মাগুরায় যে সংঘর্ষে এক নারীর গর্ভস্থ সন্তান গুলিবিদ্ধ হয়েছে, তাতে জড়িতরা রাজনৈতিক দলের সদস্য না হলেও দলের ছত্রছায়ায় নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।
Published : 01 Aug 2015, 07:21 PM
গত ২৩ জুলাই জেলা শহরের দোয়ার পাড়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষে যে নারী গুলিবিদ্ধ হন, তার দেবর ছিলেন এক পক্ষের নেতৃত্বে।
দুই পক্ষের বিরুদ্ধেই ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ নানা অভিযোগ স্থানীয়দের। তবে আওয়ামী লীগের দুই সহযোগী সংগঠন ছাত্র ও যুবলীগের নেতারা এর দায় নিয়ে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
নাজমা বেগমের গর্ভস্থ সন্তানের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনার মধ্যে দুই সংগঠনই বিবৃতি দিয়ে বলছে, সংঘর্ষে জড়িতরা কেউ তাদের সংগঠনের কোনো পর্যায়ের সদস্য নয়।
তবে জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক এনামুল হক হিরকের পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, “এই ঘটনার হোতারা সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ। তারা সব সময় ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় থাকে।”
বর্তমানেও তারা ক্ষমতাসীন দল অর্থাৎ আওয়ামী লীগের এক ‘বাড়ির’ সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে অপরাধমূলক কাজ করে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। তবে মদদদাতার নাম উল্লেখ করেননি তিনি।
ছাত্রলীগের একাধিক নেতা দাবি করেছেন, সংঘর্ষে জড়িতরা যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তখন সেই দলে ভিড়ে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে।
ওই সংঘর্ষে একজন নিহত হওয়ার পাশাপাশি গর্ভে সন্তান নিয়ে গুলিবিদ্ধ হন নাজমা বেগম। এই নারীর ভূমিষ্ঠ সন্তানটি এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রয়েছে। তিনিও এখন ঢাকায় চিকিৎসাধীন।
এই ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি দাবিতে মাগুরা শহরে প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে নানা কর্মসূচি চলছে। পুলিশ আশ্বাস দিয়েছে, আসামিদের রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনা করছে না তারা।
২৩ জুলাইয়ের সংঘর্ষ বেঁধেছিল কামরুল ভূইয়ার সঙ্গে আজিবর রহমান ও মোহাম্মদ আলীর সমর্থকদের মধ্যে। কামরুল গুলিবদ্ধ নাজমার স্বামী বাচ্চু ভূইয়ার ভাই।
কামরুল ২০০৩ সালে জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ছাত্রত্ব না থাকা এবং বিয়ে করার পর পরের কমিটিতে তার স্থান হয়নি।
স্কুলের গণ্ডি পেরুতে ব্যর্থ আলী ১৫ বছর আগে মাগুরা এজি একাডেমি স্কুলে পিওনের চাকরি নেন। আজিবর ২০০৩ সালে পৌর ছাত্রলীগের কমিটিতে একটি সম্পাদকীয় পদে ছিলেন। তিনিও স্কুলের গণ্ডি পার হতে পারেননি।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একই পাড়ায় বসবাস এবং আওয়ামী লীগ সমর্থক হওয়ায় কামরুল, আলী ও আজিবর সব সময় এক সঙ্গেই চলাফেরা করতেন। কিন্তু স্বার্থগত দ্বন্দ্বের কারণে কামরুলের সঙ্গে আজিবরের দূরত্ব তৈরি হয়।
ঠিকাদারি নিয়ে আজিবর দূরে সরে গেলে কামরুল ও আলীর নেতৃত্বে একটি দল বিভিন্ন এলাকায় টাকার বিনিময়ে বিরোধপূর্ণ জমি দখল-বেদখল, দালালি, চাঁদাবাজি ও মাদক বিক্রিতে জড়িয়ে পড়েন বলে স্থানীয়রা জানান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই এলাকার এক ব্যক্তি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এজন্য তারা ব্যক্তি স্বার্থে সব সময় জেলার রাজনৈতিক ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলতে থাকেন। বিএনপি থাকলে বিএনপি, আওয়ামী লীগে থাকলে আওয়ামী লীগ।”
চার মাস আগে ভাগাভাগি নিয়ে আলীর সঙ্গে কামরুলের বিরোধ সৃষ্টি হয়। তখন আজিবরের সমর্থন পান আলী। এরপর আধিপত্য নিয়ে দুই পক্ষের ছোট-খাটো সংঘাত চলছিল।
স্থানীয়রা বলেন, সম্প্রতি আলীর পক্ষের হামলায় কামরুল পক্ষের কয়েকজন আহত হয়। এরপর ২২ জুলাই শহরের নতুন বাজার এলাকায় কামরুলের পক্ষ ধারালো অস্ত্র নিয়ে আলীর অনুসারী সাগরকে ধাওয়া করে। এরপর আলীর সমর্থকরা কামরুলের অনুসারী আলমগীরকে কুপিয়ে জখম করে।
