একাত্তরে নৃশংসতার বিচারের জন্য যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরুর পর এর বিরোধীরা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ন্যায়বিচারের দাবি জানিয়ে আসছিলেন।
Published : 30 Sep 2015, 08:39 PM
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের আপিলের রায়ে সর্বোচ্চ আদালত বলেছে, একাত্তরের পাশবিক নিষ্ঠুরতার জন্য তৎকালীন এই আল বদর নেতার মৃত্যুদণ্ডই ন্যায়বিচার।
“এই ধরনের নিষ্ঠুরতা ও প্রমাণ পাওয়ার পর অপরাধী সর্বোচ্চ দণ্ড না পেলে তা ন্যায়বিচারের উপহাস হয়ে যাবে,” চূড়ান্ত রায়ে এই মন্তব্য এসেছে আপিল বিভাগ থেকে।
আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে মুজাহিদের আপিলের শুনানি শেষে গত ১৬ জুন রায় দিয়েছিল আপিল বিভাগ।
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার সদস্যের ওই বেঞ্চের দেওয়া ১৯১ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় বুধবার প্রকাশের পর পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ট্রাইব্যুনালে।
এদিন যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ও প্রকাশিত হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বিএনপির এই নেতার ক্ষেত্রেও বহাল রেখেছে আপিল বিভাগ।
মুজাহিদের চূড়ান্ত রায়ে উঠে এসেছে, একাত্তরের ডিসেম্বরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল, তখনও যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চাইছিলেন মুজাহিদ।
“আপিলকারীর উচিত ছিল, এই অপরাধ প্রতিহত করা, তিনি সেটা না করে উল্টো আল বদর বাহিনীর অন্য সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে গণহত্যার পরিকল্পনা করেন, অংশগ্রহণ করেন এবং উসকানি দেন। এমনকি পাক বাহিনী আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর ১৬ ডিসেম্বর সকালে বিজয়ের পূর্ব মূহূর্তে অস্ত্র আনতে ক্যান্টনমেন্টে ছুটে যান। সেখানে উচ্চ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে তাদেরকে অস্ত্র প্রদানের দাবি জানান, যা মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য তাদেরকে দেওয়ার কথা ছিল।”
একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের পক্ষে নেমে গড়ে তুলেছিল রাজাকার বাহিনী। আর তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা-কর্মীদের নিয়ে গঠন করে আল বদর বাহিনী।
১৯৭১ সালের শুরুতে ছাত্রসংঘের ঢাকা জেলা শাখার সভাপতি মুজাহিদ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর জুলাই মাসে সংগঠনের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সেক্রেটারি এবং এরপর প্রাদেশিক সভাপতির দায়িত্ব পান।
১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আল বদর বাহিনীর নেতৃত্ব দেন ইসলামী ছাত্রসংঘের তখনকার সভাপতি ও জামায়াতের বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী (তিনিও যুদ্ধাপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত)। অক্টোবরে ওই বাহিনীর প্রধান হন মুজাহিদ।
আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধকালীন আপিলকারীর (মুজাহিদ) কর্মকাণ্ড সম্পর্কিত প্রমাণাদিতে চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হয়, তিনি একাত্তরে আল বদর নেতা ছিলেন।
“নিজেরা ভোট না পাওয়ায় যুদ্ধ শুরুর পূর্বে ইসলামী ছাত্র সংঘ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে দেওয়া জনগণের রায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এ কারণে মুজাহিদসহ ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যরা পাক বাহিনীর সমর্থনে আল বদর বাহিনী গঠন করে এবং সাধারণভাবে জনগণের বিরুদ্ধে এবং সুনির্দিষ্টভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে।”
