বুদ্ধিজীবীর রক্ত হাতে সমাজকল্যাণের মন্ত্রী

“আল বদর একটি নাম, একটি বিস্ময়! আলবদর একটি প্রতিজ্ঞা! যেখানে তথাকথিত মুক্তিবাহিনী আল বদর সেখানেই! যেখানেই দুষ্কৃতকারী, আল বদর সেখানেই। ভারতীয় চর বা দুষ্কৃতকারীদের কাছে আল বদর সাক্ষাৎ আজরাইল,” একাত্তরে নিজেদের সম্পর্কে যাদের ছিল এই বক্তব্য সেই বাহিনীর প্রধান ছিলেন আলী আহসান মো. মুজাহিদ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 July 2013, 01:30 AM
Updated : 21 Nov 2015, 07:59 PM

ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা হিসেবে রাজনীতির অঙ্গনে পা দেয়া মুজাহিদ একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষেই শুধু দাঁড়াননি, গণহত্যা-লুণ্ঠনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মাধ্যমে বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাও দমন করতে পাকিস্তানি বাহিনীকে সব ধরনের সহযোগিতা দিয়েছিলেন।

একাত্তরে যুদ্ধাপরাধে জড়িত থাকলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক পালাবদলে এই মুজাহিদের গাড়িতেই উঠেছিল জাতীয় পতাকা। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি।

ইসলামী ছাত্রসংঘ দিয়ে শুরু করে মূল দল জামায়াতের অন্যতম কাণ্ডারি হয়ে ওঠেন মুজাহিদ, পান নির্বাহী প্রধান অর্থাৎ সেক্রেটারি জেনারেলের পদ। মন্ত্রী কিংবা দলের শীর্ষ পদে আসীন হলেও জনগণ যে কখনো তাকে গ্রহণ করেনি, তার প্রমাণ সংসদ নির্বাচনে কয়েবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও জিততে না পারা।

১৯৪৮ সালের ২ জানুয়ারি জন্ম নেয়া মুজাহিদ পারিবারিক আবহেই সেই রাজনীতিতে যুক্ত হন, যে রাজনীতি অসাম্প্রদায়িক ধারার বিপরীত। তার বাবা পূর্বপাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের অন্যতম সদস্য আব্দুল আলী ১৯৭১ সালে শান্তি কমিটির ফরিদপুর জেলা শাখার প্রধান ছিলেন।

গত শতকের ষাটের দশকে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সময়েই জামায়াতে ইসলামীর তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘে যোগ দেন মুজাহিদ। ১৯৬৮-৭০ মেয়াদে সংগঠনের জেলা শাখার সভাপতি ছিলেন তিনি।

উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর চলে আসেন ঢাকায়, ১৯৭০ সালে তিনি ছাত্রসংঘের ঢাকা জেলা শাখার সেক্রেটারির দায়িত্ব নেন। ১৯৭১ সালে প্রথমে পূর্ব পাকিস্তান শাখার সেক্রেটারি এবং পরে অক্টোবরে সভাপতি হন তিনি।

মুজাহিদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ করেন বলে তার আইনজীবীর ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে।

ছাত্র সংঘের সভাপতি হিসেবে কার্যত পদাধিকার বলেই আল বদর বাহিনীর শীর্ষ পদে চলে আসেন মুজাহিদ। তার আগে ওই পদে ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী, যিনি এখন জামায়াতের আমির এবং যুদ্ধাপরাধের দায়ে ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত।

যুদ্ধাপরাধ মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার আগে মুজাহিদ ছিলেন জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের পরিচালনা পর্ষদের প্রধান।

১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর ওই পত্রিকায়  প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে মতিউর রহমান নিজামী বলেন, “আমাদের পরম সৌভাগ্যই বলতে হবে। এ দেশের ইসলাম প্রিয় তরুণ ছাত্রসমাজ বদর যুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে রেখে আল বদর বাহিনী গঠন করেছে।”

