বদরপ্রধান মুজাহিদের ফাঁসির আদেশ

চার দশক আগে বাঙালির স্বাধীনতার পথ রুদ্ধ করতে সাংবাদিকসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা ও সাম্প্রদায়িক হত্যা-নির্যাতনের দায়ে আলবদর বাহিনীর প্রধান আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে ফাঁসিকাষ্ঠে যেতে হবে।

গাজী নাসিরউদ্দিন খোকন ও তানিম আহমেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 July 2013, 00:54 AM
Updated : 17 July 2013, 00:54 AM

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বুধবার জনাকীর্ণ আদালতে এই মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেন।

তিনি বলেন, অপহরণ, নিযার্তন ও হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি ঘটনায় মুজাহিদের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়েছে।

তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া না হলে ন্যায়বিচার হবে না বলেও রায়ে উল্লেখ করেন ট্রাইব্যুনাল প্রধান।

বিচার ঠেকাতে সারাদেশে জামায়াতে ইসলামীর ডাকা হরতালের মধ্যেই ‘আমৃত্যু ফাঁসিতে ঝুলিয়ে’ দলটির সেক্রেটারি জেনারেলের মৃত্যুদণ্ড কাযর্কর করার নির্দেশ দেন বিচারক।

মুজাহিদ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করতে গঠিত আলবদর বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন এবং ওই বাহিনীর ওপর তার ‘কার্যকর নিয়ন্ত্রণ’ ছিল বলেও উঠে এসেছে এই রায়ে।

স্বাধীনতার পর চার দশকে এই প্রথম বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করা কোনো রাজনীতিবিদের ফাঁসির আদেশ হলো। বিগত চার দলীয় জোট সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ছিলেন মুজাহিদ।

রায়ের পর উঠে দাঁড়িয়ে ৬৫ বছর বয়সী মুজাহিদ বলে ওঠেন, “এতো বড় একটা অবিচার! ইসলামী আন্দোলন করার কারণেই এ রায় দেয়া হয়েছে।”

এরপর কাঠগড়া থেকে পুলিশ তাকে নামিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত এই জামায়াত নেতা আবারো বলেন, “ইসলামী আন্দোলন চলবে।”

অন্যদিকে সাজা ঘোষণার পর ট্রাইব্যুনালের বাইরে অপেক্ষমাণ মুক্তিযোদ্ধা, রাজধানীর শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আহ্বানে উপস্থিত জনতা এবং আসামির জেলা ফরিদপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এসে উল্লাস প্রকাশ করে।

অপরাধ সংঘটনের চার দশকেরও বেশি সময় পরে পাওয়া এই বিচারের রায় দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানান তারা। 

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনও। তবে রায়ে ‘ভুল’ হয়েছে মন্তব্য করে আপিল করার কথা জানিয়েছেন মুজাহিদের আইনজীবী। 

শহীদ বুদ্ধিজীবী সিরাজুদ্দীন হোসেনের ছেলে ও এ মামলার অন্যতম সাক্ষী ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক শাহীন রেজা নূর রায়ের পর আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে বলেন, “রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। ১০ ডিসেম্বর রাতের কথা খুব মনে পড়ছে এখন। আরো মনে পড়ছে আমার মায়ের কথা। উনি এ বিচার দেখে যেতে পারলেন না বলে খুব মনোকষ্টও হচ্ছে।”

শহীদ আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ এ মামলা পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রসিকিউশন, বিচারক, তদন্ত কর্মকর্তা, সাংবাদিকসহ সবাইকে ধন্যবাদ জানান।

তিনি  বলেন, “পুরো জাতি একসাথে  থাকলে এ রায় বাস্তবায়নে কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।”

আর মুজাহিদের নির্যাতনের শিকার এ মামলার আরেক সাক্ষী একাত্তরের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা জহিরউদ্দিন জালাল ওরফে বিচ্ছু জালাল বলেন, এ রায়ে তিনি আনন্দিত হলেও তখনই পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারবেন, যখন এ রায় বাস্তবায়ন হবে, বাংলার মাটি থেকে জামায়াতকে উচ্ছেদ করতে হবে।

