বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ তিন দশক ধরে যে বাড়িতে বসবাস করে আসছেন, সেই বাড়ি তার ভাই মনজুর আহমদের নামে মিউটেশন (নামজারি) ও ডিক্রি জারি করতে হাই কোর্টের দেওয়া রায় আপিল বিভাগে বাতিল হয়ে গেছে।
Published : 02 Aug 2016, 11:01 AM
সেই সঙ্গে মওদুদের বিরুদ্ধে সরকারি বাড়ি আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের করা মামলাও আর টিকছে না।
সর্বোচ্চ আদালতের এই রায়ের ফলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতা মওদুদ আহমদকে গুলশান-২ নম্বর সেকশনের ১৫৯ নম্বর প্লটের ওই বাড়ি হারাতে হচ্ছে। রাজউক এখন বাড়িটি নিজেদের তত্ত্বাবধানে নেবে বলে জানিয়েছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একরামুল হক টুটুল।
হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাজউকে ও রাষ্ট্রপক্ষের করা তিনটি আপিল মঞ্জুর করে প্রধান বিচারপতি নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ মঙ্গলবার এই রায় দেয়।
পাশাপাশি ওই বাড়ি নিয়ে দুদকের মামলায় অভিযোগ আমলে নেওয়াকে বৈধতা দিয়ে হাই কোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে মওদুদ ও তার ভাইয়ের করা লিভ টু আপিলও সর্বোচ্চ আদালত নিষ্পত্তি করে দিয়েছে। ফলে মামলাটি বাতিল হয়ে গেছে।
আপিল বিভাগে রাজউক ও রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একরামুল হক টুটুল। দুদকের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।
আর মওদুদের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী ও মাহবুব উদ্দিন খোকন। মওদুদ নিজেও শুনানিতে অংশ নেন।
রায়ের পর টুটুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মওদুদের ভাইয়ের নামে ওই প্লটের বায়না চুক্তিতে তারিখ দেখানো হয়েছিল ১৯৮৫ সালের ১০ অগাস্ট। কিন্তু ওই বাড়ির মালিক অস্ট্রিয়ার নাগরিক ইনজে মারিয়া প্লাজ মারা যান ১৯৮৫ সালের ৩০ মার্চ। অর্থাৎ বায়নানামাটি ছিল ‘জাল’।
এক বিঘা ১৩ কাঠা জমির ওপর ওই বাড়ি অবৈধভাবে দখল ও আত্মসাতের অভিযোগে ২০১৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর গুলশান থানায় মওদুদ ও তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে এই মামলা করেন দুদকের উপ-পরিচালক হারুনুর রশীদ।
দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা ২০১৪ সালের ২৬ মে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে এ মামলার অভিযোগপত্র দিলে ওই বছর ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালতের বিচারক তা আমলে নেন।
অভিযোগে বলা হয়, গুলশানের যে বাড়িটিতে মওদুদ আহমদ ও তার পরিবার থাকছেন, তার প্রকৃত মালিক ছিলেন পাকিস্তানি নাগরিক মো. এহসান। ১৯৬০ সালে তৎকালীন ডিআইটির কাছ থেকে এই বাড়ির মালিকানা এহসান পান। ১৯৬৫ সালে বাড়ির মালিকানার কাগজপত্র এহসানের স্ত্রী অস্ট্রিয়ার নাগরিক ইনজে মারিয়া প্লাজের নামে নিবন্ধন করা হয়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এহসান স্ত্রীসহ ঢাকা ত্যাগ করেন। তারা আর ফিরে না আসায় ১৯৭২ সালে এটি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত হয়।
