর পড়ে ছিল ছাইয়ের স্তূপ। ক্ষতিগ্রস্তদের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠেছিল চারপাশ।
তৈয়বের পাশের দোকানটি ছিল তসবি, টুপি আর আতর বিক্রেতা জাকির হোসেনের।
বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে তিনি বলেন, “১৭-১৮ বছর ধরে এখানে ব্যবসা করছি। আমার দোকানে প্রায় আড়াই লাখ টাকার মাল ছিল, সব শেষ।”
মিরপুর ১-এ স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে থাকেন তিনি। দোকান থেকে মাসে আয় হতো ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা, তাই দিয়ে কোনরকমে চলতো তার সংসার।
একই অবস্থায় পড়েছেন আব্দুর রশিদ। ফুটপাতে কোরআন, হাদিস ও ইসলামিক বইপত্র বিক্রি করে সংসার চালাতেন তিনি। পুড়ে যাওয়া দোকানের সামনে স্তূপ হয়ে পড়েছিল আধপোড়া, ছেঁড়া-খোড়া বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক বইয়ের ধ্বংসাবশেষ।
তিনি বলেন, আগুনে বেশিরভাগ বই-ই পুড়ে গেছে। অল্প যে কয়েকটা বাঁচাতে পেরেছেন সেগুলোও সব নষ্ট হয়ে গেছে।
এই দোকান থেকেই যা আয় হতো তাই দিয়েই কোনরকমে সংসার চালাতেন বলে জানান রশিদ।
কাছাকাছি দোকানের হকার নুরুল আমিন জানান, বায়তুল মোকররম মসজিদের দক্ষিণ গেট ঘেঁষে ফুটপাতের দুই পাশে কোরআন, হাদিস, তসবি, টুপি, জায়নামায, আতর প্রভৃতির প্রায় ৭০ থেকে ৮০টির মত দোকান ছিল। রোববার মাগরিবের আযানের পর সবগুলো দোকানে আগুন দেয়া হয়।
তিনি বলেন, “বেলা ১২ টার দিকেই পুলিশ আমাদের সরে যেতে বলেছিল। দোকান বন্ধ করে আশেপাশেই ছিলাম। মাগরিবের পর যখন আমাদের দোকানগুলো পোড়ানো হল তখনও আমারা আশপাশেই ছিলাম। চোখের সামনেই দেখেছি সব।”
বায়তুল মোকাররমের পশ্চিমপাশে পুড়েছে প্রায় দেড়শ’ দোকান।
এরকমই পুড়ে যাওয়া একটি দোকানের মালিক ফজলুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডকটমকে বলেন, “সকাল সাড়ে ১০টায় পরিস্থিতি খারাপ দেখে দোকান বন্ধ করি। তারপর আবার আড়াইটায় এসে দোকান খোলার চেষ্টা করলে নিরাপত্তার কারণে পুলিশ বাঁধা দেয়।”
যারা পুড়িয়েছে তাদের পোশাক কেমন ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, “অনেকের মাথায় পাগড়ি ও লম্বা জামা ছিল।আবার তাদের মধ্যে গেঞ্জি(টিশার্ট), জিন্সপ্যান্ট পরাও ছিল বেশ কয়েকজন।”
একই কথা বলেন মো. দুলাল, শাহজাহান মিয়া, খালেকুজ্জামান ও আকবর আলীসহ অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত হকাররা।
তিনি বলেন, “ব্যবসার কাজে মাল্টিপার্পাস ব্যাংক থেকে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা লোন নিয়েছিলাম। দোকান পুড়ে যাওয়ার পর এখন কিভাবে লোন শোধ করবো জানি না।”
ফুটপাতের দোকানের সঙ্গে হেফাজতের আগুনে পুরোপুরি পুড়ে গেছে ছয়টি জুয়েলারির দোকান। আর পুরোপুরি না পুড়লেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৪০টি গহনার দোকান।
এ বিষয়ে বায়তুল মোকাররম দোকান মালিক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক হাজি ইকবাল উদ্দিন বলেন, “বায়তুল মোকাররম ঘিরে প্রায় সাতশ’র মতো দোকান রয়েছে। এগুলো সবই হকারদের দোকান। হেফাজতের অগ্নিসংযোগে সাড়ে তিনশ” থেকে চারশ’টি দোকান সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। কোনো কোনো হকারের দোকানে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার মালামাল ছিল- এখন কিছুই নেই।”
রোববার এই ধ্বংসযজ্ঞে কেবল এই মার্কেটেই প্রায় ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।