তদন্ত সংস্থার আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিতর্কিত ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসেরের ‘যুদ্ধাপরাধের তথ্য’ সম্বলিত নথি হস্তান্তর করেছেন সাংবাদিক সাগর লোহানী ও প্রবীর সিকদার।
Published : 06 Apr 2017, 06:28 PM
বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকার ধানমন্ডিতে তদন্ত সংস্থার কার্যালয়ে গিয়ে জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক সানাউল হকের হাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, জনকণ্ঠ ও ঢাকা ট্রিবিউনের প্রতিবেদনসহ ২৮ পৃষ্ঠার নথি তুলে দেন তারা।
মুক্তিযুদ্ধ গবেষক সাগর লোহানী পরে সাংবাদিকদের বলেন, “আমাদের কাছে যেসব তথ্য উপাত্ত আছে, সেগুলো তদন্ত সংস্থার কাছে হস্তান্তর করেছি। উনারা গ্রহণ করেছেন। তারা আশ্বাস দিয়েছেন, এ বিষয়ে অনুসন্ধান করবেন এবং অনুসন্ধানে প্রমাণযোগ্য অপরাধ পাওয়া গেলে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করে তদন্তের উদ্যোগে নেবেন।”
নিউজ পোর্টাল উত্তরাধিকার ৭১ এর সম্পাদক প্রবীর সিকদার বলেন, তদন্ত সংস্থা শিগগিরই মুসা বিন শমসেরের যুদ্ধাপরাধের তদন্তের উদ্যোগে নেবেন বলে তারা আশা করছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উনারা যেসব ডকুমেন্টস দিয়েছেন, আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখব। সত্যতা থাকলে আমরা অবশ্যই তদন্তে যাব।”
ফরিদপুর শহরের সাধারণ একটি পরিবার থেকে রহস্যময়ভাবে ধনকুবের হয়ে ওঠা মুসাকে তার এলাকার মানুষ ‘নুলা মুসা’ নামেই চেনে। ২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর বিভিন্ন পর্যায় থেকে তার যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি ওঠে।
মুসার যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ নিয়ে অনুসন্ধানের কথা বললেও তাতে কোনো অগ্রগতির খবর দিতে পারছিল না ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। এই প্রেক্ষাপটে অভিযোগ ওঠে, প্রধানমন্ত্রীর ফুপাত ভাইয়ের বেয়াই হওয়ায় পার পেয়ে যাচ্ছেন জাঁকজমকপূর্ণ চলাফেরার জন্য বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে ‘বাংলাদেশের প্রিন্স’ হিসেবে পরিচয় পাওয়া মুসা।
গত ২১ মার্চ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে ফরিদপুরের কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা বলেন, মুসার যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ দিতে তারা ‘তৈরি আছেন’।
মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে একাত্তরে মুসা বিন শমসেরের যুদ্ধাপরাধের বিভিন্ন অভিযোগের খতিয়ানও সেখানে তুলে ধরা হয়।
ওই আহ্বানে সাড়া দিয়েই বৃহস্পতিবার নথি হস্তান্তরের কথা বলেন সাগর লোহানী ও প্রবীর সিকদার। তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খানের সঙ্গেও তারা কথা বলেন।
পরে সাগর লোহানী সাংবাদিকদের বলেন, “তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা আমাদের বলেছেন, শিগগিরই তারা এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেনে।”
প্রবীর সিকদার বলেন, “১৬ বছর আগে আমি দৈনিক জনকণ্ঠে নুলা মুসার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন করেছিলাম। সেই প্রতিবেদনের পর সে ভাড়াটে সন্ত্রাসী দিয়ে আমাকে মেরে ফেলার জন্য হামলা করে। তবে আমি প্রাণে বেঁচে যাই। সে সময় সংবাদকর্মীরা আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।
“আমি যা লিখেছি, তা যদি সত্যি না হত, তাহলে আমার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারত। সে তা না করে আমার ওপর হামলা করেছে।”
এই সাংবাদিক জানান, বিভিন্ন সময়ে দেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে মুসার যুদ্ধাপরাধ নিয়ে যেসব সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলো একীভূত করে তারা তদন্ত সংস্থাকে দিয়েছেন।
জনকণ্ঠে প্রকাশিত প্রবীর সিকদারের প্রতিবেদনে মুসা বিন শমসেরের পরিচয় তুলে ধরে বলা হয়েছে এভাবে- “এখন তার নাম প্রিন্স ড. মুসা-বিন-শমসের হলেও সার্টিফিকেটে নাম এডিএম মুসা। মুসা-বিন-শমসের কিংবা এডিএম মুসা- কোনো নামেই ফরিদপুরের মানুষ তাকে চেনে না।”
স্থানীয়দের তথ্য অনুযায়ী, বাকপটু মুসা ইংরেজি ও উর্দু কথোপকথনেও পারদর্শী। একে পুঁজি করেই তিনি একাত্তরে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলেন।
