পাসপোর্টবিহীন অবস্থায় সুদান থেকে ফিরে ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে দুই দিন আটকে থাকার পর অবশেষে বাড়ি ফিরেছেন পাঁচ যুবক। কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে দীর্ঘ উৎকণ্ঠার অবসান ঘটেছে পরিবারের।
Published : 28 Oct 2016, 07:10 PM
বিমানবন্দর আর্মড পুলিশের অধিনায়ক রাসেদুল ইসলাম শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মৌখিক নির্দেশে বৃহস্পতিবার রাতে ওই পাঁচজনকে তাদের পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
এই পাঁচজন হলেন- রংপুরের মো. ফরিদ মিয়া (২৮), আশিকুর রহমান (২৭), ব্রাক্ষণবাড়িয়ার মো. মাসুদ (৩৫), নওগাঁর মো. সবুজ (৩০) ও ময়মনসিংহের আলমগীর হোসেন (৩০)।
জীবন বদলের আশায় শ্রমিকের কাজ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সুদানে গিয়েছিলেন এই পাঁচ যুবক। কিন্তু সেখানে যাওয়ার কয়েকমাস পর তাদের দুর্ভাগ্যের সূত্রপাত। চাকরিদাতারা পাসপোর্ট আটকে রেখে নামমাত্র মজুরিতে তাদের কাজ করতে বাধ্য করে।
এরপর দালাল ধরে সুদানের পুলিশের লেখা আরবি ভাষার ছাড়পত্র নিয়ে গত ১৬ অক্টোবর ঢাকায় নামেন ওই পাঁচ যুবক। কিন্তু পাসপোর্ট বা দূতাবাসের আউট পাস না থাকায় তারা আদৌ বাংলাদেশি কিনা- সেই প্রশ্ন তুলে তাদের সুদানে ফেরত পাঠায় ঢাকার ইমিগ্রেশন পুলিশ।
সুদানি পুলিশ তাদের আবারও ফেরত পাঠালে বুধবার শাহজালালে নেমে একই জটিলতায় পড়েন পাঁচ বাংলাদেশি। এদিকে বিমানবন্দরের বাইরে তাদের নিতে আসা স্বজনদের সময় কাটতে থাকে উৎকণ্ঠার মধ্যে।
ইমিগ্রেশন পুলিশের পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলা হয়, ‘নিয়মের বাইরে’ কিছু করতে তারা অপারগ। সুতরাং ওই পাঁচজনকে আবার সুদানেই ফিরতে যেতে হবে।
অন্যদিকে বিমানবন্দরের বাইরে অপেক্ষায় থাকা স্বজনদের দাবি ছিল, সুদানে না পাঠিয়ে জাতীয়তা শনাক্তের জন্য প্রয়োজনে ওই পাঁচজনকে পুলিশ হেফাজতে পাঠানো হোক। আইনি প্রক্রিয়ায় তারা বাংলাদেশি প্রমাণ হলেই তারা তাদের বুঝে নেবেন।
পাঁচ যুবক ও তাদের পরিবারের এই দুর্ভোগের ঘটনা নিয়ে বৃহস্পতিবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। এরপর কর্তৃপক্ষের মন বদলায়; পাঁচ যুবককে সুদানে না পাঠিয়ে তুলে দেওয়া হয় পরিবারের কাছে।
‘কল্পনাও করিনি বাড়ি ফিরে যাব’
বৃহস্পতিবার বিমানবন্দরের বাইরে ছেলের অপেক্ষায় থাকা মো. আনোয়ার ভাবতেও পারেননি, তার ছেলে মো. সবুজ মিয়া শুক্রবার দুপুরের আগেই তার সঙ্গে নওগাঁর রানীনগরে বাড়ি ফিরতে পারবে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমরা গরীব মানুষ। পুলিশ যখন ছেলেকে দেশে ঢুকতে দিচ্ছিল না তখন হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। আবার সুদান পাঠালে তাকে ফিরিয়ে আনার মতো টাকা আমার নাই। খুব অসহায় মনে হচ্ছিল।”
২০০৯ সালে দালালের মাধ্যমে শ্রমিক হিসেবে সুদানে যান সবুজ। কয়েক মাস দেশে টাকাও পাঠিয়েছিলেন। তবে ধীরে ধীরে টাকার পরিমাণ কমে আসতে থাকে; এক সময় তাও বন্ধ হয়ে যায়। পাসপোর্ট ও দরকারি কাগজপত্র আটকে রেখে নামমাত্র অর্থে সুদানে তাকে কাজ করতে বাধ্য করা হয়।
সবুজ এক পর্যায়ে দেশে ফোন করে জানান, তার পক্ষে আর সুদানে থাকা সম্ভব না। এদিকে মালিকও পাসপোর্ট আটকে রেখেছে। দেশে ফেরার আশায় সেখানে বাংলাদেশি এক দালাল ধরেন সবুজ। সেই দালালকে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে ছেলেকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন আনোয়ার।
