সুপ্রিম কোর্টে নিষ্পত্তি হওয়া ১৬৮টি মামলার পুনঃশুনানি হচ্ছে না; এক মাসের মধ্যেই এসব মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা।
Published : 05 May 2016, 10:08 AM
ওই ১৬৮ মামলার বিষয়টি বৃহস্পতিবার আদেশের জন্য চার সদস্যের আপিল বেঞ্চে উঠলে প্রধান বিচারপতি আইনজীবীদের বলেন, “আমরা যাচাই বাছাই করছি। এসব (পুনঃশুনানি) হচ্ছে না।”
তিনি বলেন, “আপনাদের আমি কথা দিচ্ছি। সব রায় এক মাসের মধ্যে দিয়ে দেব। আমি দায়িত্ব নিয়েছি।”
পরে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের জানান, পুনঃশুনানি না হলে এসব মামলায় ঘোষিত রায় বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে যেহেতু আগে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারক অবসরে চলে যাওয়ায় রায় লিখে সই করতে পারেননি, সেহেতু নতুন বিচারককে রায় লেখার দায়িত্ব দেওয়া হবে।
অবসরের পর রায় লেখা ‘সংবিধান পরিপন্থি’ বলে প্রধান বিচারপতির মন্তব্যের তিন মাসের মাথায় গত ২৮ এপ্রিল পূর্ণাঙ্গ রায় না হওয়া ওই ১৬৮টি মামলা সুপ্রিম কোর্টের কার্যতালিকায় দেখা যায়।
প্রধান বিচারপতির একান্ত সচিব (আপিল বিভাগ) মো. আনিসুর রহমান সেদিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়া ১৬৮টি মামলা পুনঃশুনানির জন্য রাখা হয়েছে।”
সুপ্রিম কোর্টের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, মামলাগুলোর মধ্যে ১৬১টি মামলা যে বেঞ্চে নিষ্পত্তি হয়েছিল, সেই বেঞ্চে বিচারক হিসাবে বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ছিলেন। আর ৭টি মামলায় বিচারক হিসাবে ছিলেন অবসরে যাওয়া প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন।
বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন বাংলাদেশের ২০তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে অবসরে যান। আর বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী অবসরে যান গত অক্টোবরে।
২০১৩ সাল থেকে এই দুই বিচারক অবসর নেওয়ার আগ পর্যন্ত এই ১৬৮ মামলার নিষ্পত্তি এবং সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষিত হলেও পূর্ণাঙ্গ রায় এখনও প্রকাশিত হয়নি বলে ওই কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন।
এসব মামলা আবার আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় আসার প্রেক্ষাপটে বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন গত রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘পুনঃশুনানির কোনো সুযোগ নেই। আমাদের সুপ্রিম কোর্ট রুলসে নেই, সংবিধানেও নেই, আইনেও নেই।’
আর বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে বলেন, এটি ‘নজিরবিহীন’ এবং ‘পরিহাসের মতো’ । এর ফলে আদালতের ‘মূল্যবান সময় নষ্ট হবে’ ।
বৃহস্পতিবার আদালত বসার পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদের উপস্থিতিতে আইনজীবীদের প্রধান বিচারপতি এই বিষয়ে তার সিদ্ধান্ত বলেন।
তিনি বলেন, “অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে সহকর্মীরা সহায়তা করছেন। দুই একটি মামলায় পেপারবুক লাগতে পারে। অনেক দূর জল গড়িয়েছে। কেউ কেউ মারাও গেছেন। চার-পাঁচ বছর আগের মামলাও আছে। কিছু অ্যানোমালিও আছে। দু-চারটি মামলায় প্রয়োজনে রিহেয়ারিং হতে পারে।”
তবে এক মাসের মধ্যে এসব মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হবে বলে আশ্বস্ত করেন প্রধান বিচারপতি।
পরে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম নিজের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “পুনঃশুনানির কোনো বিষয় ছিল না। ১৬৮টি মামলার ভেতরে অনেকগুলো লিভ পিটিশন, আর অনেকগুলো আপিল- এগুলোর নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। কিন্তু রায়গুলো লেখা হয়নি।”