ওই বছরই মওদুদ ওই বাড়ির দখল নেন। এরপর ১৯৭৩ সালের ২ অগাস্ট তারিখে তিনি ইনজে মারিয়া প্লাজের নামে একটি ‘ভুয়া’ আমমোক্তারনামা তৈরি করান এবং নিজেকে তার ভাড়াটিয়া হিসেবে দেখিয়ে ওই বাড়িতে বসবাস করতে থাকেন বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়।
কবি জসীমউদ্দীনের জামাতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মপক্ষ সমর্থন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে তাকে বাংলাদেশের প্রথম পোস্ট মাস্টার জেনারেল করা হয়।
অবশ্য পরে দেশের প্রথম সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যোগ দেন মওদুদ। জিয়া তাকে মন্ত্রী ও উপপ্রধানমন্ত্রী করেছিলেন। জিয়ার মৃত্যুর পর মওদুদ সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের হাত ধরেন। এরশাদের নয় বছরের শাসনামলে তিনি মন্ত্রী, উপপ্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী এবং উপরাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর মওদুদ বিএনপিতে ফেরেন এবং ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারে আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
দুদকের মামলায় বলা হয়, জিয়ার সরকারের উপ প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে মওদুদ ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে গুলশানের ওই বাড়ি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করেন। এর ধারাবাহিকতায় মাত্র ১০০ টাকা মূল্য দেখিয়ে ১৯৮০ সালে প্লটটি তিনি বরাদ্দ নেন।
পরে তিনি একটি বায়নানামা ‘হাজির করেন’, যেখানে দেখানো হয়, ওই বাড়ির মালিক ইনজে মারিয়া প্লাজ জনৈক মহসিন দরবারকে আমমোক্তার বানিয়েছেন এবং সেই মহসিন দরবার ১৯৮৫ সালে বাড়িটি মওদুদের সহোদর ভাই মনজুর আহমদের নামে বায়না করে দিয়েছেন।
মওদুদ ওই অভিযোগ আমলে নেওয়ার আদেশের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে ফৌজদারি রিভিশন আবেদন করেন। শুনানি নিয়ে গতবছর ২৩ জুন হাই কোর্ট তা খারিজ করে দেয়।
হাই কোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে মওদুদ আপিলের আবেদন করলে আপিল বিভাগ তা মঞ্জুর করে। মঙ্গলবার আপিল বিভাগ তার নিষ্পত্তি করে দেওয়ায় মামলা থেকে অব্যাহতি পেলেন মওদুদ ও তার ভাই।
নথিপত্রের তথ্য অনুযায়ী, অস্ট্রীয় নাগরিক ইনজে মারিয়া প্লাজ ১৯৮৪ সালের ২৫ জুন বাড়ির বিষয়ে মহসিন দরবার নামের এক ব্যক্তিকে কথিত পাওয়ার অব অ্যাটর্নি (আমমোক্তারনামা) দেন।
রাষ্ট্রপক্ষের নথিপত্রে দেখা যায়, ১৯৮৫ সালের ৩০ মার্চ ওই অস্ট্রীয় নাগরিক মারা যান। অথচ মামলাকারীপক্ষ (মওদুদের ভাই) তাদের নথিতে দেখায়, বাড়ি নিয়ে ওই বছরের ১০ অগাস্ট তাদের মধ্যে বায়নানামা চুক্তি হয়।
তবে চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় মামলা করেন মওদুদ আহমদের ভাই। ১৯৯৩ সালের ২৩ জানুয়ারি তৎকালীন সাব জজ আদালত মামলাটি খারিজ হয়।