শহীদ আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ

জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের রায়ে গণজাগরণ মঞ্চে উচ্ছ্বাস। ছবি:নয়ন কুমার/ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

ফাঁসি যে কারণে

মুজাহিদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা সাতটি অভিযোগের মধ্যে ১, ৩, ৫, ৬ ও ৭ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে  রায়ে উল্লেখ করেছেন বিচারক। তাবে ২ ও ৪ নম্বর অভিযোগে তার সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়নি। 

প্রথম অভিযোগে সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে অপরণের পর হত্যা এবং ষষ্ঠ অভিযোগে বুদ্ধিজীবীসহ গণহত্যার ষড়যন্ত্র ও ইন্ধনের অভিযোগে ফাঁসির আদেশ হয়েছে এই জামায়াত নেতার। একই রায় হয়েছে সপ্তম অভিযোগে, ফরিদপুরের বকচর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বর্বর হামলা চালিয়ে হত্যা-নিযার্তনের ঘটনায়।

এছাড়া পঞ্চম অভিযোগে সুরকার আলতাফ মাহমুদ, গেরিলা যাদ্ধা জহিরউদ্দিন জালাল ওরফে বিচ্ছু জালাল, শহীদজননী জাহানারা ইমামের ছেলে শাফি ইমাম রুমি, বদিউজ্জামান, আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল ও মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদসহ কয়েকজনকে ঢাকার নাখালপাড়ায় পুরনো এমপি হোস্টেলে আটকে রেখে নির্যাতন এবং জালাল ছাড়া বাকিদের হত্যার ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার জন্য মুজাহিদকে দেয়া হয়েছে যাবজ্জীবন

আর তৃতীয় অভিযোগে ফরিদপুর শহরের খাবাসপুরের রণজিৎ নাথকে অপহরণ ও নির্যাতনের ঘটনায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয় মুজাহিদকে। 

তবে দ্বিতীয় অভিযোগে ফরিদপুরের চরভদ্রাসনে হিন্দু গ্রামে গণহত্যা এবং চতুর্থ অভিযোগে আলফাডাঙ্গার আবু ইউসুফ ওরফে পাখিকে আটকে রেখে নির্যাতনের ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেলেও তাতে মুজাহিদের সংশ্লিষ্টতা প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে পারেনি বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। এ দুটি অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয়েছে মুজাহিদকে। 

দুটি অভিযোগে কারাদণ্ডের কথা বলা হলেও বাকিগুলোতে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্য হওয়ায় বিচারক ‘ফাঁসিতে ঝুলিয়ে’ মুজাহিদের সাজা কার্যকর করতে বলেন।

 

রায় প্রত্যাখ্যান প্রসঙ্গে ট্রাইব্যুনাল

সকাল ৯টা ৪২ এ মুজাহিদকে কেন্দ্রীয় কারাগারের একটি সাদা রঙের মাইক্রোবাসে করে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসার পর তাকে ১০টা ৪০ এ কাঠগড়ায় তোলা হয়। এর আট মিনিট পর তিন বিচারক এজলাসে এসে আসন গ্রহণ করেন। 

শুরুতেই রায়ের ভূমিকা পড়েন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। এরপর ২০৯ পৃষ্ঠার রায়ের ৩৭ পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্তসার পড়া শুরু করেন বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম। অপর বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া পড়েন দ্বিতীয় অংশ।

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শেষে আসামির সাজা ঘোষণা করেন।

রায়ের ভূমিকায় তিনি আদালতের আদেশ প্রত্যাখ্যান, হরতাল ও টক শোর বক্তব্য নিয়ে কথা বলেন। 

“যেদিনই ট্রাইব্যুনাল কোনো মামলা রায়ের জন্য রাখে, সেদিনই হরতাল ডাকা হয়। আর সেই হরতালের অজুহাত ব্যবহার করে মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা আসেন না। তারা প্রতিনিধি পাঠান। প্রতিনিধিরা আসতে পারলে তারা কেন আসতে পারেন না?”

