মোকাররম হোসেন শুভ
বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিবেদক
ঢাকা, জুলাই ১০ (বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম)- ২০০৩ সালে দুই স্ট্রোক ইঞ্জিনের অটোরিক্সা (বেবিট্যাক্সি) বন্ধ করে দেওয়ার পর ঢাকার বায়ুদূষণ এক তৃতীয়াংশ কমলেও সাড়ে তিন বছরের মাথায় আবার আগের অবস্থা ফিরে এসেছে বলে জানিয়েছেন একজন পরিবেশ কর্মকর্তা।
পরিবেশ অধিদপ্তরের এক জরিপের বরাত দিয়ে ওই কর্মকর্তা বলছেন, গত সাড়ে তিন বছরে ঢাকার রাস্তায় ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল বেড়ে যাওয়ায় দূষণের মাত্রা আবার আগের পর্যায়ে পৌছেছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজম্যান্ট প্রজেক্টের পরিচালক ড. নাসির উদ্দিন বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দুই স্ট্রোকের অটোরিক্সা বন্ধ করার পর দূষণ এক তৃতীয়াংশ কমে এসেছিল। এখন অবস্থা প্রায় আগের পর্যায়ে চলে গেছে। বিস্তারিত জানাচ্ছেন মোকাররম হোসেন।
তিনি জানান, যানবাহনে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরণের জ্বালনি তেল পুড়ে কার্বন কণা তৈরি হয়। যানবাহনের ধোঁয়ার সঙ্গে বের হওয়া এই কার্বন কণার সঙ্গে তেল ও গ্যাস মিশে তৈরি হয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বস্তুকণা। এগুলোকে বলা হয় পার্টিকুলেট মেটার (পিএম) বা ভাসমান বস্তুকণা। বাতাসে ভেসে বেড়ানো ২.৫ মাইক্রোগ্রাম ওজনের এসব বস্তুকণা শ্বাসবায়ুর মাধ্যমে সরাসরি মানুষের রক্তের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। এতে ক্যান্সারের মতো জটিল রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায় বলে জানান তিনি।
ঢাকার বাতাসে দূষণমাত্রা ভয়াবহ পর্যানোর পর ২০০৩ সালের জানুয়ারি মাসে সরকার ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় ৫০ হাজারের বেশি দুই স্ট্রোক অটোরিক্সা নিষিদ্ধ করে। এর এক সপ্তাহ পর পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিমাপে দেখা যায়, দুষণের মাত্রা প্রায় এক তৃতীয়াংশ কমে এসেছে।
দুই স্ট্রোক বেবিট্যাক্সি বন্ধের পর দূষণ কমে যাওয়ায় তখন জনস্বাস্থ্যের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিল এমন মন্তব্য করে বিশ্বব্যাংকের এক মূল্যায়নে বলা হয়, দুই স্ট্রোক অটোরিক্সা নিষিদ্ধ করায় জনগণের চিকিৎসা বাবদ প্রায় আড়াই কোটি ডলার সাশ্রয় হয়েছে। দূষণ আরো কমানো গেলে আট কোটি অসুস্থতার ঘটনা এড়ানো যাবে। মাতৃগর্ভে শিশু মৃত্যুর হার লাখে ১৫শ থেকে ১২শতে নেমে আসবে। এতে স্বাস্থ্য ব্যয় কমবে ১৬৯ মিলিয়ন ডলার।
এদিকে দুই স্ট্রোক অটোরিক্সা নিষিদ্ধ করার পর চাহিদা পূরণ করতে বিপুল সংখ্যক পুরনো বাস, মিনিবাস, হিউম্যান হলার ও পুরনো প্রযুক্তির যানবাহন ঢাকার রাস্তায় চলাচল শুরু করে। নিুমানের জ্বালানিতে চলে বলে এসব যানবাহনের দূষণের মাত্রও বেশি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের এক জরিপে দেখা গেছে ঢাকার রাস্তায় চালু এসব যানবাহনের ৭০ ভাগ এবং ট্রাকের মধ্যে ৮০ ভাগই ব্যবহারের অযোগ্য। আর এ কারণে গত সাড়ে তিন বছরে দূষণের মাত্রা বাড়তে বাড়তে ২০০৩ সালের অবস্থায় ফিরে গেছে।
২০০৩ সালে ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা ছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারণ করা সহনীয় দূষণমাত্রার চারগুণ বেশি। তখন গ্রাউন্ড লেভেল ওজন গ্যাস, কার্বন মনোক্সাইড, হাইড্রো কার্বনের মাত্রা ছিল অসহনীয়। এখন বাতাসে এসব উপাদান বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনার চেয়ে কম হলেও ভাসমান বস্তুকণার পরিমাণ বেশি। এর মূল উৎস ডিজেল চালিত পুরনো যানবাহন।
ডিজেল চালিত গাড়ি ছাড়াও ঢাকার আশপাশে সাভার ও আমিন বাজার এলাকায় এক হাজারের বেশি ইটভাটা এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দুই পাশে গড়ে ওঠা রি-রোলিং কারখানার ধোঁয়া দূষণ আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। ইট ভাটার চিমনির উচ্চতা ১২০ ফুট নির্ধারণ করে দেওয়ার পরও ঢাকার বাতাসে ইটভাটার ধোঁয়ার নেতিবাচক প্রভাব পড়ার প্রমাণ পেয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
ড. নাসির উদ্দিন বলেন, ১৯৮৩ সালের মোটরযান আইনে কালো ধোঁয়া নিগর্মনকারী গাড়ির জন্য কেবল ২০০ টাকা জরিমানা করার বিধান আছে। এই আইন আরো কঠোর করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে বিভিন্ন গাড়ির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দূষণসীমা নির্ধারণ এবং সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যক্রমে সমন্বয় আনতে হবে।
পরিবেশ আইন অনুযায়ী, ২০০৭ সাল থেকে গাড়ির ধোঁয়ার ঘনত্ব ৭০ হার্টরিজ স্মোক ইউনিট (এইচএসইউ) হওয়ার কথা। আর ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৬৫ এইচএসইউ মাত্রার গাড়িই শুধু চলাচলের অনুমতি পাবে। কিন্তু বাস্তবে এ আইন মানা হচ্ছে না। ঢাকার রাস্তার চলাচলকারী অধিকাংশ গাড়ির এইচএসইউ একশ'র বেশি। পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রত্যেকটি অভিযানে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে স্বীকার করেন।
এদিকে যানবাহনের দূষণ ঠেকাতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তায় 'ভেহিকেল ইন্সপেকশন সেন্টার' স্থাপন করা হলেও পাঁচ বছরেও তা চালু করতে পারেনি সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ। দূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরের এই কাগুজে প্রকল্প কবে নাগাদ বাস্তবায়ন হবে তাও বলতে পারেনি অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
এদিকে দূষণ বেড়ে যাওয়ায় জনস্বাস্থ্যের প্রতি হুমকিও বেড়েছে। সর্দি, কাশি, শিশু ও বৃদ্ধদের মধ্যে দূষণজনিত বিভিন্ন রোগ বেড়েছে। বিশেষ করে শীতকালে অর্থাৎ শুষ্ক মৌসুমে শিশু, বৃদ্ধ, কিশোর, বস্তিবাসী, হকার ও ট্রাফিক পুলিশের স্বাস্থ্য সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে থাকে বলে বিশেষজ্ঞরা জানান।
বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম/এমএইচএস/জেকে/জিএনএ/১২০০ ঘ.