সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ আসামির বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছে আদালত।
Published : 18 Jul 2016, 02:54 PM
রানা প্লাজা: গতি নেই তিন মামলায়
রানা প্লাজা ধস: রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ
ঢাকার জেলা দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জামান সোমবার আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শুরুর জন্য ১৮ সেপ্টেম্বর দিন ঠিক করে দেন।
বিপুল হতাহতের ঘটনায় বিশ্বকে নাড়িয়ে দেওয়া রানা প্লাজা ধসের তিন বছর পর অভিযোগ গঠনের আদেশের মধ্য দিয়ে এ মামলার আসামিদের বিচার শুরু হল।
ভবন মালিক সোহেল রানাসহ গ্রেপ্তার ৬ আসামি ছাড়াও মোট ৩৫ জন আসামি অভিযোগ গঠনের শুনানির সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। বাকি ছয়জনকে পলাতক দেখিয়ে এ মামলার বিচার কাজ চলবে।
আসামিদের মধ্যে ৩৮ জনকে হত্যা এবং বাকিদের অন্যান্য ধারায় অভিযুক্ত করা হয়েছে বলে এ আদালতের পিপি খন্দকার আবদুল মান্নান জানান।
তিনি বলেন, আদালতে উপস্থিত আসামিরা বিচারকের প্রশ্নের জবাবে নিজেদের নির্দোষ দাবি করে আদালতের কাছে সুবিচার প্রার্থনা করেন।
পাশাপাশি মামলার প্রধান আসামি সোহেল রানাসহ ২৩ জনের পক্ষে মামলা থেকে অব্যাহতির আবেদন করেন তাদের আইনজীবীরা।
শুনানি শেষে বিচারক অব্যাহতির আবেদন নাকচ করে ৩৫ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন।
রানা প্লাজা ধস
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে সাভার বাসস্ট্যন্ড সংলগ্ন আট তলা রানা প্লাজা ভেঙে পড়লে শিল্পক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি ঘটে।
ওই ঘটনায় নিহত হন এক হাজার ১৩৫ জন, আহত হন আরও হাজারখানেক শ্রমিক যারা ওই ভবনের পাঁচটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন।
বাংলাদেশের ওই ঘটনা সে সময় আন্তর্জাতিক সব গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়। দেশে কারখানার অবকাঠামোগত নিরাপত্তা ও কর্মপরিবেশের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এলে সরকার ও মালিকরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়।
ভবন ধসে প্রাণহানির ঘটনায় প্রথমে ‘অবহেলাজনিত মৃত্যুর’ অভিযোগে একটি মামলা করেন সাভার থানার এসআই ওয়ালী আশরাফ। রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানাসহ ২১ জনকে এজাহারে আসামি করা হয়।
তবে তদন্ত শেষে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অভিযোগপত্রে ৪১ জনকে আসামি করে তাদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত মৃত্যু ঘটানোসহ দণ্ডবিধির ৩০২, ৩২৬, ৩২৫, ৩৩৭, ৩৩৮, ৪২৭, ৪৬৫, ৪৭১, ২১২, ১১৪, ১০৯, ৩৪ ধারায় বিভিন্ন অভিযোগ আনেন।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের ( সিআইডি) সহকারী সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর গতবছর ১ জুন ওই অভিযোগপত্র জমা দেন।
এতে বলা হয়, রানা প্লাজায় ফাটল ধরার পর ঝুঁকি জেনেও শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। কাজ না করলে চাকরিচ্যুতির হুমকিও দেওয়া হয়েছিল বলে প্রমাণ পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা। এটা আসলে ‘ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা’।
অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিদের মধ্যে পাঁচজন সরকারি কর্মকর্তার ক্ষেত্রে মঞ্জুরি আদেশ না থাকায় একাধিকবার শুনানি পেছানো হয়। পরে ওই অনুমোদন ছাড়াই অভিযোগপত্র গ্রহণ করে আদালত গত ২১ ডিসেম্বর পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারে পরোয়ানা জারি করে।
আসামি যারা
