অপরাধ জেনেও ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দেন মুজাহিদ

মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েও গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ‘দেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই’ বলে দম্ভপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছিলেন মুজাহিদ। তার ওই বক্তব্যে ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা।

সুলাইমান নিলয়বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 July 2013, 01:09 AM
Updated : 17 July 2013, 01:09 AM

একাত্তরে ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা মুজাহিদ ছিলেন আল বদর বাহিনীর শীর্ষ কমান্ডারদের একজন, যে বাহিনীর জন্ম হয়েছিল হত্যা, গণহত্যা-লুণ্ঠনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মাধ্যমে বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা দমনের উদ্দেশ্যে।

“আল বদর একটি নাম, একটি বিস্ময়! আলবদর একটি প্রতিজ্ঞা! যেখানে তথাকথিত মুক্তিবাহিনী আল বদর সেখানেই! যেখানেই দুষ্কৃতকারী, আল বদর সেখানেই। ভারতীয় চর বা দুষ্কৃতকারীদের কাছে আল বদর সাক্ষাৎ আজরাইল, ” একাত্তরে নিজেদের সম্পর্কে যাদের ছিল এই বক্তব্য, সেই বাহিনীর প্রধান ছিলেন আলী আহসান মো. মুজাহিদ।

আল বদর বাহিনীর কমান্ডার হিসাবেই তার ফাঁসি হয় ট্রাইব্যুনালে, যা পরে আপিল বিভাগেও বহাল থাকে। রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদনে যাবজ্জীবন ও অন্য দণ্ডের বিষয়ে কোন বক্তব্য না দিয়ে কেবল মৃত্যুদণ্ড এড়াতে প্রাণপণ চেষ্টা করেন মুজাহিদ। তবে মৃত্যুদণ্ড এড়ানোর পক্ষে পর্যাপ্ত যুক্তি দেখাতে না পারায় শেষ পর্যন্ত ফাঁসিকাষ্ঠেই ঝুলতে হল তাকে।

একাত্তরের পর এই যুদ্ধাপরাধী কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর রাজনৈতিক পালাবদলে অন্য যুদ্ধাপরাধীদের মতো তিনি সক্রিয় হয়ে ওঠেন এদেশের রাজনীতিতে। আশির দশকেই জামায়াতের রাজনীতিতে প্রভাবশালী হয়ে উঠেন।

২০০০ সালের পর গোলাম আযম রাজনীতি থেকে অবসর নিলে মতিউর রহমান নিজামী জামায়াতে ইসলামীর আমির হন; মুজাহিদ হন সেক্রেটারি জেনারেল। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে একাত্তরে ইসলামী ছাত্র সংঘের এই নেতাকে টেকনোক্রেট কোটায় সমাজকল্যাণমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়।

সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭ সালের ২৫ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে জামায়াতের প্রতিনিধি দলের সংলাপ শেষে দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদ বলেন, “বাংলাদেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী ছিল না, এখনো নেই।”

বদর কমান্ডারের এই মন্তব্যের পর দেশজুড়ে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে মাঠে নামে বিভিন্ন সামাজিক- সাংস্কৃতিক সংগঠন। সোচ্চার হন একাত্তরের শহীদ পরিবারের সদস্যরা।

সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামসহ বিভিন্ন সংগঠন যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গত্যাগ ও বিচারে নির্বাচনী অঙ্গীকার চায় রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে।

এর মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ ‘ভিশন- ২০২১: দিন বদলের ইশতেহার’ শিরোনামের নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতিশ্রুতি দেয়।

স্বাধীনতার তিন যুগ পরের এই নির্বাচনে প্রথম ভোটার হওয়া প্রজন্মের মধ্যে যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যু ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এর মধ্যে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অভাবনীয় বিজয় পেয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার।

পরে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (প্রথম ট্রাইব্যুনাল)।

একই দিন তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন দলও গঠন করা হয়। পরে ২০১২ সালে গঠন করা হয় দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল। এই ট্রাইব্যুনালেই বিচার হয় মুজাহিদের।

২০০৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া ধারাবাহিক সংলাপে এর আগে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, গণতন্ত্রী পার্টি,  জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) ও জাসদ (রব)  একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াতসহ স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার দাবি জানায়। তারা আদালতের প্রতীক বলে জামায়াতের নির্বাচনী প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লারও’ বিরোধিতা করে।

এ বিষয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আলী আহসান মুজাহিদ সাংবাদিকদের বলেন, “বাংলাদেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ১৯১ জনকে যুদ্ধাপরাধী চিহ্নিত করা হয়েছিল, যাদের আওয়ামী লীগ সরকার অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছে। দেশে কোনো স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিও নেই। কোনো কোনো দায়িত্বশীল দল এ সব দায়িত্বজ্ঞানহীন কথা বলার কারণেই ২২ জানুয়ারির নির্বাচন বাতিল হয়েছে।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নাই। এটা তাদের কল্পনাপ্রসূত। নিজেদের বানোয়াট একটা উদ্ভট চিন্তা। বাংলাদেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নাই। তখন থেকেই নাই। এখনো নাই। 