মুসা বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিমের বেয়াই। জিয়াউর রহমানের আমলে জনশক্তি রপ্তানির ব্যবসা শুরু করা মুসার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম প্রথমে ছিল শাহবাজ ইন্টারন্যাশনাল, পরে নাম হয় ড্যাটকো।
তবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে মুসার অস্ত্র ব্যবসার কথাই আগে বলা হয়। জাঁকালো জীবন-যাপন, সোনার জুতার জন্য তাকে বিদেশি গণমাধ্যমে বলা হয় ‘প্রিন্স অব বাংলাদেশ’।
একটি দৈনিকে সুইস ব্যাংকে মুসা বিন শমসেরের ৫১ হাজার কোটি টাকা থাকার খবর ছাপা হয়েছিল। ১৯৯৭ সালে যুক্তরাজ্যে নির্বাচনে লেবার পার্টির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী টনি ব্লেয়ারের নির্বাচনী প্রচারের জন্য ৫ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে আলোচনায় এসেছিলেন তিনি।
অবশ্য দুদক অনুসন্ধান শুরুর পর গত বছর মুসা সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বাংলাদেশে বসে কেউ এত অর্থ উপার্জন করতে পারবে না।
অভিযোগ আছে, একাত্তরের ২১ এপ্রিল পাকিস্তানি সৈন্যদের ফরিদপুরে ঢোকার ক্ষেত্রে মানচিত্র ও পথ নির্দেশনা দিয়ে নেপথ্যে সহযোগিতা করেন মুসা বিন শমসের। সাংবাদিক-কলামনিস্ট আবু সাঈদের লেখা বইয়েও মুসার একাত্তরের ভূমিকার কথা এসেছে।
ট্রাইব্যুনালে আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের যুদ্ধাপরাধ মামলায় সাক্ষ্য দেওয়া ফরিদপুরের মুক্তিযোদ্ধা আবু ইউসুফ পাখী দুই বছর আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে ইউসুফ বলেছিলেন, ফরিদপুরে পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢোকার পরদিন অর্থাৎ একাত্তরের ২২ এপ্রিল ফরিদপুর সার্কিট হাউসে পাকিস্তানি মেজর আকরাম কোরায়েশী ও মুসাকে অন্তরঙ্গ পরিবেশে দেখেছিলেন তিনি।
ট্রাইব্যুনালের আরেক সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা বাবুনাথ একাত্তরে কয়েকটি ঘটনায় মুসার জড়িত থাকার তথ্য জানান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে।
একটি ঘটনার বর্ণনায় তিনি বলেন, “১৯৭১ সালে ২১ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী ফরিদপুরে প্রবেশ করে। এর ছয় কি সাত দিন পরে মুসার নেতৃত্বে স্থানীয় দালাল ও পাকিস্তানি আর্মিরা সদর থানার কানাইপুর গ্রামে হামলা চালায়। সেদিন কানাইপুর গ্রামের সিকদার বাড়ির ১৩-১৪ জনকে হত্যা করা হয়। মুসার সহযোগী লালমিয়া (বর্তমানে এলাকায় পীর হিসেবে পরিচিত) সেদিন এ হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়।”
আরেকটি ঘটনা বর্ণনা দিয়ে বাবুনাথ বলেন, “পাকিস্তানি মেজর কোরায়েশী একটি মেয়েকে ধর্ষণ করেছিল। স্বাধীনতার পরদিন আমি এ ঘটনা শুনি। ফরিদপুরের ‘সারদা সুন্দরী মহিলা বিদ্যালয়’র প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রকান্ত নাথের বাসার ভাড়াটিয়া ছিল মেয়েটির পরিবার। ওই বাসাতেই ধর্ষণ করে মেজর আকরাম। সেদিন মুসাও মেজর আকরামের সঙ্গে ছিল।”
এছাড়া মুসার নেতৃত্বে ফরিদপুর সদর উপজেলার শিবরামপুরে বাবু বাড়ির ১৪-১৫ জনকে হত্যা এবং নগরকান্দা উপজেলার তালমা বাজারের রবী ত্রিবেদীর বাড়ির পেছনে কুণ্ডুবাড়ি থেকে ৮ মন স্বর্ণালঙ্কার লুট করা হয় বলেও দাবি করেন মুক্তিযোদ্ধা বাবুনাথ।
মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর গত মার্চে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে পাঠানো এক বিবৃতিতে মুসা দাবি করেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল ‘গভীর’।
ছাত্রলীগের ‘অত্যন্ত প্রতাপশালী নেতা’ হওয়ায় পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযুদ্ধের সময় আট মাস আটকে রেখে ‘প্রচণ্ড শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন’ করে বলেও ওই বিবৃতিতে দাবি করেন মুসা।
তবে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাসুদ বলেছেন, এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধা এবং লোকজন আছেন, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় মুসার অপরাধের শিকার।
“মুসা বিন শমসের সরাসরি যুদ্ধাপরাধী। যুদ্ধাপরাধী হিসেবেই সে চিহ্নিত। সত্যি কথা বলতে কি, এটা আমাদের ব্যর্থতা যে, তাকে আমাদের যেভাবে চিহ্নিত বা উপস্থাপন করার দরকার ছিল, আমরা সেটা করিনি।”