ওই আদেশের বিরুদ্ধে ২০০১ সালের ২৩ অক্টোবর হাই কোর্টে প্রথম আপিল করেন মওদুদ আহমদের ভাই, যার ওপর চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে ২০০৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর হাই কোর্ট রায় দেয়।
হাই কোর্টের ওই রায়ে আবেদনকারীপক্ষ ডিক্রি পায়, ফলে সম্পত্তির মালিক হিসেবে ঘোষণা মেলে। এর ধারাবাহিকতায় ২০০৬ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর মনজুর আহমেদের নামে আদালতের মাধ্যমে সম্পত্তির দলিল হয়।
তবে হাই কোর্টের প্রথম রায়ের বিরুদ্ধে রাজউক ২০০৮ সালে লিভ টু আপিল করে, যা তামাদি হওয়ায় আপিল বিভাগে খারিজ হয়।
রাজউক ২০১৪ সালে ওই রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করে, যা শুনানির জন্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে আপিল হিসেবে গণ্য হয়। আপিল বিভাগ মঙ্গলবার ওই আপিল মঞ্জুর করে রায় দেয়।
এর আগে ওই সম্পত্তি মনজুর আহমদের নামে মিউটেশন (নাম জারি) করার নির্দেশনা চেয়ে হাই কোর্টে আবেদন করা হয় ২০১০ সালে। একই বছরের ৮ ডিসেম্বর হাই কোর্ট মওদুদ আহমদের ভাইয়ের নামে ওই সম্পত্তি নাম জারির নির্দেশ দেয়।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে রাজউক ও সরকারপক্ষ আলাদাভাবে লিভ টু আপিল করে, যা ২০১৪ সালে শুনানির জন্য গ্রহণ করা হয়।
এর ধারাবাহিকতায় সরকার ও রাজউক দুটি নিয়মিত আপিল করে। হাই কোর্টের প্রথম রায়ের বিরুদ্ধে রাজউকের আপিলের সঙ্গে এর শুনানি হয়। মঙ্গলবার সর্বোচ্চ আদালত রায় ঘোষণা করে।
রায়ের প্রতিক্রিয়া
রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, “মওদুদ আহমদের ভাইকে উচ্ছেদের জন্য সরকার মামলা করেনি। মওদুদ আহমদের ভাই নিজেই মামলা করেছিলেন।”
হাই কোর্ট মওদুদের ভাই মনজুর আহমেদের নামে নামজারি করতে নির্দেশ দেওয়ার পর নিজে অস্ট্রিয়া গিয়েছিলেন বলে অ্যাটর্নি জেনারেল জানান।
“সেখানে গিয়ে বাড়ির মালিক অস্ট্রীয় নাগরিক ইনজে মারিয়া প্লাজের মৃত্যু সনদ নিয়ে আসি। আমরা আপিল বিভাগে দেখাতে সক্ষম হয়েছি যে, মওদুদ আহমদের ভাই যে তারিখে চুক্তিনামা করেছিলেন, তার আগেই মারিয়া মারা গেছেন।”
মাহবুবে আলম বলেন, “১৯৭৩ সালে মওদুদ আহমদকে বাড়িটি দেখাশোনার জন্য পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দেন মারিয়া প্লাজ। কিন্তু তিনি তার ভাইয়ের নামে ডিক্রি ও নাম জারির আদেশ নিয়ে নিয়েছেন। এই দুটি বিষয় আপিল বিভাগ বাতিল করেছে।... এই রায়ের ফলে মওদুদের ভাইয়ের এই সম্পত্তির দাবি অগ্রাহ্য। তারা যে বসবাস করছেন, তা অবৈধ দখলদার বলে গণ্য হবে।”
তাদের উচ্ছেদের প্রক্রিয়া কী হবে জানতে চাইলে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, “নিশ্চয়ই রাজউক আইন অনুসারে পদক্ষেপ নেবে।”
অন্যদিকে ব্যারিস্টার মওদুদ রায়ের পর সাংবাদিকদের বলেন, “সাত বছর পর প্রতিহিংসাবশত সরকার আপিল করেছে। ১৯৮১ সাল থেকে আমরা এই বাড়িটিতে বসবাস করছি। এটি ক্রয় করা বাড়ি, সরকারের বাড়ি নয়। আপিল বিভাগের রায় দেখে আমরা অবশ্যই রিভিউ করব।”
মওদুদ আহমদ রিভিউ করলে কী হবে- এমন প্রশ্নে মাহবুবে আলম বলেন, “এটি তার আইনগত অধিকার। কিন্তু রাজউক ও সরকার পদক্ষেপ নেবে।”