মামলার আসামিরা হলেন- ভবন মালিক সোহেল রানা, তার বাবা আব্দুল খালেক ওরফে কুলু খালেক, মা মর্জিনা বেগম, রেফাত উল্লাহ, মোহাম্মাদ আলী খান, রফিকুল ইসলাম, রাকিবুল হাসান রাসেল, বজলুস সামাদ আদনান, মাহমুদুর রহমান তাপস, আনিসুর রহমান ওরফে আনিসুজ্জামান, আমিনুল ইসলাম, মো, সারোয়ার কামাল, উত্তম কুমার রায়, অনিল দাস, শাহ আলম, আবুল হাসান, মোহাম্মদ আলী খান ও রাকিবুল হাসান।
এছাড়া সাভার পৌরসভার সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান, পৌর নগর পরিকল্পনাবিদ ফারজানা ইসলাম, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের সাবেক উপ-প্রধান পরিদর্শক মো. আব্দুস সামাদ, উপ-প্রধান পরিদর্শক (সাধারণ, ঢাকা বিভাগ ) মো. জামশেদুর রহমান, উপ-প্রধান পরিদর্শক বেলায়েত হোসেন, চট্টগ্রাম বিভাগের পরিদর্শক (প্রকৌশল) মো. ইউসুফ আলী, ঢাকা বিভাগের পরিদর্শক (প্রকৌশল) মো. সহিদুল ইসলাম, রাজউকের ইমারত পরিদর্শক মো. আওলাদ হোসেন, ইতার টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জান্নাতুল ফেরদৌস, মো. শফিকুল ইসলাম ভূইয়া, মনোয়ার হোসেন বিপ্লব, মো. আতাউর রহমান, মো. আব্দুস সালাম, বিদ্যুৎ মিয়া, সৈয়দ শফিকুল ইসলাম জনি, রেজাউল ইসলাম, নান্টু কন্ট্রাকটার, মো. আব্দুল হামিদ, আব্দুল মজিদ, মো. আমিনুল ইসলাম, নয়ন মিয়া, মো. ইউসুফ আলী ও তসলিম এ মামলার আসামি।
এদের মধ্যে আব্দুস সামাদ, জামশেদুর রহমান, বেলায়েত হোসেন, ইউসুফ আলী ও সহিদুল ইসলাম সরকারি কর্মকর্তা।
শুনানিতে যা হল
আসামিদের মধ্যে সোহেল রানা, তার মা-বাবাসহ ছয়জনের পক্ষে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি চান আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ।
অনিল দাস, আবুল হাসান ও শাহ আলম মিঠু- যারা রানাকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় সাহায্য করেছিলেন ও আশ্রয় দিয়েছিলেন, তাদের পক্ষে মো. বোরহান উদ্দিন অব্যাহতির আবেদন করেন।
এছাড়া কারখানা পরিদর্শদকদের পক্ষে মাহফুজ মিয়া ও শেখ বাহারুল আলম এবং সাভার পৌরসভার মেয়র রেফাতউল্লাহর পক্ষে সানাউল্লাহ মিয়া অব্যাহতির আবেদনের শুনানি করেন।
রানা ও তার মা-বাবার পক্ষে অব্যাহতি চেয়ে বলা হয়, তারা ‘স্বল্প শিক্ষিত’। তন্ময় হাউজিংয়ের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল ওই ভবন নির্মাণের জন্য। পৌরসভায় ‘সঠিক পদ্ধতিতে’ আবেদন করা হয়েছিল। ইমারত নির্মাণ আইন মেনে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ভবনের ফাউন্ডেশন ছিল ১০ তলার; তার মধ্যে মাত্র ছয় তলা নির্মাণ করা হয়েছিল।
এ পর্যায়ে বিচারক বলেন, “ওই ভবনের অনুমোদন ছিল বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে। তাহলে সেখানে কেন কারখানা করা হল?”
সেয়া দুই ঘণ্টা শুনানি শেষে বিচারক আসামি পক্ষের আইনজীবীদের বলেন, “আসামিদের তখনই অব্যাহতি দেওয়া যায়, যখন অভিযোগপত্র পড়ে তাদের পক্ষের কোনো যুক্তি না দেখে, না শুনেই স্বাভাবিকভাবে মনে হয় যে তারা কোনো অপরাধই করেনি। এছাড়া মামলার বিচার শুরু করে সাক্ষ্য প্রমাণ, যুক্তিতর্ক শেষে যদি অব্যাহতি পাওয়ার জন্য জোড়ালো অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে তাদের খালাসের রায় দেওয়া যায়। এটাই আইনের বেসিক প্রিন্সিপাল।
“ভবন নির্মাণ ত্রুটি, ভবনের কাগজপত্রে জালিয়াতি, বাণিজ্যিক ভবনে কারখানা বসানো, ভবন ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও শ্রমিকদের জোর করে সেখানে কাজ করতে বাধ্য করার জন্য অবশ্যই আসামিরা দোষী বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। আদালতে সাক্ষীদের জেরা, যুক্তিতর্ক নেওয়ার পর যদি এর বাইরে কিছু থাকে যে তারা নির্দোষ, তবে খালাস দেব।”