ঢাকার রামপুরায় দুই ভাই-বোনের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনাটিকে হত্যাকাণ্ড ধরে তদন্তে নানা দিক বিবেচনা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী; যার মধ্যে পারিবারিক কলহের বিষয়টিও রয়েছে।
Published : 02 Mar 2016, 07:36 PM
পারিবারিক বিরোধের বিষয়ে প্রতিবেশী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সন্দেহ প্রকাশের পর র্যাবের কয়েকজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এরকম ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
“আমরা সন্দেহ করছি অনেক কিছু,” বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালও।
রামপুরা থানার ওসি রফিকুল ইসলাম বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওই বাসা থেকে সংগ্রহ করা খাবারের কিছু অংশ, বালিশ আলামত হিসেবে জব্দ করে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।”
গত সোমবার বিকালে বনশ্রীতে নিজেদের বাসায় দুই শিশু নুসরাত আমান অরণী (১৪) এবং তার ভাই আলভী আমানকে (৬) বিছানায় মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
চাইনিজ রেস্তোরাঁ থেকে আনা খাবার খেয়ে শিশু দুটির মৃত্যুর সন্দেহের কথা পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হলেও পরদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্তে মেলে হত্যাকাণ্ডের আলামত।
এরপর থানা পুলিশের সঙ্গে র্যাবও বিষয়টির তদন্তে নামে।
রামপুরা থানার ওসি বলেন, “হাসপাতাল থেকে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন এখনও পাইনি। তবে প্রাথমিক আলামতের ভিত্তিতে আমাদের ধারণা এটি হত্যাকাণ্ড। মামলা হলে পারিবারিক বিরোধসহ অন্যান্য বিষয়গুলোকে তদন্তের মধ্যে নিয়ে আসব।”
পুলিশের জব্দ করা আলামত ডিএনএ প্রোফাইলিং ও রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে আবেদন করে অনুমতিও বুধবার নিয়েছেন রামপুরা থানার এসআই সোমেন কুমার বড়ুয়া।
ময়নাতদন্তে হত্যার আলামত পাওয়ার পর মঙ্গলবারই ভবনের দুই দারোয়ান, গৃহশিক্ষিকা এবং এক আত্মীয়কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য র্যাব-৩ ক্যাম্পে নেওয়া হয়। তারা এখনও র্যাব হেফাজতে রয়েছেন।
বুধবার জামালপুর থেকে শিশু দুটির বাবা, মা ও খালাকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ঢাকায় আনা হয়েছে।
র্যাব-৩ এর অধিনায়ক খন্দকার গোলাম সরোয়ার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কীভাবে শিশুদের মৃত্যু হয়েছে সেটি জানতে তাদের বাবা, মা ও খালাকে র্যাব-৩ এ আনা হচ্ছে। তাদের থেকে জানতে চাওয়া হবে আসলে কীভাবে তাদের সন্তানরা মারা গেল।”
মৃত্যুর পর বিনা বাধায় একসঙ্গে অনেকের ঢোকার কারণে আলামত নষ্ট হয়েছে কি না- জানতে চাইলে র্যাবের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটি যারা তদন্ত করবে তারা বলতে পারবে। দুই শিশুর মৃত্যুর কারণ আসলে কী, সেটা আগে উদঘাটন করতে হবে।”
বনশ্রীর বি ব্লকের ৪ নম্বর রোডের ৯ নম্বরের সপ্তম তলার ওই বাসাটির পঞ্চম তলায় তৈরি পোশাক ব্যবসায়ী আমানুল্লাহ তার স্ত্রী মাহফুজা মালেক জেসমিন, দুই সন্তান ও বৃদ্ধা মাকে নিয়ে থাকতেন। বাসায় প্রবেশের জন্য একটি পথ; সিঁড়ি ও লিফট দুইভাবে বাসায় যাওয়া যায়।
বুধবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাসায় কারা আসছেন বা যাচ্ছেন তা নজরদারিতে সিসি ক্যামেরা না থাকলেও বাড়ির দারোয়ার সব সময় অবস্থান করেন। বাড়িতে কেউ প্রবেশ করলে আগে দারোয়ানের সঙ্গে কথা বলেই বাসায় ঢুকতে হয়।
বনশ্রী আইডিয়াল স্কুলের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক মোহাম্মদ আবদুল কাদের ফ্ল্যাটটির মালিক। তিনি বাসায় না থাকায় বুধবার সাংবাদিকদের ঢুকতে দেননি দারোয়ান।
মাহফুজা ও আমানুল্লাহ সম্পর্কে চাচাত ভাই-বোন।
দুই শিশুর মামা খোকন বুধবার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওদের মৃত্যুর ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে পড়েছি। এ মৃত্যু মেনে নেওয়া কঠিন। কীভাবে কী হল, কিছু বুঝতে পারছি না।”
আমানুল্লাহর বন্ধু জাহিদ হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তাদের ব্যক্তিগত বিষয়ে কিছু জানা নেই। তবে যতদূর জানি তার কারও সঙ্গে তেমন বিরোধ নেই।
“আসলে বিষয়টা যে কীভাবে ঘটল, কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি সত্যিই হতবাক হয়ে গেছি।”