“বাংলাদেশে কোন স্বাধীনতাবিরোধীও নাই। স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি ছিলো না, এখনো নাই।”

১৯৭১ সালে জামায়াতের ভূমিকা কী ছিল- এ প্রশ্নের সরাসরি কোনো জবাব না দিয়ে জামায়াত নেতা মুজাহিদ সাংবাদিকদের বলেন, “সেটা আপনারা খোঁজ করে দেখুন, মূল্যায়ন করুন।”

সংলাপে জামায়াতের পক্ষে আরও উপস্থিত ছিলেন দেলাওয়ার হোসাইন সাইদী, মুহাম্মাদ কামারুজ্জামান, আব্দুল কাদের মোল্লা, এটিএম আজাহারুল ইসলাম ও ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। তাদের মধ্যে যুদ্ধাপরাধের চূড়ান্ত রায়ে সাইদীর আজীবন কারাদণ্ড হয়েছে। কামারুজ্জামান ও কাদের মোল্লাকে এর মধ্যেই ঝুলতে হয়েছে ফাঁসিতে। ট্রাইব্যুনালের রায়ে আজাহারুলকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

ট্রাইব্যুনাল গঠনের পরে ২০১০ সালের ৩১ মার্চ মগবাজারে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন মুজাহিদ।

একাত্তরে পাকিস্তানের পক্ষ সমর্থনকে যুক্তিযুক্ত মনে করেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “পাস্ট ইজ পাস্ট। এসব নিয়ে ঘাটাঘাটি করবেন না। যারা একাত্তরে নৃশংসতা করেছে, তাদের ওই সময়ে ছেড়ে দিয়েছে কেন? কেন ক্ষমা প্রদর্শন করা হল?”

একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থানের জন্য জামায়াত ক্ষমা চাইবে কি না- এরকম একাধিক প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে মুজাহিদ বলেন,  “ওই সময়ের সিদ্ধান্তটি ছিলো রাজনৈতিক। ওই প্রসঙ্গ এখন নয়।”

যুদ্ধাপরাধ বিচারের বিরোধিতা কেন করছেন- এ প্রশ্নের জবাবে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, “বিষয়টি মীমাংসা হয়ে গেছে ৩৬ বছর আগে। এ নিয়ে আবার বিচারের প্রশ্ন উঠতে পারে না।”

২০১৩ সালের ১৭ জুলাই ট্রাইব্যুনালে এই যুদ্ধাপরাধীর রায় ফাঁসি হয়। ওইদিন সকালে ট্রাইব্যুনাল এলাকায় আসার পর থেকে বিচারকরা এজলাসে বসার আগ পর্যন্ত তাকে বেশ হাসিখুশি দেখা যায়।

তবে রায় পড়া শুরুর ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে গম্ভীর হয়ে যেতে থাকেন মুজাহিদ। রায় শেষ হওয়ার পর ১৫-২০ সেকেন্ড দম ধরে থাকেন তিনি।

এরপর উঠে দাঁড়িয়ে ৬৫ বছর বয়সী মুজাহিদ বলে ওঠেন,  “এত বড় একটা অবিচার! ইসলামী আন্দোলন করার কারণেই এ রায় দেওয়া হয়েছে।”

এরপর কাঠগড়া থেকে পুলিশ তাকে নামিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় মুজাহিদ আবার বলেন, “ইসলামী আন্দোলন চলবে।”

ওই হাজতখানা থেকে কারাগারের উদ্দেশ্যে বিদায় নেওয়ার সময় উপস্থিত পরিবারের সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলেন, “হায়াত মউত আল্লার হাতে।”

এ সময় তাকে বিমর্ষ দেখাচ্ছিল।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাংবাদিক, শিক্ষকসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং সাম্প্রদায়িক হত্যা-নির্যাতনের দায়ে প্রাণদণ্ড পাওয়া মুজাহিদ আপিল করলে চলতি বছরের ১৬ জুন চূড়ান্ত রায়েও ওই সাজা বহাল থাকে।

আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় ৩০ সেপ্টেম্বর। এরপর নিয়ম অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে এবং কারা কর্তৃপক্ষ ১ অক্টোবর তা মুজাহিদকে পড়ে শোনায়।

এরপর ওই রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আপিল বিভাগে আবেদন করেন যুদ্ধাপরাধী মুজাহিদ। শুনানি শেষে বুধবার আদালত তা খারিজ করে দেয়।

প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ও আপিল বেঞ্চের অন্য তিন বিচারকের দেওয়া রায়ে বলা হয়, আপিল শুনানির পর দেওয়া রায়ে কোনো ত্রুটি বিচারকদের নজরে আসেনি। সুতরাং দণ্ড পুনর্বিবেচনার কোনো কারণও তারা খুঁজে পাননি।

দণ্ড কার্যকরের আগে এই যুদ্ধাপরাধীর শেষ আইনি সুযোগ ছিল রিভিউ আবেদন। তা খারিজের মধ্য দিয়ে আইনি লড়াইয়ের পরিসমাপ্তি হয়।

প্রাণরক্ষার সর্বশেষ চেষ্টা হিসেবে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদনও শনিবার রাতে নাকচ হয়ে গেলে রোববার প্রথম প্রহরে মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর হয়।

</div>  </p>