সন্দেহভাজন এক আইএস জঙ্গির বিষয়ে তদন্ত করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দারা অর্থ পাচার ও জঙ্গি অর্থায়নের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক সম্পর্কে নতুন তথ্য পেয়েছে, যার পেছনে ছিলেন সিরিয়ায় নিহত ‘বাংলাদেশি জঙ্গি’ সাইফুল হক সুজন।
Published : 11 Aug 2017, 06:07 PM
যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে এফিডেভিট আকারে জমা দেওয়া এফবিআইয়ের একটি নথির বরাত দিয়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বৃহস্পতিবার এ খবর দিয়েছে।
পত্রিকাটি লিখেছে, দেড় বছর আগে মেরিল্যান্ডে অভিযান চালিয়ে মোহাম্মদ এলশিনাওয়ি নামের ৩০ বছর বয়সী যে সন্দেহভাজন আইএস সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেই তদন্তকারীরা জঙ্গিদের অর্থ পাচার নেটওয়ার্কের ‘ক্লু’ পান।
দীর্ঘদিন নজরদারির পর ২০১৫ সালের ১১ ডিসেম্বর এলশিনাওয়িকে গ্রেপ্তার করে এফবিআই। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে তার বিরদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বাল্টিমোরের ফেডারেল গ্র্যান্ড জুরি।
সেখানে বলা হয়, এলশিনাওয়ি ইবের মাধ্যমে কম্পিউটার প্রিন্টার বিক্রির নাটক সাজিয়ে পেইপ্যালের মাধ্যমে আইএস এর নেটওয়ার্ক থেকে অর্থ নেন। ওই অর্থ সন্ত্রাসী হামলায় ব্যবহারের পরিকল্পনা ছিল।
ফেডারেল আদালতে এফবিআইয়ের দেওয়া এফিডেভিটের বরাত দিয়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল লিখেছে, ওই পদ্ধতি ব্যবহার করে আইএস নেটওয়ার্ক যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশেও টাকা পাঠিয়েছে। আর এর পেছনে ছিলেন আইএস এর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা ‘বাংলাদেশি কম্পিউটার প্রকৌশলী’ সাইফুল হক সুজন।
আইএস এর ওই নেটওয়ার্কে যুক্ত বেশ কয়েকজন পরে যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশে গ্রেপ্তার বা নিহত হন বলে এফবিআইয়ের এফিডেভিটে উল্লেখ করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালের ১০ ডিসেম্বর সিরিয়ায় আইএস এর কথিত রাজধানী রাকার কাছে ড্রোন হামলায় নিহত হন সুজন।
যুক্তরাজ্যে কম্পিউটার প্রকৌশলে পড়াশোনা করা এই বাংলাদেশি সে সময় আইএস এর কম্পিউটার অপারেশন বিভাগের প্রধান ছিলেন বলে যুক্তরাষ্ট্রের তদন্তকারীদের ভাষ্য।
বাংলাদেশ পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, সাইফুল হক সুজনের বাড়ি খুলনার পাকুড়তিয়া গ্রামে। তার ভাই শরীফুল হক ইমন এবং দুই ভাইয়ের স্ত্রী-সন্তানরাও বেশ কয়েক বছর ধরে নিখোঁজ।
সিরিয়ায় সুজনের নিহত হওয়ার সপ্তাহ দুই আগে ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকার কারওয়ানবাজারে তার প্রতিষ্ঠান আইব্যাকস টেকনোলজিস লিমিটেডের কার্যালয় অভিযান চালায় পুলিশ।
ওই কার্যালয় থেকে সুজনের বাবা একেএম আবুল হাসনাত, ছোট ভাই হাসানুল হক ওরফে গালিব মাহমুদসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে জঙ্গি অর্থায়নে সহযোগিতার অভিযোগে মামলা করা হয়।
তেজগাঁও থানার ওই মামলার এজাহারে বলা হয়, গ্রেপ্তার ওই পাঁচজন জঙ্গি সংগঠনের সদস্য বা সমর্থক। বিদেশে থাকা সুজন ও তার ভাই ‘জিহাদি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য’ আইব্যাকসের মাধ্যমে তাদের টাকা পাঠিয়ে আসছিলেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সুজনের বাবা কারাগারে থাকা অবস্থায় কিছুদিন আগে মারা গেছেন। আর সুজনের ভাই বর্তমানে জামিনে রয়েছেন।
অ্যাপ ও ওয়েবসাইট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান আইব্যাকস টেকনোলজিসের মূল কার্যক্রম চলত যুক্তরাজ্যের কার্ডিফ থেকে। বাংলাদেশ ছাড়াও ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়া, জর্ডান, তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রে এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা ছিল। ওই ব্যবসার আড়ালে সুজন অর্থ পাচারে যুক্ত ছিলেন বলে তদন্তকারীদের ভাষ্য।
আইব্যাকসের মাধ্যমে সুজন কয়েক লাখ পাউন্ড ঢাকা হয়ে সিরিয়ায় পাঠিয়েছিলেন বলে সে সময় ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের বরাত দিয়ে জানিয়েছিল যুক্তরাজ্যের সংবাদপত্রগুলো।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এবার লিখেছে, ওয়েবসাইট তৈরি করে দেওয়া পাশাপাশি ‘প্রিন্টার কনফিগার করে দেওয়ার কাজও’ করত সুজনের কোম্পানি। কিন্তু ওই কোম্পানির নামে ১৮ হাজার ডলারে একটি কানাডীয় প্রতিষ্ঠান থেকে মিলিটারি গ্রেড সার্ভেইলেন্স ইকুইপমেন্ট কেনা হয়েছিল বলে তথ্য পেয়েছেন এফবিআইয়ের তদন্তকারীরা।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের একটি কোম্পানিতে তারা আড়িপাতা সরঞ্জাম খুঁজে বের করার যন্ত্রপাতি কেনার অর্ডার দিয়েছিল, যা পাঠানোর কথা ছিল তুরস্কে।
এফবিআইয়ের এফিডেভিটে বলা হয়েছে, আইএস এর এই নেটওয়ার্ক থেকে মোট ৮৭০০ ডলার পেয়েছিলেন মোহাম্মদ এলশিনাওয়ি। এর মধ্যে পেইপ্যালের মাধ্যমে পাঁচটি পেমেন্ট তিনি পেয়েছিলেন সুজনের কোম্পানির কাছ থেকে।
এফবিআইএর তথ্য অনুযায়ী, এলশিনাওয়ি ওই অর্থ একটি ল্যাপটপ একটি সেল ফোন ও ভিপিএন কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক কেনার পেছনে খরচ করেন। আইএস নেটওয়ার্কে যোগাযোগের জন্য ওইসব যন্ত্রপাতি তিনি ব্যবহার করতেন।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনে বলা হয়, আইএস নেটওয়ার্কের দেওয়া অর্থ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা চালানোর পরিকল্পনার কথা জানতেন বলে এফবিআইয়ের কাছে স্বীকার করেছেন এলশিনাওয়ি। তবে তিনি নিজে কোনো হামলা পরিকল্পনায় জড়িত ছিলেন না বলে জিজ্ঞাসাবাদে দাবি করেছেন।