প্রতিবেশী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় ঘটনা
আমানুল্লাহর ফ্ল্যাটে বেশি মানুষের যাতায়াত ছিল না বলে জানিয়েছেন ভবন মালিক আবদুল কাদেরের ছেলে নাজমুস সাকিব।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তার বাবার বন্ধু শফিকুল ইসলামের বন্ধু ছিলেন আমানুল্লাহ। সেই সূত্রে গত বছরের অগাস্ট মাসে ৯ হাজার টাকা ভাড়ায় তিনি পাঁচতলায় ফ্ল্যাটে উঠেন।
অরণী ও আলভী সম্পর্কে সাকিব বলেন, “অরণীর সঙ্গে কখনও কথা হয়নি। তবে গ্যারেজে ক্রিকেট খেলার সময় দেখেছি সে মায়ের সঙ্গে কোচিং থেকে ফিরছে বা যাচ্ছে। বাসায় আরও দুইজন মহিলা শিক্ষকের কাছেও তারা পড়ত।
“আলভী ছোট হলেও অন্যান্য বাচ্চাদের মতো চঞ্চল ছিল না। ফ্ল্যাটের অন্য ছেলেরা বিকালে যখন ক্রিকেট খেলত, তখন আলভী প্রায়ই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকত।”
যে রেস্তোরাঁর খাবার খেয়ে অরণী ও আলভীর মৃত্যু হয়েছে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, সেখানকার খাবারের মান ভাল বলে দাবি করেন সাকিব।
“এলাকার প্রায় সবাই কান্ট রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া করে। ওখানে কেউ খেয়ে মারা যেতে পারে তা বিশ্বাসযোগ্য না।”
পরিবারের অভিযোগের পর পুলিশ ওই রেস্তোরাঁর তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। তারা এখন কারাগারে রয়েছেন।
বি ব্লকে অবস্থিত ওই বাড়িটি থেকে সামনের দিকে অন্তত ১৫ থেকে ২০ মিনিট হেঁটে গেলে সি ব্লকে কান্ট রেস্টুরেন্ট।
এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কান্ট রেস্টুরেন্টটি ওই এলাকার অনেক পুরনো রেস্টুরেন্ট। এলাকায় অনেক ফাস্টফুড ও চাইনিজ রেস্তোরাঁ থাকলেও অধিকাংশ মানুষ কান্ট চাইনিজ থেকে খাবার কেনেন।
দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে নানা ধরনের কথা শোনা গেছে স্থানীয়দের কাছে। সন্তানদের লাশ মর্গে রেখে বাবা-মায়ের জামালপুর চলে যাওয়া নিয়েও প্রশ্ন কারও কারও মনে।
অরণী ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে পঞ্চম শ্রেণিতে এবং আলভী হলি ক্রিসেন্ট স্কুলে নার্সারিতে পড়ত।
আলভী স্কুলের পপি নামে এক অভিভাবক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সোমবার দুপুরের দিকে দুই শিশুর মারা যাওয়ার খবর পেয়ে এলাকাবাসীসহ আমিও ওই বাড়িতে ছুটে গিয়েছিলাম। বাড়ির রান্নাঘরের এক জায়গায় কাদার মত ময়লা জমে ছিল, মনে হচ্ছিল রান্নাঘর অনেকদিন ধরে ব্যবহার হয় না।
“পুরো বাসা ছিল এলোমেলো ও অগোছালো, যেই ঘরে শিশুগুলোর মৃত্যু হয়েছে বলে বলা হচ্ছিল ওই ঘরের বিছানায় কোনো চাদর ছিল না।”
হলি ক্রিসেন্ট স্কুলের প্রধান শিক্ষক শামীমা খাতুন বলেন, “বেলা ২টার দিকে আলভী মারা গেছে শুনে ওদের বাসায় যখন গিয়েছিলাম তখন দেখলাম ওদের বাবা ও মা দুইজন আলাদা ঘরে বসে আছেন। ওর মা আমার হাতটা ধরে কান্না করেছিল, কোনো কথা বলেনি।”
হলি ক্রিসেন্ট স্কুলের নিরাপত্তা রক্ষী খায়রুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সোমবার আলভী স্কুলে আসার পর তার হাত ধরলে সে ব্যথায় ছটফট করে ওঠে। তাকে মারধর করা হয়েছে বলে জানায়।”
পপি নামে ওই অভিভাবক এ বিষয়ে বলেন, “স্কুলের ভেতরে এক আপা আছেন তার মেয়ে নার্সারিতে আলভীর সঙ্গে পড়ত। দুই একদিন আগে তার মেয়ে আলভির হাতে আঘাতের চিহ্ন দেখে কী হয়েছে জানতে চাইলে আলভী বলেছিল- তার মা অনেক মেরেছে।”
মৃত্যুর দিনই সকালে অরণীর ডান চোখে জমাট বাঁধা রক্ত দেখেছিল তার সহপাঠীরা। তবে ক্লাসে সব সময়ের মতো সেদিনও সে শান্ত ছিল বলে তারা জানায়।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ সুফিয়া খাতুন বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ঘটনা শোনার পরপরই কয়েকজন শিক্ষক অরণীর বাসায় গিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, অরণী অত্যন্ত শান্ত ছিল। নিয়মিত ক্লাস করত এবং পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিল।
অরণীর সহপাঠীরা তার ডান চোখে জমাট বাঁধা রক্ত দেখেছে বলে জানান অধ্যক্ষও।
“চোখে রক্ত কেন সহপাঠীদের এমন প্রশ্নের জবাবে অরণী বলেছিল কলমের খোঁচা লেগে এমনটি হয়েছে।”
‘হত্যাজনিত’ মৃত্যুর সন্দেহের কথা জানিয়ে ঢাকা মেডিকেলের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ সোহেল মাহমুদ বলেছিলেন, দুটি বাচ্চার গলায় তারা ‘দাগ’ পেয়েছেন। সেখানে আঙুলের ছাপও ছিল। থুতনিসহ বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন ছিল। দুজনেরই জিহ্বায় কামড় লেগে ছিল।