এসব ঘটনার জের ধরে ২৩ জুলাই বিকালে দোয়ারপাড় এলাকায় কামরুল ও আলীর সমর্থকরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়ায়। তখন কামরুলের ঘরে হামলা চালালে তার চাচা আব্দুল মোমিন নিহত এবং ভাবি নাজমা আহত হন।
আসামি যারা
এই ঘটনায় যে মামলা করা হয়েছে, তাতে ১ নম্বর আসামি আলী (৩৮) এবং ২ নম্বর আসামি আজিবর (৩৮)। ৩ নম্বর আসামি মজিবর আজিবরের ভাই।
৫ নম্বর আসামি সুমন (৩২) একটি ওষুধের দোকানের কর্মচারী ছিলেন। এক বছর ধরে তিনি বাড়ির পাশে একটি চায়ের দোকান চালাচ্ছেন। ৬ নম্বর আসামি ফরিদ (৩৮) ইলেকট্রিক মিস্ত্রি।
৭ ও ৮ নম্বর আসামি সাগর ও বাপ্পী দুই ভাই মাগুরা শহরের নতুন বাজারে ব্যবসা করেন। কোনো দলের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা নেই।
৯ নম্বর আসামি ইলিয়াছ (৫০) ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। ১০ নম্বর আসামি সোহেল রানা এবং ১৩ নম্বর আসামি নজরুল মাইক্রোবাস চালান।
তারা কোনো রাজনৈতিক দলে যুক্ত নন বলে জেলা মাইক্রোবাস মালিক ও শ্রমিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক লিটন হোসেন জানান।
১১ ও ১২ নম্বর আসামি লিটন ও মিল্টন অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন, তারা শহরের জজ আদালতের সামনে চায়ের দোকান চালান। তবে তাদের বাবা ফজেদ মল্লিক পৌর আওয়ামী লীগের কর্মী।
১৪ নম্বর আসামি সোবহান (৪০) দোয়ারপাড়ে মুদি দোকানি। ১৫ ও ১৬ নম্বর আসামি সোলাইমান ও রানা আপন ভাই, তারা শহরের নতুন বাজারে সবজি ব্যবসা করেন।
সংঘর্ষে জড়িতরা ছাত্রলীগের বলে খবর আসার প্রতিক্রিয়ায় সংগঠনটির এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “মামলার আসামিরা কেউ স্কুলের গণ্ডি পার হননি। যে কারণে তাদের ছাত্রলীগ করার প্রশ্ন ওঠে না।”
আসামিদের মধ্যে (৪ নম্বর) একমাত্র সেন সুমন (৩৫) ছাত্রলীগে যুক্ত। শহরের কলকলিয়া পাড়ার বাসিন্দা সুমন জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কামরুলের দ্বারা নিগৃহীত হয়ে আলী ও আজিবরের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছিলেন সুমন।
ছাত্রলীগের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সংঘর্ষের সময় সুমন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল উপলক্ষে ঢাকায় ছিলেন এবং কাউন্সিলর হিসেবে ভোট দিয়েছেন।
আজিবরের ভাই মজিবর বিএনপি আমলে স্থানীয় যুবদলের প্রভাবশালী এক নেতার সঙ্গেই চলাফেরা করতেন বলে স্থানীয়রা জানায়। তবে তাদের বাবা মালেক আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মী। ৯০-এর এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় বোমা বানাতে পারদর্শিতার কারণে মাগুরায় তিনি ‘বোমা মালেক’ হিসেবে পরিচিত।
আসামিদের অধিকাংশ কোনো দলের সদস্য না হলেও আওয়ামী লীগে বড় সভা-সমাবেশে পাড়ার নেতাদের সঙ্গে তাদের দেখা যেত বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে।
যুবলীগের আহ্বায়ক এনামুল হক হিরকের বিবৃতিতে সংঘর্ষে জড়িতদের প্রভাবশালীল ছত্রছায়া পাচ্ছে বলে অভিযোগ করলেও তার সংগঠনে কেউ যুক্ত নয় বলে দাবি করেন।
“তারা কেউ যুবলীগ করে না। যুবলীগের কোনো কর্মসূচিতেও তাদের কখনও দেখা যায়নি।”
তবে এলাকাবাসী বলছে, সংগঠনে নাম না থাকলেও ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায়ই এরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক ইমাউল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কারও কোনো রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনা করা হবে না।
“পুলিশ সুপারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে প্রধান আসামিসহ সব আসামিকে গ্রেপ্তারের জন্য একাধিক টিম রাত-দিন কাজ করছে। অল্প সময়ের তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে।”
দুই আসামিকে ফরিদপুর থেকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের হেফাজতে চেয়ে আদালতে আবেদন করা হয়েছে। সোমবার ওই আবেদনের শুনানি হবে।