একাত্তর সালে বাংলাদেশে গণহত্যায় জড়িত পাকিস্তানিদের বিচারের দাবি জানিয়েছেন সে দেশেরই কবি আহমদ সালিম।
Published : 26 Jul 2017, 09:02 PM
মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার এবং নৃশংসতার জন্য বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়ার ‘বোধোদয়’ যাতে পাকিস্তান সরকারের হয়, সে লক্ষ্যে কাজ করার জন্য নিজ দেশের তরুণদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
বুধবার বিকালে ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে এক বক্তৃতায় আহমদ সালিম বলেন, “পাকিস্তান সরকার এখনও অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেনি। বাংলাদেশ এখন বাস্তবতা। পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশ এখন উন্নত এবং অধিকতর সার্বভৌম। আমাদের নতুন প্রজন্ম অধিক আলোকিত, কম তমসাচ্ছন্ন।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত পাকিস্তানের দুই তরুণ লেখক আনাম জাকারিয়া ও হারুন খালিদের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এই প্রজন্মের এখন দায়িত্ব এগিয়ে আসা এবং বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার জন্য সরকারের বোধোদয় ঘটানো; যারা বাংলাদেশে গণহত্যা সংঘটিত করেছে যেন তাদের বিচার করা হয় এবং সেই সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের নিকট ক্ষমা চাওয়া হয়- এ নিয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা।”
শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ২৩তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তার নামে ‘বাংলাদেশের গণহত্যার নিন্দা ও স্বীকৃতি সচেতন পাকিস্তানিদেরও দাবি’ শীর্ষক স্মারক বক্তৃতায় এসব কথা বলেন ১৯৭১ সালে মুক্তিকামী বাঙালির পক্ষে দাঁড়ানোয় ছয় মাসের কারাদণ্ড পাওয়া এই পাঞ্জাবি কবি।
কবিতা লেখা ছাড়াও ১৯৬৬ সাল থেকে পাকিস্তানের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা জানান আহমদ সালিম। পাঞ্জাব ছাত্র ইউনিয়নের নেতা হিসাবে ১৯৭০ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় সক্রিয় থাকার কথাও বলেন তিনি।
একাত্তরের ভূমিকার জন্য ২০১২ সালে তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা জানায় বাংলাদেশ সরকার।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানে কবি আহমদ সালিম এবং ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট, ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজকে ‘জাহানারা ইমাম স্মৃতি পদক’ দেওয়া হয়।
স্মারক বক্তৃতায় আহমদ সালিম বলেন, “আমি পাকিস্তানের মুখপাত্র নই। সে দেশের সরকার কিংবা সংসদের প্রতিনিধিও নই। আমি একজন পাঞ্জাবি কবি, সেই বিনম্র যোগ্যতায় আমি বাংলাদেশের জনগণের নিকট ক্ষমাপ্রার্থী ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের দোসররা এদেশে যে গণহত্যা সংঘটিত করেছিল তার জন্য।”
বাংলাদেশ বিষয়ে অনেক পাকিস্তানির ভাবনা ইতিবাচক হলেও সরকারের অবস্থান এলোমেলো বলে মনে করেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় জেনারেল ইয়াহিয়ার অবস্থানের বিষয়ে প্রথম কবিতা ছাপানোর পরই গ্রেপ্তার হওয়ার কথা জানিয়ে তাকে কারাগারে পাঠানোর সময়ের বর্ণনা দেন কবি আহমদ সালিম।
তিনি বলেন, “আমাকে সামরিক আদালতে হাজির করা হলে বিচারক আমাকে ছয় মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। তখন আমি ম্যাজিস্ট্রেটকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনি কি নিশ্চিত যে পরবর্তী ছয় মাস আপনি ক্ষমতায় থাকবেন?’ এরপর ক্ষিপ্ত হয়ে বিচারক আমাকে পাঁচটি বেত্রাঘাত করার আদেশ শাস্তিতে যোগ করেন।
“আমাকে অন্যান্য প্রশ্নের সঙ্গে এই প্রশ্নটি করা হয়েছিল- আপনি পাঞ্জাবি হয়ে পাঞ্জাবি সেনার সমালোচনা করছেন? আমার উত্তর ছিল সোজা, যারা মানুষ হত্যা করে, তাদেরকে পাঞ্জাবি বা পাঠান বলা হয় না। ’৭১ এর অগাস্টে আমার বিচার হয়। ছয় মাস শেষ হওয়ার আগেই ১৬ ডিসেম্বরের আগমন ঘটে এবং আমার ভবিষ্যৎবাণী সত্য প্রমাণিত হয়।”
আরেক মৌলবাদবিরোধী তরুণ লেখক আনাম জাকারিয়া বলেন, “এখানে যারা গণহত্যার শিকার হয়েছে তাদের পরিবারের কষ্টটা আমরা বুঝতে পারব না। কিন্তু আমরা সেই কষ্টগুলো খোঁজার চেষ্টা করছি এবং কিছুটা অনুভব করতে চাইছি। পাকিস্তানের সরকার পর্যন্ত আমরা হয়ত সেগুলো পৌঁছে দিতে পারব না, কিন্তু সেখানকার নতুন প্রজন্মের কাছে আমরা এই কষ্টের কথাগুলো জানাব।”
একাত্তরের গণহত্যা কেবল বাংলাদেশের বিষয় নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, “কারণ এখানকার মানুষ গণহত্যার শিকার হয়েছে, আর গণহত্যা চালিয়েছে পাকিস্তান। সেক্ষেত্রে পাকিস্তানও এর অংশ।”
স্বাগত বক্তব্যে নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, “সময় এসেছে পাকিস্তনের জন্য সরকারিভাবে ক্ষমা চাওয়ার। তাদেরকে ক্ষমা চাইতে হচ্ছে নিঃশর্তভাবে। পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের যে বিচারকাজ চলছে তাতে বিরোধিতা না করে গণহত্যার বিচারে সহযোগিতা করার।”
নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা বিচারপতি শামসুল হুদার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট, ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আবদুর রশীদ, শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ছেলে তানভীর হায়দার চৌধুরী, শহীদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সারের মেয়ে শমী কায়সার বক্তব্য দেন।