সাম্প্রতিক জঙ্গি কর্মকাণ্ডের তদন্তে আরও তিনজনের নাম পেয়েছেন তদন্তকারীরা, যাদের মধ্যে ‘রাজীব গান্ধী’ ছদ্মনামের একজন গুলশান ও শোলাকিয়া হামলায় ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ভূমিকা রেখেছিলেন বলেন পুলিশের ভাষ্য।
Published : 19 Sep 2016, 06:24 PM
পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, রাজীব গান্ধী ওরফে সুভাষ গান্ধী ওরফে গান্ধী নামে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত ওই ব্যক্তি কাজ করছিলেন নিষিদ্ধ জঙ্গি দল জেএমবির ‘উত্তরাঞ্চলীয় কমান্ডার’ হিসেবে।
“তার প্রকৃত নাম আমরা জানতে পারিনি। গুলশানের ঘটনার আগে দুজন এবং শোলাকিয়ার ঘটনার আগে একজন টেরোরিস্টকে সে নিজে উত্তরবঙ্গ থেকে পাঠিয়েছিল, যাদের সে আগেই প্রশিক্ষণ দিয়েছিল।”
সোমবার ঢাকা মহানগর পুলিশের কার্যালয়ে পুলিশের জঙ্গি দমন অভিযানের অগ্রগতির তথ্য সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, রিপন ও খালিদ নামে এই দলের নেতৃস্থানীয় আরও দুই জনের তথ্য তারা পেয়েছেন, যারা গত এপ্রিলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এএফএম রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যাকাণ্ডের পর ভারতে চলে যান।
“রিপন ও খালিদ ইন্ডিয়াতে আছে বলে আমরা খবর পেয়েছিলাম।… এরপর তারা দেশে ফিরেছে এমন কোনো তথ্য আমাদের কাছে নাই।”
এক প্রশ্নের জবাবে মনিরুল বলেন, জেএমবি নেতা ‘রাজীব গান্ধী’ দেশেই আছেন বলে তদন্তকারীদের ধারণা।
“আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আমরা তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি।”
তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে সাংবাদিকদের জানাতে গিয়ে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, গুলশান হামলার তদন্তে নেমে তারা একটি ‘বৃহৎ চিত্র’ পান।
“যারা হলি বেকারিতে ঢুকেছিল এবং পেছনে যারা ছিল তাদের অনেককে চিহ্নিত করেছি- এটা আমরা বিভিন্ন সময় বলেছি। তাদের গ্রেপ্তারের জন্য যখন অভিযানে চালিয়েছি, তখন দেখা গেছে, বিভিন্ন অভিযনে তারা কেউ কেউ নিহত হয়েছে, কেউ কেউ জীবিত গ্রেপ্তার হয়েছে, কেউ কেউ ধরা পড়ার অপেক্ষায় আছে। আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে।”
গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে নজিরবিহীন জঙ্গি হামলায় ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ ২২ জন নিহত হন। পরদিন সকালে সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডো অভিযানে হামলাকারী ৫ জঙ্গিসহ ছয়জন নিহত হন। জিম্মি অবস্থা থেকে উদ্ধার করা হয় ১৩ জনকে।
তার এক সপ্তাহের মাথায় ৭ জুলাই রোজার ঈদের সকালে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় দেশের বৃহত্তম ঈদ জামাতের মাঠের কাছে ফের হামলা হয়। সেখানে নিরাপত্তার চৌকিতে দায়িত্বরত দুই পুলিশ সদস্য নিহত হন; পরে পুলিশের অভিযানে গোলাগুলির মধ্যে স্থানীয় এক নারীর মৃত্যু হয়, নিহত হন এক সন্দেহভাজন হামলাকারী।
মনিরুল বলেন, ওই দুই হামলার পর পুলিশের তদন্তের মধ্যে কল্যাণপুর, নারায়ণগঞ্জ, রূপনগর এবং সর্বশেষ আজিমপুরে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে নিহত এবং গ্রেপ্তার অনেকের মধ্যেই যোগাযোগ থাকার তথ্য তারা পান।
“যেমন কল্যাণপুরের রায়হান কবির ওরফে তারেক; গাইবন্ধায় সে গুলশান ও শোলাকিয়ার হামলাকারীদের প্রশিক্ষণের সমন্বয়ক ছিল। সেখানে কথিত মেজর মুরাদের অস্তিত্ব পেয়েছিলাম, যে ছিল প্রধান ট্রেইনার। রূপনগরে যে কথিত মেজর মুরাদ (অবসরপ্রাপ্ত মেজর জাহিদুল ইসলাম) মারা গেল, সে কিন্তু সেই যে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল সেই লোক। এগুলো কোনোটাই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
“আর নারায়ণগঞ্জের অভিযানে নিহত তামিমের কথা তো আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি, সে সব কিছুর সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করেছে। আরেকজন ছিল, যে আবদুল করিম নামে বসুন্ধরায় গুলশানের হামলাকারীদের জন্য বাসা ভাড়া নিয়েছিল। তার আসল নাম তানভীর কাদেরী, সেও আজিমপুরের অভিযানে মারা গেছে।”