রায় প্রত্যাখ্যান করে বক্তব্য দেয়া আদালত অবমাননারই শামিল বলেও উল্লেখ করেন এই বিচারপতি। 

“আমরা সুপ্রিম কোর্টের বিচারক। রাগ, অনুরাগের ঊর্ধে উঠে রায় দিতে আমরা শপথ নিয়েছি। সুপ্রিম কোর্ট থেকে আমরা এখানে এসেছি। সুতরাং রাগ অনুরাগের বশবর্তী না হয়ে আমরা রায় দেই।

“আমাদের রায়ে ভুলও হতে পারে। সেটা সংশোধনের জায়গা উপরে। গাড়ি ভাংচুর বা প্রত্যাখান করে রায় বদলানো যায় না।”

বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত সংবাদভিত্তিক আলোচনায় ট্রাইব্যুনালের বিচার নিয়ে বক্তব্যের বিষয়ে সতর্ক করে এই বিচারপতি বলেন, “বিচারাধীন বিষয়ে কথা না বলাই ভাল।”

ভবিষ্যতে আর রায়ের দিন হরতাল দেয়া হবে না এবং রায় প্রত্যাখ্যান করা হবে না বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন। 

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত এই ট্রাইব্যুনালের ছয়টি রায়ের মধ্যে প্রথমটি ছাড়া সবগুলো রায়ের দিনই বিচার ঠেকানোর শপথ নিয়ে সারা দেশে হরতাল ও সহিংসতা চালায় জামায়াতে ইসলামী, যারা একাত্তরে সাংগঠনিকভাবে যুদ্ধাপরাধে ভূমিকা রেখেছিল বলে ট্রাইব্যুনালের আগের রায়গুলোতে উঠে এসেছে।

রায়ের পর প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন প্রসিকিউশনের সমন্বয়ক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান

রায়ের পর প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন মুজাহিদের আইনজীবী সাইফুর রহমান

 

প্রতিক্রিয়া

মুজাহিদের ফাঁসির রায়ের পর তার আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আদালত তথ্যপ্রমাণ মূল্যায়নে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা এর বিরুদ্ধে আপিল করব।”

আর মুজাহিদের ছেলে আলী আহমেদ মাবরুর বলেন, ন্যায় বিচার না পাওয়ায় তারা ‘সংক্ষুব্ধ’।

“নিছক কিছু ধারনার উপরে ভিত্তি করে তাকে শাস্তি দেয়া হয়েছে।”

অন্যদিকে প্রসিকিউশনের সমন্বয়ক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান বলেন, “উই আর হ্যাপি।”

এ রায়ের মাধ্যমে জাতি বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিচার পেল বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে সেক্টর কমান্ডার্স  ফোরামের জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান কে এম সফিউল্লাহ বলেন, “ফাঁসির আদেশে আমরা সন্তুষ্ট। তবে বয়স বিবেচনায় গোলাম আযমের ফাঁসি না দেওয়ায় আমাদের ক্ষোভ রয়েছে । এখন আর বিলম্ব নয়, দ্রুত বলবো না, ইমেডিয়েটলি অপরাধীদের রায় কার্যকর করা হোক।”

রায় দ্রুত বাস্তবায়নের আশা প্রকাশ করেন মুক্তিযোদ্ধা ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুও।

ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন বলেন, এ রায়ে প্রমাণ হয়েছে যে জামায়াতে ইসলামী ও তার সহযোগী সংগঠনগুলো যুদ্ধাপরাধে যুক্ত ছিল।

আর যুদ্ধাপরাধীদের হাতে জাতীয় পতাকা তুলে দেয়ার জন্য বিএনপিকে  প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে বলেন মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল হক মামা।

