সিরিয়ায় নিহত সুজনের স্ত্রী-তার বোন নিখোঁজ

জঙ্গি হামলার প্রেক্ষাপটে ঘরছাড়া অর্ধ-শতাধিকের তথ্য আসার পর গোপালগঞ্জের দুই বোনের নিখোঁজের খবর পাওয়া গেছে, যাদের একজনের স্বামী সিরিয়ায় আইএসবিরোধী হামলায় নিহত হয়েছেন।

লিটন হায়দারও গোলাম মুজতবা ধ্রুববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 August 2016, 04:17 PM
Updated : 4 August 2016, 06:16 AM

গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ার ডুমুরিয়া ইউনিয়নের করফা গ্রামের প্রয়াত ছোলেমান শেখের মেয়ে সায়মা আক্তার মুক্তা ও রাবেয়া আক্তার টুম্পা স্বামী-সন্তানসহ কয়েক বছর ধরে নিখোঁজ বলে সরকারের একটি উচ্চ পর্যায়ের সূত্র জানিয়েছে।

মুক্তা ও টুম্পার বিয়ে হয়েছিল খুলনার পাকুড়তিয়া গ্রামের একেএম আবুল হাসনাতের দুই ছেলে সাইফুল হক সুজন ও শরীফুল হক ইমনের সঙ্গে।

এদের মধ্যে মুক্তার স্বামী সুজন ২০১৫ সালে সিরিয়ায় আইএসের আস্তানায় বিমান হামলায় নিহত হন বলে টুঙ্গীপাড়া থানার ওসি মো. মাহমুদুল হক জানিয়েছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মুক্তার স্বামী সাইফুল হক সুজন সিরিয়ায় আইএস বিরোধী হামলায় ২০১৫ সালের দিকে মারা যান। ওই সময় তিনি আইএস ঘাঁটিতে ছিলেন।”

এ ঘটনার পর জঙ্গি অর্থায়নে সহযোগিতার অভিযোগে ঢাকার কারওয়ানবাজার থেকে সুজন-ইমনের বাবা হাসনাতকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ।

তিনি এখনও কারাগারে আছেন বলে ওসি মাহমুদুল জানিয়েছেন।

সায়মা আক্তার মুক্তা

মুক্তা ও টুম্পার সঙ্গে টুঙ্গীপাড়ায় তাদের বাবার বাড়ি করফা এবং শ্বশুরবাড়ি খুলনার পাকুড়তিয়া গ্রামের কোনো যোগাযোগ নেই বলে এই পুলিশ কর্মকর্তা জানান।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সুজনের সর্বশেষ বাসার ঠিকানা ছিল খুলনার ইকবাল নগর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দক্ষিণ পাশে এবং ইমনের সর্বশেষ ঠিকানা ছিল ঢাকার মিরপুরে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের ১ নম্বর গেটের পাশে।

তবে ওই এলাকায় গিয়ে খোঁজ করেও দুজনের কোনো আত্মীয়-স্বজনের সন্ধান পাওয়া যায়নি।

এদিকে বুধবার মুক্তা ও টুম্পার গ্রামের বাড়ি টুঙ্গীপাড়ার করফা গ্রামে গিয়ে তাদের পরিবারের কারো সন্ধান মেলেনি।

ওই বাড়িতে তাদের দূর সম্পর্কের চাচা আসাদ শেখ ও তার স্ত্রী বিউটি বেগম সন্তানদের নিয়ে বসবাস করেন।

বিউটি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ছোলেমান শেখের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। ছোলেমান খুলনায় ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। সেখানেই তার মেয়েরা বড় হয়েছে, বিয়ে করেছে।

খুলনার পাকুড়তিয়া গ্রামের বাসিন্দা বায়জিত মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এই গ্রামের আবুল হাসনাতের ছেলে ও সাইমা আক্তার মুক্তার স্বামী সাইফুল হক সুজন গত বছর সিরিয়ায় আইএসের আস্তানায় রুশ হামলায় নিহত হয়েছিল বলে এলাকার সবাই জানে।

রাবেয়া আক্তার টুম্পা

মুক্তা ও টুম্পার বাবা ছোলেমান ১৫ বছর আগে করফায় মাদ্রাসা নির্মাণের জন্য দুই বিঘা জমি দিয়েছিলেন বলে এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা জানান।

করফা সামসুল উলুম খাদেমুল ইসলাম নামের মাদ্রসাটির পরিচালনা পর্ষদের সাধারণ সম্পাদক আবুল খায়ের হাওলাদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ছোলেমানের ছেলে মেয়েরা জঙ্গি  কি না তা নিশ্চিত নই। তবে লোকজনের কাছে শুনেছি তার এক মেয়ের জামাই সিরিয়ায় মারা গেছে।

“মুক্তা ও টুম্পা স্বামীর হাত ধরে সিরিয়ায় যেতে পারে।”

সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ওই সূত্র বলছে, এই দুই বোন তাদের স্বামীর সঙ্গে যুক্তরাজ্যে গিয়েছিলেন। পরে সেখান থেকে সিরিয়ায় যান সবাই। সেখানেই আইএসবিরোধী হামলায় মারা পড়েন সুজন।

