‘কুরআন-হাদিস দেখেও আগুন দিয়েছে তারা’

সোমবার সকাল সাড়ে ১১টা। পল্টন মোড় থেকে কমরেড মনি সিংহ সড়ক দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চোখ পড়লো পাশের ফুটপাতে, যেখানে একটু পরপরই ছড়িয়ে রয়েছে ছাইয়ের গাদা।

রিয়াজুল বাশার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 May 2013, 05:35 AM
Updated : 6 May 2013, 11:03 PM

অথচ রোববার দুপুর পর্যন্ত এখানেই ছিল সারি সারি বইয়ের দোকান, যেখানে বিক্রি হতো পুরনো বই। হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের তাণ্ডবে মনি সিংহ সড়কে কয়েক দশকের পুরনো প্রায় ৪০টি বইয়ের দোকান আর হাজার হাজার বই এখন ছাইভষ্মে পরিণত হয়েছে।

একই অবস্থা রাস্তার উল্টো পাশের ফুটপাতে ওভারব্রিজের নিচের বইয়ের দোকানগুলোরও, ছাই ছাড়া এখন আর কিছুই নেই সেখানে।

বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের দক্ষিণ ফটকে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে প্রায় ১১টি দোকান, যেখানে কুরআন-হাদিসসহ ধর্মীয় পুস্তকই বিক্রি হতো। এখন রাস্তার ওপর স্তূপাকারে পড়ে পড়েছে পুড়ে যাওয়া হাজার হাজার কুরআন-হাদিসের অংশবিশেষ।

বিক্রেতারা জানায়, হেফাজতকর্মীরা রোববার পুড়িয়ে দেয় প্রায় ৫৫টি বইয়ের দোকান। এর ফলে ৫০ হাজারেরও বেশি বইপত্র পুড়ে গেছে বলে দাবি করেছেন তারা, যার আনুমানিক মূল্য কোটি টাকার ওপরে।

ইসলামের ‘হেফাজতের’ কথা বলে কুরআন-হাদিস গ্রন্থ পুড়িয়ে দেয়ায় ঘটনাস্থলে উপস্থিত জনতা ধিক্কার জানাচ্ছেন হেফাজতিদের।

নাস্তিক ব্লগারদের বিচার ও নারী নীতি বাতিলের দাবিতে রোববার ঢাকা অবরোধ করে হেফাজতে ইসলাম, যার পেছনে জামায়াতে ইসলামীর মদদ রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

অবরোধ চলাকালে রাজধানীর পল্টন, দৈনিক বাংলা, বিজয়নগর, মতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকায় তাণ্ডব চালায় হেফাজতকর্মীরা। এসময় অসংখ্য দোকানপাটসহ সরকারি ভবন, দমকলের অফিস, কমিউনিস্ট পার্টির ভবনে আগুন দেয়া হয়।

মনি সিংহ সড়কের ফুটপাতে প্রায় ৩০ বছর ধরে ব্যবসা চালানো আব্দুল মতিনকে পাওয়া যায় ছাই হয়ে যাওয়া বইয়ের স্তূপের পাশে।

রোববারের তাণ্ডবের বর্ণনা দিয়ে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দুপুরের নামাজের পর পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধে হেফাজতকর্মীদের। এরপর তারা হঠাৎ করেই বইয়ের দোকানগুলোতে আগুন দিতে শুরু করে।

“দোকান থেকে অনেক বই রাস্তার ওপরে নিয়ে সেখানেও আগুন দেয় তারা। কুরআন-হাদিস দেখেও তারা আগুন দিয়েছে।”

মতিন জানান, তার দোকানে আড়াই থেকে তিন হাজার বই ও পত্রপত্রিকা ছিল, যার আনুমানিক মূল্য ২ লাখ টাকার ওপরে।

মনি সিংহ সড়কের ফুটপাতের আরেক পুস্তক বিক্রেতা উৎপল রায়ের দোকানের সমস্ত বই ও পত্র-পত্রিকা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

১৯৮৮ সাল থেকে বই বিক্রি করে আসা এই ব্যক্তি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “আমার একমাত্র আয়ের উৎস ছিলো এই বইয়ের দোকান। প্রায় ১০ হাজার বই ও পত্র-পত্রিকা ছিলো আমার দোকানে, সব এখন ভষ্ম।”

উৎপল জানান, মনি সিংহ সড়কের ফুটপাতে মোট ৩৭টি পুরনো বইয়ের দোকান ছিলো। প্রতিটি দোকানে গড়ে দেড় থেকে দুই হাজার বই ও পত্রপত্রিকা ছিল। প্রত্যেকটি দোকানেই আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। 

মনি সিংহ-ফরহাদ স্মৃতি ট্রাস্ট ভবনের উল্টোদিকে বায়তুল মোকাররম মার্কেটের সামনের ফুটপাতে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে চার থেকে পাঁচটি পত্রিকার দোকান।

বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ ফটকে কুরআন-হাদিস বিক্রির ১১টি দোকান পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, যেখানে থাকা অধিকাংশ ধর্মগ্রন্থই পুড়ে গেছে।

বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ ফটকের বই বিক্রেতা আবদুল কাদির মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিলেন ধ্বংসস্তূপের পাশেই। মলিনমুখে তিনি জানালেন তাণ্ডবের ঘটনা।

আগুন জ্বলছে বইয়ের দোকানে।

হেফাজতকর্মীরা প্রথমে সিপিবি কার্যালয়ের সামনের দোকানগুলোতে আগুন দেয়। পরে দেয়া হয় বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ ফটকের দোকানগুলোতে।  

কাদির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আসরের নামাজের পরপরই মসজিদের ভেতরে থাকা হেফাজতের কর্মীরা বইয়ের দোকানগুলোতে আগুন দেয়।

“আমাদের এখানে প্রায় সব বই কুরআন-হাদিস, বাকিগুলোও ইসলাম ধর্মীয় পুস্তক। তারপরও এসব বই পুড়িয়ে দিতে একটু বাধলো না তাদের!”

কাদির জানান, সেখানে ১১টি দোকানে কমপক্ষে ১৫ হাজার কুরআন-হাদিস ছিলো, যার অধিকাংশই পুড়ে গেছে।

দক্ষিণ ফটকে আরো ১৮টি টুপির দোকান এবং ছয়টি তসবিহ ও আতরের দোকানও পোড়ানো হয়েছে বলে জানান দোকানিরা।

দক্ষিণ ফটকে পুড়ে যাওয়া বইয়ের দোকানগুলোর পাশেই দাঁড়িয়ে আবদুল ওয়াদুদ নামে মাঝবয়সী এক ব্যবসায়ী বলেন, “এরা ধর্মের নামে স্লোগান দিয়ে বই পুড়িয়ে দিলো। নিজের ধর্মগ্রন্থ পোড়াতেও পিছপা হলো না। এরা ইসলামের শত্রু, মানবতারও শত্রু।”