১৯৭০ সালের ওই নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬০ আসন পায় আওয়ামী লীগ, যার সবগুলোই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। এই প্রদেশের অন্য দুই আসনের একটি পিডিপি এবং অন্যটি একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হন।
অন্যদিকে প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় ২৮৮ আসন। পিএমএল (কনভেনশন), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালি) ও জামায়াত একটি করে আসন পায়।
বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে আল বদর বাহিনীর সম্পৃক্ততার বিষয়ে রায়ে বলা হয়, “মৌখিক ও দালিলিক সাক্ষ্য-প্রমাণে আমাদের কোনো দ্বিধা নেই, মুজাহিদের প্ররোচনায়, তারই নির্দেশনা, উসকানি ও সহায়তা এবং নেতৃত্বে আল বদর বাহিনী বিজয়ের পূর্ব মুহূর্তে বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ ও হত্যা করে।
“এটা ঠাণ্ডা মাথার হিংস্রতা। তার উসকানিতে সংগঠিত এই ধরনের বর্বর, ভয়াবহ, নিষ্ঠুর অপরাধ কেবল হিটলারের গ্যাস চেম্বার গণহত্যার সঙ্গেই তুলনা করা যায়। পুরো পৃথিবী আল বদর বাহিনীর এই নিষ্ঠুরতা ও গণহত্যা দেখেছে।”
আদালত বলে, “অবশ্যই তিনি (মুজাহিদ) একজন যুদ্ধাপরাধী। তার আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে হওয়া অপরাধ অবশ্যই বিভীষিকাময়, ঠাণ্ডা মাথায় নৃশংসতা।
“আমরা যদি অপরাধ সংগঠনের ধরন, ব্যবহৃত অস্ত্র, অপরাধের নির্মমতা, নিহত মানুষের সংখ্যা, ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের অসহায়ত্বের দিকে দৃষ্টি দেই, তাহলে একটা উপসংহারই আমরা কেবল টানতে পারি, যাতে ট্রাইব্যুনাল পৌঁছেছিলেন। সেটা হচ্ছে, বুদ্ধিজীবী হত্যার মতলব হচ্ছে, সুনির্দিষ্ট ছকে ঠাণ্ডা মাথায় নব জন্ম নেওয়া জাতির ভবিষ্যতকে পঙ্গু করে দেওয়া।”
“এই অপরাধের ধরন, মাত্রা এবং সংগঠনের পদ্ধতি বিবেচনায় নিয়ে যথাযথ দণ্ড দেওয়া আদালতের কর্তব্য। ভয়াবহ নিষ্ঠুরতায় এবং পশুর মত করে বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড সংগঠন অপরাধীদের বিকৃত চরিত্রই ফুটিয়ে তোলে। এই ধরনের নিষ্ঠুরতা ও প্রমাণ পাওয়ার পর অপরাধী সর্বোচ্চ দণ্ড না পেলে সেটা ন্যায়বিচারের উপহাস হয়ে যাবে।”
“বিচারকরা তো আইনের অধীনেই দায়িত্ব পালন করে। বুদ্ধিজীবী হত্যায় ট্রাইব্যুনালের দেওয়া শাস্তি অসঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। এই পৃথিবীর মানুষ হিরোশিমা নাগাসাকি ভুলে নাই। এই জাতিও ১৯৭১ কে ভুলে নাই, ভুলবে না।”
স্বাধীনতার পর মুজাহিদ জামায়াতের রাজনীতিতে যুক্ত হন এবং ১৯৮২ সালে কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্য হন। ১৯৮৯ থেকে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালনের পর ২০০০ সালে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল হন তিনি।
কোনো নির্বাচনে জয়ী হতে না পারলেও বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে সমাজকল্যাণমন্ত্রীর দায়িত্ব পান মুজাহিদ। জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের পরিচালনা পর্ষদেরও প্রধান ছিলেন তিনি।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগের একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন মুজাহিদকে আটকের পর ২ অগাস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
মামলার শুনানি শেষে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ২০১২ সালের ২১ জুন ট্রাইব্যুনালে মুজাহিদের বিচার শুরু হয়। ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই ট্রাইব্যুনালে তার ফাঁসি হয়।
সেই রায়ের বিরুদ্ধে মুজাহিদ আপিল করেন। আপিলের রায়ের অনুলিপি বুধবার প্রকাশ হল। এখন বিধি অনুযায়ী রিভিউ (রায় পুনর্বিবেচনার) আবেদনের সুযোগ পাবেন মুজাহিদ। তার নিষ্পত্তি হলে শুরু হবে দণ্ড কার্যকরের প্রক্রিয়া।