পঞ্চম ধাপে ‘তুলনামূলক ভালো’র আশা ইসির

অনিয়মের অভিযোগ ও গোলযোগ-সহিংসতার মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের চার ধাপের ভোটের পর পঞ্চম ধাপে ৭১৭ ইউপিতে ভোটগ্রহণ চলছে শনিবার।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 May 2016, 04:34 PM
Updated : 28 May 2016, 04:05 AM

সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত একটানা এই ভোট চলবে। প্রতিবারের মতো এবারও নির্বাচনী এলাকায় ঘোষণা করা হয়েছে সাধারণ ছুটি। 

এই ৭১৭ ইউনিয়নের ভোটাররা তিন হাজারের বেশি চেয়ারম্যান প্রার্থী এবং সাধারণ ও সংরক্ষিত সদস্য পদে প্রায় ৩০ হাজার প্রার্থীর মধ্যে থেকে তাদের জনপ্রতিনিধি বেছে নেবেন।

ভোটের দিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী টহল শুরু করেছে আগেই। শুক্রবার কেন্দ্রে কেন্দ্রে ব্যালট পেপার ও নির্বাচনী সরঞ্জাম পৌঁছে দিয়েছেন নির্বাচনী কর্মকর্তারা।

নির্বাচন কমিশন বলছে, আগের চার ধাপের তুলনায় এবার ‘তুলনামূলকভাবে ভালো’ নির্বাচন আশা করছে তারা। সেই লক্ষ্যে সব ধরনের প্রস্তুতিই নেওয়া হয়েছে।

তবে ভোট ঘিরে প্রায় প্রতিদিনই সহিংসতা-গোলযোগের খবরে ‘ভালোর আশা’ উবে গেছে পর্যবেক্ষক মহলের। তারা বলছেন, তৃণমূলের এ ভোটের দীর্ঘমেয়াদী যে নেতিবাচক প্রভাব সাধারণের মধ্যে পড়ছে; আগামীতে তা কাটাতে সময় লাগবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউপিতে প্রথমবারের মতো দলীয় এ নির্বাচনে ‘বিদ্রোহীদের’ কারণেই গোলযোগ বেশি হচ্ছে। দলের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার পর অনেকেই ‘যে কোনো মূল্যে’ জয় পেতে মরিয়া হওয়ায় সহিংসতা বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে দলগুলোকেও তাদের প্রার্থী-সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থতার দায় নিতে হবে।

ইউপি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে গত সাড়ে তিন মাসে সহিংসতায় ৮০ জনের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। সংঘর্ষ-হামলার ঘটনা ঘটছে প্রায় প্রতিদিনই। নড়াইল, কুষ্টিয়া, যশোর, পাবনাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে সংঘাতের খবর এসেছে গত ২৪ ঘণ্টায়।

পঞ্চম ধাপের ভোট তথ্য

>> ভোট ৪৫ জেলার ৯৩ উপজেলার ৭১৭ ইউপিতে।

>> ভোটার ১ কোটি ১০ লাখের বেশি।

>> ছয় হাজার ৪৮৪ ভোট কেন্দ্রে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা হবে ভোট চলবে।

>> চেয়ারম্যান পদে ৩ হাজার ২৫৪ জন, সাধারণ সদস্য পদে ২৭ হাজারের বেশি ও সংরক্ষিত সদস্য পদে ৭ হাজারের বেশি প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

>> চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের ৪১ জন ইতোমধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।

>> ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার জয়লস্কর ইউপি’র সব পদে (চেয়ারম্যান, সাধারণ ৯ ও সংরক্ষিত ৩) বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত।

>> এক লাখের বেশি ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেড় লাখের মতো সদস্য নিয়োজিত থাকছেন ভোটের দায়িত্বে।

পর্যবেক্ষক সংগঠনগুলোর মোর্চা ‘ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ’ এর পরিচালক আব্দুল আলীম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বলেন, “শুরুতেই ভুলটা করেছে ইসি। কেন্দ্রীয়ভাবে কমিশনারের নেতৃত্বে একটি কমিটি, নির্বাচন কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে জেলা পর্যায়ে তদারকি এবং দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ব্যবস্থা করা হলে, ইসি তাদের শাস্ত দেওয়ার ক্ষমতা যথাযথভাবে প্রয়োগ করলে এতো সহিংসতা হত না।”

যেভাবে গত চার ধাপের ভোট হয়েছে, তাতে এবারও শঙ্কা-উদ্বেগ কাটছে না বলে জানালেন আলীম।

“সহিংসতা না হোক- তাই যেন হয়। সহিংসতা রোধে ইসি যতটুকু পারছে করছে, দলগুলোকেও এসব নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে হবে। তা না হলে দীর্ঘমেয়াদে ভোট নিয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে,” বলেন আলীম।

জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদ- জানিপপ এর চেয়াম্যান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যে কোনো মূল্যে জেতার মানসিকতাই সহিংসতা বাড়িয়ে তুলছে। দলের মনোনয়ন বঞ্চিতরা শৃঙ্খলা ভঙ্গের পর ‘ডু অর ডাই’ পজিশনে চলে যায়। জিততে না পারলে অবস্থা আরও খারাপ হবে ভেবে তারা গোলযোগ সৃষ্টি করছে। চার ধাপে যা হয়েছে, তার চেয়ে ভালো নির্বাচন করতে গেলে ইসিকে ভোটের দিন মাঠে পরিদর্শনে যেতেই হবে।”

(ফাইল ছবি)

কলিমুল্লাহর মতে, ভোটের মাঠে আইন শৃঙ্খলাবাহিনী ‘যথাযথ ভূমিকা নিলে প্রাণহানি এড়ানো সম্ভব। এক্ষেত্রে দলগুলোকেও সহায়তা করতে হবে।

“শেষ ভালো যার, সব ভালো তার। আমরা চাই- শেষ দুই ধাপের ভোট ভালোভাবে করে ইসির ভাবমূর্তিও ভালো হোক।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মিজানুর রহমান শেলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ইসিকেই প্রমাণ করতে হবে যে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট সম্ভব। মানুষের আস্থা অর্জনে ইসিকে এখনই পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।”

বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সুষ্ঠু ভোটের কোনো সম্ভাবনা তারা দেখছে না। তাদের ভাষায়, এখন ভোটের নামে ‘ডাকাতি’  চলছে।

অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ নির্বাচন ‘সুষ্ঠু হচ্ছে’ দাবি করে পাল্টা অভিযোগে বলেছে, বিএনপি এ ভোটকে ‘বিতর্কিত’ করতে ‘ষড়যন্ত্র’ করে আসছে।

নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাকি দুই ধাপের আরও ভালো করতে যা যা করা দরকার তাই করা হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীসহ নির্বাচন কর্মকর্তাদের অনিয়ম-গোলযোগ রোধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছি আমরা।”

শেষ পর্যন্ত ‘তুলনামূলকভাবে ভালো’ নির্বাচনের প্রত্যাশার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা প্রশাসন, পুলিশ, নির্বাচন কর্মকর্তা ও রিটার্নিং কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। ভোটের দিন প্রতিনিয়ত মনিটরিং করব। কোনো অনিয়ম পেলেই কেন্দ্র বন্ধসহ কঠোর ব্যবস্থা নেব।”

পঞ্চম ধাপের ভোট সামনে রেখে সিইসি বলেছেন, সহিংসতা যাতে না ঘটে সে বিষয়ে ইসি সজাগ রয়েছে।

“প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও সমর্থকদের বলছি- ধৈর্য্য ধরেন। কারও মাথায় বাড়ি মেরে বা নিজেদের মধ্যে হানাহানির প্রয়োজন নেই।  আশা করি, চতুর্থ ধাপের তুলনায় আগামী দুই ধাপের নির্বাচন অনিয়ম ছাড়াই শান্তিপূর্ণ হবে,” বলেন কাজী রকিব।

চার ধাপের ফল: আ. লীগ ১৮৩৬, বিএনপি ২৪৩

স্থানীয় সরকারের সবচেয়ে তৃণমূলের এই নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে এবারই প্রথম দলীয় প্রতীকে ভোট হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের হিসাবে, প্রথম ধাপে ৭৪ শতাংশ, দ্বিতীয় ধাপে ৭৮ শতাংশ, তৃতীয় ধাপে ৭৬ শতাংশ ও চতুর্থ ধাপে ৭৭ শতাংশ ভোট পড়েছে।

>> প্রথম ধাপের চূড়ান্ত ফলে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান হয়েছেন ৪৯৪ জন ও বিএনপির ৫০ জন। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় পান ১০৯ ইউপিতে। আর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের ৫৪ জন।

>> দ্বিতীয় ধাপে নৌকা প্রতীকের ৪১৯ জন ও ধানের শীষের ৬৩ জন বিজয়ী হন। ১১৭ ইউপিতে জয় পান স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এ ধাপে আওয়ামী লীগের ৩৪ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।

>> তৃতীয় ধাপের ভোটে আওয়ামী লীগ থেকে চেয়ারম্যান হয়েছেন ৩৬৬ জন; বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন ২৯ জন। এ ধাপে বিএনপি প্রার্থীরা ৬০টি ইউপিতে জয়ী হয়েছেন; স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় পান ১৩৯ ইউপিতে।

>> চতুর্থ ধাপে নৌকা প্রতীকের ৪০৫ জন জয়ী হয়েছেন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ৩৫ জন। বিএনপির ৭০ জন ও ১৬১ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী জয় পেয়েছেন এ ধাপে।