আজ তবে দহনের রাত। ধবল জ্যোৎস্নায় গাছের ছায়ায় বাতাসেরা খেলা করে। আর কানে বাজে মায়াহরিণীর অস্ফুট পদধ্বনি, বনমোরগের আর্তনাদ।
Published : 09 Feb 2013, 09:38 AM
১. চন্দ্রগ্রস্ত
আজ তবে দহনের রাত। ধবল জ্যোৎস্নায় গাছের ছায়ায় বাতাসেরা খেলা করে। আর কানে বাজে মায়াহরিণীর অস্ফুট পদধ্বনি, বনমোরগের আর্তনাদ। শৈশবের সেই বেহালা বাদকের কথা মনে করতে করতে এখনও টের পাই প্রকৃতির ভায়োলিন। আকাশের নীল ধরবে বলে দিগন্তরেখা বরাবর ছুটতো সে। এভাবেই তবে শূন্যতার কাছাকাছি যাওয়া যায়? এভাবেই পুড়ে খাক হয় বধির স্তব্ধতা?
রক্তে ছেয়ে যাওয়া এই স্বপ্নময় চোখ, চর্যাপদ থেকে উঠে আসা এই প্রাগৈতিহাসিক হাত; আর চোখের দৃষ্টিসীমায় গজিয়ে ওঠা লাল আপেলের বাগানের কসম-বুকের ভেতর গুমরে কাঁদা সোনালী চড়–ইগুলোকে আমি আজ সত্যিই উড়িয়ে দেবো, আর সেই বেহালা বাদকের মতো অন্ধ বিষণ্ন ছায়াপথ ধরে হেঁটে যাবো দিগন্তরেখা বরাবর দূর বহুদূর।
আমি তার কাঁধের ঝোলায় শৈশবের ঘাসফড়িং ভোরগুলোকে গচ্ছিত রেখে ভেবেছিলাম উড়তে উড়তে ওরাও একদিন পথ হারাবে স্বপ্নবৃক্ষের মায়ায়। আর তার ছায়ায় হবে আমার বাসস্থান। মন খারাপের ডাহুক সন্ধায় মেঘবালিকারা রোজ যেখানে ফিরবে ঝাঁপি ভর্তি উচ্ছলতা নিয়ে।
একেকটি নারী হারিয়ে যায়, আর মাঝপথে চোরাবালিতে মুখ থুবড়ে পড়ে একেকটি নদী। উজান স্রোতে ধাবমান ইলিশের মতো শৈশবের বালিকারা সব প্রণয়কাতর। ওরা সব ঝরে পড়া শিউলিমালা, ধবল নরম সাদা হাঁস, নীল ঘাসফুল।
আমি কি তবে আজ লিখবো নারী হয়ে ওঠার আগেই ঝরে পড়া সেইসব বালিকাদের কথা? আমার ভেতর মাঝে মাঝেই কেউ একজন জেগে ওঠে, কানে বাজে দূর থেকে ভেসে আসা ট্রেনের হুইসেল, শিউলিদের পুজো ঘরের উলুধ্বনি। প্রতিমাগুলোকে মনে হয় নীল শাড়ি পরা সাগর দিদি। সেই শৈশবে প্রেম শব্দটির সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠার আগেই দিদির শরীর আর শিউলির মুখ দেখে শিহরিত হয়েছিলাম।
গভীর মনযোগে তোমরা কি কখনো প্রার্থনাশালার দিকে গিয়েছিলে? সেই দিকে পায়েহাঁটা দীর্ঘ পথ তো আমার সেই শৈশব থেকেই শুর”। এখনো টের পাই গলায় ঝুলছে শিউলিমালা। দহনদগ্ধ মধ্যরাতে এখনও হাতড়ে খুঁজি শিস দিয়ে যাওয়া সেই পাতাবাহার দুপুর। দেবীবোধনের দিনে সেই যে চোখাচোখি, সেই যে মায়াময় মুগ্ধতা ভুলিনি আমি, ভুলিনি কিছু।
সেইসব ওড়াওড়ির দিন, শালিকনগর, চরজাগা নদী, ধূ ধূ মাঠ, বালুচর–ওরাও কি মনে রাখবে কেউ এসেছিল একদিন এইখানে, ধূসর ছায়ার সঙ্গে অদ্ভুত আলিঙ্গনে রচেছিল আশ্চর্য আখ্যান? সে এক গোত্রবিতাড়িত বিবাগী প্রেমিক ছিল, তাই তার পায়ের ছাপ লেগে থাকে খরায় চৌচির ক্ষেতের বিষণœ শরীরে, ধূসর পাথরে। যতোবারই পালাতে চেয়েছে সে, ততোবারই পৌঁছে গেছে গাঢ় থেকে গাঢ় রক্তপাতে।