সেই চেষ্টার পর গত ১৬ অক্টোবর সবুজসহ একই পরিস্থিতির শিকার পাঁচ বাংলাদেশি ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছায়। কিন্তু বাংলাদেশে প্রবেশের বৈধ কাগজপত্র সঙ্গে না থাকায় ইমিগ্রেশন বিভাগ তাদের সুদানে ফেরত পাঠায়।
সেখানে কয়েক দিন থাকার পর সুদানে এক বাংলাদেশি দালালের মাধ্যমে আবার কাগজপত্র তৈরি করে সৌদি এয়ারলায়েন্সে বুধবার দেশে নামেন সবুজরা পাঁচজন । কিন্তু এবারও আটকে যান ইমিগ্রেশনে।
আনোয়ার বলেন, “আপনাদের মিডিয়ার সঙ্গে কথা বললাম, আমার ছবি তোলা হল। সন্ধ্যার পর থেকে ঘটনা অন্য রকম মনে হচ্ছিল। রাতে বিমানবন্দরের লোকজন একটা কাগজে ‘ছেলেকে বুঝে পেয়েছি’ লিখে তাতে সই দিতে বলল। পরে সবুজকে আমাদের কাছে বুঝিয়ে দিল।”
অবর্ননীয় দুর্ভোগ কাটিয়ে বাড়ি ফেরা সবুজ বলেন, “ভাই, আমরা গরিব হতে পারি, কিন্তু আমরা তো বাংলাদেশি। বিমানবন্দরে প্রশ্ন তুলল আমরা বাংলাদেশি কিনা। আমরা জঙ্গি কিনা জিজ্ঞেস করল। এটা খুব খারাপ লাগেছে। আর কারও যেন এমন বিপদে পড়তে না হয়।”
এখন আর বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা না করে দেশেই কিছু করার পরিকল্পনার কথা জানান ৩০ বছর বয়সী এই যুবক।
‘অনিশ্চিত ভবিষ্যত’
বুধবার থেকে বিমানবন্দরের বাইরে অপেক্ষা করার পর বৃহস্পতিবার রাতে ছোট ভাই আশিকুর রহমানকে বেরিয়ে আসতে দেখেন আজিজুল ইসলাম। স্বস্তি নিয়ে দুই ভাই রওনা হন রংপুরে বাড়ির পথে।
আজিজ বলেন, ভাইকে ফিরে পাওয়ার যাবে- এটা তার কাছে এক পর্যায়ে অসম্ভব কল্পনা বলে মনে হচ্ছিল। ভাই ফিরেছে- এটা এখন বাস্তব। কিন্তু আশিককে বিদেশে পাঠানোর জন্য ঋণ হিসেবে নেওয়া চার লাখ টাকার জন্য এখনও তাদের মাসে মাসে ১০ হাজার টাকা করে সুদ দিতে হচ্ছে।
“আশিক ফিরছে। এখন সুদের টাকা কীভাবে দেব সেই চিন্তায় আছি। ওকে আর বাইরে পাঠাব না। ঢাকায় কোনো গার্মেন্টে কাজের ব্যবস্থা করা যায় কি না দেখব।”
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. মাসুদ বাড়ি পৌঁছেছেন বৃহস্পতিবার গভীর রাতে। আট ভাই-বোনের সংসারে স্বচ্ছলতা আনার স্বপ্ন নিয়ে দুই বছর আগে সুদান যাওয়ার পর তাকেও মালিকের হাতে পাসপোর্ট খুইয়ে নিগ্রহের শিকার হতে হয়েছে।
মাসুদের মামী শবুরা খাতুন শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা তো ভাবি নাই মাসুদ আসতে পারবে। রাত ৩টার সময় ওর মামারে নিয়া বাড়ি আসল।”
মাসুদের পরিবারের অবস্থাও আশিকের মত। বিদেশ যাওয়ার জন্য যে টাকা ঋণ করতে হয়েছে, তা শোধ দেওয়ার দুঃশ্চিন্তা কাঁটা হয়ে আছে মাসুদকে ফিরে পাওয়ার আনন্দের মধ্যেও।
তার মামা আবদুল মান্নান টেলিফোনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার ভাগ্নে অনেক আদরের। সুদান থেকে ওকে কোনো বেতন দেয় নাই। ধার-কর্জ করে দেড় লাখ টাকা দিয়ে ওকে দেশে আনার চেষ্টা করেছিলাম। বিমানবন্দরে আটকা পড়ে গেল। আবারও সুদানে পাঠালে বিপদে পড়ে যেতাম।”
রংপুরের ফরিদ মিয়ার দুলাভাই তৌফিক মিয়া বলেন, শ্যালককে ফিরে পেয়ে তাদের পরিবারের সবাই খুব খুশি। অনেক কষ্টে জমি-গরু বিক্রি করে তিন লাখ টাকা জোগাড় করা হয়েছিল তাকে বিদেশ পাঠাতে। এখন সেই সেটাই বড় দুঃশ্চিন্তা।
“তারপরও বাড়ির অনেকে নিয়ত করে রাখছে। ফরিদ বাড়ি আসছে। আমরা বকরি কোরবানি দেব,” বলেন তিনি।