পাশাপাশি জেএমবি নেতা নুরুল ইসলাম মারজান এবং বাসারুজ্জামান ওরফে চকলেটও গুলশান হামলায় ‘বড় ভূমিকা’ রেখেছিলেন জানিয়ে মনিরুল বলেন, তাদেরও পুলিশ খুঁজছে।
গুলশান হামলার পর সশস্ত্র বাহিনীর অভিযানে নিহত ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনকে জেএমবি সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করে পুলিশ; আর সাইফুল চৌকিদার নামে আরেকজন ছিলেন ওই বেকারির পাচক।
সাইফুল জঙ্গি নন বলে পরিবার দাবি করে এলেও গুলশান হামলার ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা মামলায় তাকে আসামি করা হয়। এজাহারে বলা হয়, সাইফুল ‘হামলাকারীদের সঙ্গে থেকে তাদের সহায়তা করেন’।
সাইফুলের জঙ্গি সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে কি না জানতে চাইলে অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল বলেন, তারা এখনও বিষয়টি ‘সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করতে পারেননি’।
“তার সম্পৃক্ততা নাই এটা বলা যাবে না, সম্পৃক্ততা আছে সুনির্দিষ্ট করে এটাও বলার সময় আসেনি। এখনও বিষয়টি তদন্তাধীন।”
সেই জঙ্গি হামলার কয়েক ঘণ্টার মাথায় ওই এলাকা থেকে জাকির হোসেন শাওন নামে আরেক তরুণকে রক্তাক্ত অবস্থায় আটক করেছিল পুলিশ। শাওনও হলি আর্টিজানে বাবুর্চির সহকারী হিসেবে কাজ করতেন।
এক সপ্তাহ চিকিৎসাধীন থাকার পর হাসপাতালে শাওনের মৃত্যু হয়। তার জঙ্গি সম্পৃক্ততার সন্দেহ নিয়েও পুলিশ নিশ্চিত কোনো তথ্য পায়নি বলে জানান মনিরুল।
‘৭০ শতাংশ শক্তি ক্ষয়’
মনিরুল বলেন, নব্য জেএমবি গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলার পেছনে তাদের ‘সর্বোচ্চ’ এবং ‘সর্বশক্তি’ বিনিয়োগ করেছিল। তাদের নেতাদের সবাই ওই দুই ঘটনায় জড়িত ছিল।
“এরকম বেশ কিছু লোক নিহত হয়েছে। কল্যাণপুরে এরকম চারজন কমান্ডার নিহত হয়েছে, আর তামিম তো মূল সমন্বয়কই ছিল। এরপর মেজর জাহিদ, তানভীর কাদেরী এরাও নিহত হয়েছে, এরাও গুরুত্বপূর্ণ ছিল।”
নেতৃস্থানীয় অনেকেই নিহত হওয়ায় এই জঙ্গিদলের ‘৬০ থেকে ৭০ শতাংশ শক্তি ক্ষয় হয়েছে’ বলে মনিরুলের ধারণা।
“তবে এখনও তারা পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়নি। মারজান, গান্ধী, বাসারুজ্জামানের মত সংগঠক এখনও বাইরে আছে। তারা যাতে আর নাশকতা ঘটাতে না পারে এবং তাদের গ্রেপ্তার করার জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
এক প্রশ্নের জবাবে মনিরুল জানান, আজিমপুর অভিযানে আহত অবস্থায় গ্রেপ্তার তিন নারী জঙ্গির পরিচয় তারা নিশ্চিত হয়েছেন।
তাদের মধ্যে আবেদাতুল ফাতেমা ওই অভিযানে নিহত তানভীর কাদেরীর; শারমিন ওরফে শায়লা আফরিন জেএমবি নেতা বাসারুজ্জামান ওরফে চকলেটের এবং আফরিন ওরফে প্রিয়তি আরেক জঙ্গি নেতা মারজানের স্ত্রী বলে পুলিশের তথ্য।
গত ১০ সেপ্টেম্বর ঢাকার আজিমপুরের ওই বাসায় অভিযানে গেলে তিন নারী মরিচের গুঁড়া ও ছোরা নিয়ে হামলা চালিয়েছিলেন বলে সেদিন জানিয়েছিলেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
তাদের মধ্যে একজন পুলিশের গুলিতে আহত হন, বাকি দুজন ছুরি দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন বলে পুলিশের ভাষ্য।
এক প্রশ্নের জবাবে মনিরুল বলেন, ওই তিন নারী এখনও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকায় তাদের সাথে কথা বলার ‘সুযোগ হয়নি’।
তিনি জানান, ওই বাসা থেকে যে তিন শিশুকে সেদিন উদ্ধার করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে মেজর জাহিদের মেয়েকে তার নানা-নানির হেফাজতে ফেরত দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া তানভীর কাদেরীর এক ছেলেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রোববার পুলিশ রিমান্ডে পাঠিয়েছে শিশু আদালত।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মনিরুল বলেন, “কিশোর হিসেবেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে, সে যতটুকু জানে তা আমরা জানার চেষ্টা করছি।”