তিনি বলেন, ঘোষিত রায় এখনো প্রকাশ না হওয়ায় জনগণের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তারা রায় না পেয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে পারছেন না। এ বিবেচনায় প্রধান বিচারপতি মামলাগুলো তালিকায় এনেছেন আদেশের জন্য।
“উনি আজ ওপেন কোর্টে আমাদের বলে দিয়েছেন, আগে যেসব মৌখিক আদেশ দেওয়া হয়েছিল, যে রায় ঘোষণা করা হয়েছিল তা-ই বহাল থাকবে। অর্থাৎ, যে সমস্ত পিটিশনে লিভ দেওয়া হয়েছিল সেগুলো লিভ দেওয়া হবে। যেগুলো খারিজ করা দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো খারিজ আদেশই বহাল থাকবে। তবে বিশেষ কিছু মামলা, বা দু’চারটি মামলায় পুনঃশুনানির প্রয়োজন হতে পারে। সেক্ষেত্রে তিনি আইনজীবীদের জানিয়ে শুনানি করবেন।”
প্রধান বিচারপতি এক মাসের মধ্যে রায় প্রকাশের আশার কথা বলেছেন জানিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “আগে যাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, সে দায়িত্বটা পরিবর্তন হবে। যেহেতু দায়িত্ব পাওয়ার পরে রায়টা লিখিত হয়নি, এজন্য এটা এখন অথর জাজ রায় যিনি লিখবেন সেই বিচারপতির পরিবর্তন হবে।”
কোন কোন বিচারকের দেওয়া রায়ের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন হবে জানতে চাইলে মাহবুবে আলম বলেন, “সেটা জানা যায়নি।”
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা হিসেবে বিষয়টি কীভাবে দেখছেন- এমন প্রশ্নে মাহবুবে আলম বলেন, “এটা সাধারণ জনগণ বা বিচারপ্রার্থীদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে নেওয়া হয়েছে। প্রধান বিচারপতির এই সিদ্ধান্ত অন্য কোনো বিচারপতিকে হেয় করার জন্য বা তাকে অবমূল্যায়ন করার জন্য করেননি। উনি এটা করেছেন আমাদের বিচার ব্যবস্থাকে আরও গতিশীল করার জন্য, আমাদের সাধারণ বিচারপ্রার্থী ব্যক্তিদের সুবিধার জন্য।”
এই সিদ্ধান্তের ফলে অবসরের পর রায় লেখা বন্ধ হবে কি না- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, “এর সঙ্গে ওটার সম্পর্ক নাই। এটা নির্ভর করবে কেস টু কেসে। এখন অনেক মামলা আছে যেটা বিরাট কনস্টিটিউশনাল ম্যাটার। সে ম্যাটারটা হয়তো পরে দেখার প্রয়োজন হতে পারে। তবে যেহেতু প্রশ্নটা উঠেছে, আমরা আশা করব- এখন যারা অবসরে যাবেন তাদের রায় লেখার দায়িত্ব হয়তো দেওয়া হবে না।”
এই ১৬৮ রায়ে পরিবর্তন আসবে কি-না জানতে চাইলে মাহবুবে আলম বলেন, “সাধারণভাবে আগে যে রায় ছিল সেই রায় বহাল থাকার সম্ভাবনাই বেশি।”
চলতি বছর ১৭ জানুয়ারি নিজের দায়িত্ব নেওয়ার বছর পূর্তিতে এক বাণীতে বর্তমান প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বলেছিলেন, “কোনো কোনো বিচারপতি রায় লিখতে অস্বাভাবিক বিলম্ব করেন। আবার কেউ কেউ অবসর গ্রহণের দীর্ঘদিন পর পর্যন্ত রায় লেখা অব্যাহত রাখেন, যা আইন ও সংবিধান পরিপন্থি।”
আইনবিদদের মধ্যে এ নিয়ে তখন ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি করে, যা রাজনৈতিক বিতর্কেও গড়ায়।
তুমুল আলোচনার মধ্যে অবসরের পর লেখা নিজের রায় ও আদেশগুলো গত ফেব্রুয়ারিতে ও মার্চে জমা দিয়েছিলেন গত অক্টোবরে অবসরে যাওয়া আপিল বিভাগের বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী, যিনি বিচারপতি সিনহার সমালোচক।
এরপর গত মাসে একটি মামলায় বিচারপতি সিনহা নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর্যবেক্ষণে রায়ে দ্রুত সই করতে বিচারকদের তাগিদ দিয়ে বলা হয়, ব্যতিক্রমী মামলার ক্ষেত্রেও রায় ঘোষণার ছয় মাসের মধ্যে তাতে সই করতে হবে।
তারপর সুপ্রিম কোর্টের কার্যতালিকায় দেড় শতাধিক মামলা ‘পুনঃশুনানির’ জন্য রাখা দেখা যায়। তবে বৃহস্পতিবার মামলাগুলো প্রধানবিচারপতি নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে আসে ‘আদেশের’ জন্য।