তবে মুক্তা ও টুম্পা এখন সিরিয়া না বাংলাদেশে সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

নিখোঁজ আরও চারজন

গোপালগঞ্জের এই দুই বোনের পাশাপাশি আরও চারজনের নিখোঁজের খবর দিয়েছে সরকারি ওই সূত্র।

এরা হলেন- সাবেক সচিব মোহাম্মদ মূসা সাদিকের ছোট ছেলে সাইমুন হাছিব মোনাজ, গাজীপুরের শ্রীপুরের কেওয়াবাজার গ্রামের মৃত তৌহিদুল ইসলামের ছেলে মো. রিদওয়ান ইসলাম তুহিন, আশুলিয়ার টুঙ্গাবাড়ীর আবদুর রহমান মাসুদ এবং বগুড়ার একেএম তাকিউর রহমান।

সাইমুন হাছিব মোনাজ সাবেক সচিব মোহাম্মদ মুসা সাদিকের ছেলে।

মোনাজ দুই বছর আগে মালয়েশিয়া চলে যান বলে বনানীতে সাবেক সচিব মুসার বাসার তত্ত্বাবধায়ক ফরমান আলী জানান।

“ছেলেটা খুব ভাল ছিল, নামাজ পড়ত, মুখে হালকা দাঁড়ি ছিল। সব সময় মাথা নিচু করে চলাফেরা করত। কথা খুব কম বলত। বিয়ের সাত দিনের মাথায় সে বাসা ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তার স্ত্রী ১০/১৫ দিন পর বাসা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন,” বলেন তিনি।

বনানীর ২৩ নম্বর সড়কের ২২ নম্বর বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক ফরমান বুধবার দুপুরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এসব বলেন।

তবে মুসা এই বাসায় থাকেন না জানিয়ে তিনি বলেন, “স্যার ১৮ নম্বর রোডের ১১ নম্বর বাসায় তার দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে থাকেন। মাঝে মধ্যে এই বাসায় আসেন। এখানে তার বড় ছেলে মেহমুদ ও তার মা হোসনে আরা জয়েস থাকেন।”

হোসনে আরা এখন অসুস্থ, তাকে চার থেকে পাঁচজন গৃহপরিচারিকা দেখাশোনা করেন বলে জানান তিনি।

মোহাম্মদ মুসার সঙ্গে দেখা করতে বিকাল ৫টার দিকে বনানীর ১৮ নম্বর রোডের ১১ নম্বর বাসায় গেলে সেখানকার তত্ত্বাবধায়ক মিজানুর রহমান বলেন, “স্যারের প্রথম স্ত্রী অসুস্থ। উনি (মুসা) হাসপাতাল থেকে একটু আগে বাসায় এসেছেন।”

একজন সাংবাদিক দেখা করতে চান বলে মুসাকে ইন্টারকমে জানালে ব্যস্ত থাকায় দেখা করতে পারবেন না বলে জবাব আসে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স থেকে পাশ করা মো. রিদওয়ান ইসলাম তুহিন প্রায় দেড় বছর নিখোঁজ।

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স থেকে পাশ করা তুহিন প্রায় দেড় বছর ধরে নিখোঁজ বলে তার ছোট ভাই তানিম জানিয়েছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় তুহিন ২০১৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে কিছু দিন পর ছেড়ে দেন।

এরপর স্যামসাং মোবাইল কোম্পানির কারওয়ানবাজারের অফিসে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ নেন।

“এর মধ্যে হঠাৎ একদিন ভাইয়ের কোনো সন্ধান পাচ্ছিলাম না। তার মোবাইলও বন্ধ ছিল।”

সে সময় ভাই নিখোঁজের তথ্য জানিয়ে কলাবাগান থানায় একটি জিডি করেন বলে জানান তানিম।

নিখোঁজ আবদুর রহমান মাসুদের বিষয়ে আশুলিয়া থানা পুলিশের কাছে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। থানার কর্মকর্তারা জানান, নিখোঁজদের একটি তালিকা তৈরি করছেন তারা।

আবদুর রহমান মাসুদের সর্বশেষ ঠিকানা আশুলিয়ার টুঙ্গাবাড়ি।

একেএম তাকিউর রহমান বগুড়ার বাসিন্দা

মাসুদের ঠিকানা টুঙ্গাবাড়ির ২ নম্বর সড়কের ৩ নম্বর বাসা বলা হলেও ওই ঠিকানায় গিয়ে কোনো বাড়ির সন্ধান পাওয়া যায়নি বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সাভার প্রতিনিধি জানিয়েছেন।

নিখোঁজ বগুড়ার একেএম তাকিউর রহমানের ঠিকানা বলা হয়েছে শহরের কালিটোলার মদিনা মসজিদ সংলগ্ন আবদুল খালেকের বাড়ির নবম তলা।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের বগুড়া প্রতিনিধি জানান, বুধবার রাতে ওই বাড়িতে গিয়ে নবম তলা নির্মাণাধীন দেখা গেলেও সেখানে কাউকে পাওয়া যায়নি।

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি মনোজ সাহা, খুলনা প্রতিনিধি সুবীর রায়, সাভার প্রতিনিধি সেলিম আহমেদ ও বগুড়া প্রতিনিধি জিয়া শাহীন।]