আল বদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে মুজাহিদ যে বুদ্ধিজীবী হত্যায় নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন, তা উঠে আসে আদালতের রায়ে।

একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্যোদয়ের ঠিক আগ মুহূর্তে মুজাহিদের নির্দেশেই জাতির সূর্যসন্তানদের ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়েছিল, যাতে মূল ভূমিকা পালন করে আল বদর বাহিনী।   

প্রসিকিউটর তুরীন আফরোজ আদালতে শুনানিতে বলেছিলেন, “সারা দেশের আল বদর বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ছিল মুজাহিদের হাতে। শেষ দিন পর্যন্ত আল-বদর বাহিনীর সদস্যরা মুজাহিদের হুকুম তামিল করেছে।”

মুজাহিদের নেতৃত্বেই আলবদর বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে ফরিদপুর, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হত্যা, অপহরণ, লুটপাটের মতো ব্যাপক মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড চালায়।

১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রস্তুতির সময়ও বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণ না করার সিদ্ধান্ত নেন মুজাহিদ। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর পুনরুজ্জীবিত জামায়াতে সক্রিয় হয়ে ১৯৮২ সালে কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্য হন মুজাহিদ।

১৯৮৯ থেকে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালনের পর ২০০০ সালে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল হন তিনি।

মুজাহিদকে ২০১০ সালের ২৯ জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে আটক করা হয়। একই বছরের ২ অক্টোবর মানবতাবিরোধী অপরাধে গ্রেপ্তার দেখানো হয় তাকে। তখন থেকে কারাগারেই ছিলেন তিনি।

ফাইল ছবি

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাংবাদিক, শিক্ষকসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং সাম্প্রদায়িক হত্যা-নির্যাতনের দায়ে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই মুজাহিদকে প্রাণদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

তিনি ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলেও চলতি বছরের ১৬ জুন চূড়ান্ত বিচারে সর্বোচ্চ সাজাই বহাল থাকে।

এরপর এই যুদ্ধাপরাধী আপিলের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন।  তা খারিজ হয়ে গেলে এ মামলার সব বিচারিক প্রক্রিয়ার সমাপ্তি ঘটে।

রিভিউয়ের রায়ে বলা হয়, স্বাধীনতা যুদ্ধকালে ছাত্রসংঘ আল বদর বাহিনীতে রূপান্তরিত হলে এই বাহিনীর নেতা হন মুজাহিদ। ওই বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়ন করে। এর জন্যই মৃত্যুদণ্ড হয়েছে মুজাহিদের।

“আমরা এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে, স্বাধীনতা যুদ্ধকালে ছাত্র সংঘ ও আল বদরের নেতা হিসাবে তাকে (মুজাহিদ) অবশ্যই তার বাহিনী ও তাদের দ্বারা সংগঠিত অপরাধের দায়িত্ব নিতে হবে।”

যুদ্ধাপরাধ মামলায় বন্দি হওয়ার কয়েক বছর আগেও মুজাহিদ নিজের এবং দলীয় সহকর্মীদের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছিলেন, বাংলাদেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই।

দণ্ড কার্যকরের আগে সেই মুজাহিদই অপরাধ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চান। রাষ্ট্রের অভিভাবক তাতে সাড়া না দেওয়ায় রোববার প্রথম প্রহরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এই যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়।   

একাত্তরে মুজাহিদের কর্মকাণ্ডের ঘনিষ্ঠ সহযোগী পলাতক আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারেরও ফাঁসির রায় হয় ট্রাইব্যুনাল।

যুদ্ধাপরাধ মামলার চূড়ান্ত রায়ে এর আগে জামায়াতের দুই নেতা আব্দুল কাদের মোল্লা, মো. কামারুজ্জামানের ফাঁসি হয়। আরেক নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ট্রাইব্যুনালে প্রাণদণ্ড পেলেও আপিল বিভাগ তার দণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন দেয়।