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড হওয়ায় তার নিজ শহর ফরিদপুরে আনন্দ মিছিল হয়।

জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ট্রাইব্যুনালের বাইরে মুক্তিযোদ্ধাদের মিছিল। ছবি:আসাদুজ্জামান প্রামানিক/ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসা গণ জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার বলেন, “৩০ লাখ শহীদের প্রতিনিধি হিসেবে আমাদের উৎফুল্ল হওয়ার কিছু নেই। আমরা ৪২ বছরের প্রতীক্ষিত, প্রত্যাশিত রায় পেয়েছি।”

এ রায়ের জন্য সকাল থেকেই শাহবাগে অবস্থান নিয়ে ছিলেন  গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা। 

মুজাহিদের দল জামায়াতে ইসলাম বরাবরের মতোই রায় প্রত্যাখ্যান করে হরতাল ডেকেছে। দলের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান এক বিবৃতিতে বলেন, জামায়াতকে ‘নেতৃত্বশূন্য’ করার জন্য ‘মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক’ মামলায় ‘সরকার নির্দেশিত’ ছকে মুজাহিদের ফাঁসির রায় দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

জামায়াতের শরিক দল বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এবারো বলেছেন, রায় নিয়ে তারা কিছু বলবে না।

আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেছেন, এ রায়ে তারা সন্তুষ্ট।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলও (জাসদ) রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে।

আর আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলছেন, ‘স্বচ্ছতার সঙ্গে’ সমস্ত মান বজায় রেখে এ বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে এবং এতে জাতির প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে।

বদর নেতা থেকে মন্ত্রী

জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদের জন্ম ১৯৪৮ সালের ২ জানুয়ারি, ফরিদপুর জেলার পশ্চিম খাবাসপুরে।

১৯৬৪ সালে মাধ্যমিক পাসের পর তিনি ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হন এবং উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র থাকাকালেই জামায়াতের তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘে যোগ দেন। ১৯৬৮ সালে তাকে সংগঠনের জেলা শাখার সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭১ সালে বাংলার মানুষের স্বাধীনতার সংগ্রাম যখন চূড়ান্ত পযার্য়ে, সেই বছর জানুয়ারিতে ইসলামী ছাত্রসংঘের ঢাকা জেলা শাখার সভাপতি হন মুজাহিদ। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর জুলাই মাসে সংগঠনের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সেক্রেটারির এবং এরপর প্রাদেশিক সভাপতির দায়িত্ব পান।

মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গঠিত হলে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তার নেতৃত্ব দেন ইসলামী ছাত্রসংঘের তখনকার সভাপতি ও জামায়াতের বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী। অক্টোবরে ওই বাহিনীর প্রধান হন মুজাহিদ। নিজামীর বিরুদ্ধেও যুদ্ধাপরাধের মামলা চলছে।

তার নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী যুদ্ধের মধ্যে ফরিদপুর, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হত্যা, অপহরণ, লুটপাটের মতো ব্যাপক মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড চালায়। এমনকি ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রস্তুতির সময়ও বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণ না করার সিদ্ধান্ত নেন মুজাহিদ।

একাত্তরে তার কর্মকাণ্ডের ঘনিষ্ঠ সহযোগী পলাতক আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারকে ইতোমধ্যে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

স্বাধীনতার পর মুজাহিদ জামায়াতের রাজনীতিতে যুক্ত হন এবং ১৯৮২ সালে কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্য হন। ১৯৮৯ থেকে দুই বছর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালনের পর ২০০০ সালে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল হন তিনি।

কোনো নির্বাচনে জয়ী হতে না পারলেও বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পান মুজাহিদ। জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের পরিচালনা পর্ষদেরও প্রধান তিনি।

যুদ্ধাপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ২০১০ সালের মার্চে জামায়াতে ইসলামীর এক সংবাদ সম্মেলনে মুজাহিদ বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হিসেবে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছে। কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধের মতো কোনো ধরনের অপরাধে জামায়াত নেতারা জড়িত ছিলেন না।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের গাড়িতে ট্রাইব্যুনালের পথে জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। ছবি:বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে যাওয়ার পথে জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। ছবি:বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

মামলার ইতিবৃত্ত

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগের একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে গ্রেপ্তার করার পর ২ অগাস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি মুজাহিদের বিরুদ্ধে ছয় হাজার ৬৮০ পৃষ্ঠার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। এর ১০ দিন পর ট্রাইব্যুনাল তা আমলে নেয়।

এরপর প্রসিকিউশনের আবেদনে মামলাটি দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানেই গত বছর ২১ জুন অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে মুজাহিদের বিচার শুরু হয়।

এরপর ২৬ অগাস্ট শাহরিয়ার কবিরের জবানবন্দি উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাকসহ প্রসিকিউশনের পক্ষে মোট ১৭ জন সাক্ষ্য দেন। সাক্ষীদের মধ্যে একাত্তরের গেরিলা যোদ্ধা জহিরউদ্দিন জালাল ওরফে বিচ্ছু জালাল ও শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের ছেলে সাংবাদিক শাহীন রেজা নূরও ছিলেন।

অন্যদিকে মুজাহিদের পক্ষে সাক্ষ্য দেন কেবল তার ছোট ছেলে আলী আহমাদ মাবরুর।

চলতি বছর ৫ জুন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন বিচারক।

ট্রাইব্যুনালের ষষ্ঠ রায়

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরু হয়। প্রথম রায়ে গত ২১ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ আসে।

৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়, যা প্রত্যাখ্যান করে রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান নেয় হাজার হাজার মানুষ।

যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সেই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে জনতার দাবির মুখে সরকার ট্রাইব্যুনাল আইনে সংশোধন আনে। এর মধ্যে দিয়ে রায়ের বিরুদ্ধে দুই পক্ষেরই আপিলের সমান সুযোগ তৈরি হয়।

তৃতীয় রায়ে নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসি হলে জামায়াতের ঘাঁটি বলে পরিচিত এলাকাগুলোতে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি হিসেবেই পুলিশসহ নিহত হয় ৭০ জনেরও বেশি মানুষ।

এরপর গত ৯ মে জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকেও মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।

আর গত ১৫ জুলাই গোলাম আযমের ৯০ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ হয়। 

আগের রায়গুলোর সময় জামায়াতের সহিংসতার প্রেক্ষাপটে রোববার থেকেই ট্রাইব্যুনাল ঘিরে নেয়া হয় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যরা ট্রাইব্যুনাল ও সুপ্রিম কোর্ট এলাকা ঘিরে নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলেন। ট্রাইব্যুনালে আসা সাংবাদিক ও দর্শনার্থীদেরও কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে তল্লাশি চালিয়ে ট্রাইব্যুনালে প্রবেশ করতে দেয়া হয়।

আগের রায়ের দিনগুলোর মতো এদিনও সকাল থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে মিছিল নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলসহ বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীদের ট্রাইব্যুনালের বাইরে জড়ো হতে দেখা যায়। তারা জামায়াত নিষিদ্ধের দাবিতেও স্লোগান দেন।

 

[আদালতের ভেতরে ও বাইরে থেকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন কামাল তালুকদার, সুলাইমান নিলয়, কাজী শাহরিন হক ও গোলাম মুজতবা ধ্রুব। প্রাসঙ্গিক তথ্য যুগিয়েছেন এহেছান লেনিন, মঈনুল হক চৌধুরী, রিয়াজুল বাশার, শামীম আহমেদ, শহীদুল ইসলাম, আশিক হোসেন, মামুনুর রশিদ, সাজিদুল হক, ও আজিজ হাসান।]