শীতের র”ক্ষ উঠোনে এসেও যেমন মরে না সব নদী, তেমনি পৃথিবীর সব প্রেমিক প্রেমিকা হারিয়ে গেলেও মরে না প্রেম। বৈরাগী নদী হয়ে চোরাস্রোতের টানে বয়ে চলে সংগোপনে। নি:সঙ্গতার কাছে এরকম ফিরে আসার নামই ইতিহাস। আমি সেই ইতিহাসের কাছে বারবার ফিরে আসি।
২. তাম্রফলক
জেনে রেখো বেদনারও আছে বন্ধনের কিছু ইতিহাস। সেই দীর্ঘশ্বাস আজ জমা রাখলাম এই নক্ষত্রপুঞ্জের হাতে। বেদেপাড়ার সেই কৃষ্ণ তরুণীর কাছে একদিন যেমন গচ্ছিত রেখেছিলাম স্বর্গের ঘরের চাবি।
বয়:সন্ধির সেই চুমুতে ছিলো অদ্ভুত শিহরণ। শিউলিফোটা পূর্ণিমা রাতে হূদয়ের তীরে সে কেবলই শিশির ছড়ায়। প্রসারিত বুকে সানাই কি তখন ডাকছিল আমায়? তোমার দিকে ধাবমান আমিও তখন অনায়াসে নদীর বুকে ভাসিয়েছি ভেলা।
আজ এই বিষণ্ন রাতে মুড়িয়ার বুকে খাঁচাবন্দি হতে হতে আর্তনাদ করে ওঠে একটি ডাহুক। দূরে কোথাও হাহাকারের ধ্বনি ডাহুকি তার ডানা ঝাপটায়। নদীও তখন কেমন যেন দু:খে কেঁদে ওঠে।
আকাশ ভুলেছে বৃষ্টি ও কলমিলতার রং। মায়া ও বিভ্রমের কাঁচফ্রেমে বন্দি হতে হতে তুমিও কি না হয়ে গেলে দূর দিগন্তের মেঘ। আমিও যে শিমুল তুলো হয়ে ছুটবো তার পেছন পেছন, এমনটাতো নির্ধারিত ছিল সেই প্রগৈতিহাসিক কাল থেকেই।
বাস্তবিক অর্থেই প্রেম মানে মেঘ, মায়া ও বিভ্রম। মানুষ সেই তাম্রফলক পাঠ করে আসছে তোমার আমার জন্মেরও বহুকাল, বহু শতবর্ষ আগে থেকে।
৩. তোমার তরবারি
জীবনানন্দের কমলা রঙের রোদ হয়ে একদিন তুমি ছিলে নারী। ক্ষিপ্র ডানা ঝেড়ে অদ্ভুত নক্ষত্রের রাতে তার কল্পনার হাস যেমন উড়তো হূদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভেতর, তেমনি তুমি উড়ে উড়ে বেড়াতে হাওয়ায় হাওয়ায়।
সেদিনও জ্যোৎস্না নামতো, আগরের বনে রচিত হতো পাতাবাহার স্নিগ্ধতা। আর তুমি চরাচর ছাপিয়ে গেয়ে ওঠতে ‘আজ জ্যোৎস্না রাতে…’। সোনাইয়ের স্রোতের টানে অকস্মাৎ জেগে উঠতো আমার হূদয়।
অনেক, অনেক দিন পর আজও যখন নক্ষত্রের রাতে জ্যোৎস্না নামে, টের পাই- সেই কমলা রঙের রোদগুলো মরে যায়নি, ডানা ভেঙে যায়নি সেই অবিসংবাদিত হাসগুলোর।
টের পাই– তুমি আছো নারী
হূদয়ে কড়া নাড়ে তোমার তরবারী!
৪. কর্কশ ভোরকে সামনে রেখে
নক্ষত্রের রাতে জ্যোৎস্নার হাত ধরে যারা এসেছিলো একটি নতুন ভোর আনবে বলে, হূদয়ে জলের চিহ্ন রেখে তারা সব গিয়েছে চলে।
আজও আমার বুকের ভেতর সেই জলের ক্রন্দনধ্বনি বাজে। আজও আমার ঠোঁটের কোণে সেই কম্পনের দাগ হাহাকার করে ওঠে।
বিষণ্ণ এই রাতে চেয়ে চেয়ে দেখি, দূরের আকাশে উড়ছে একটি পাখি একাকি একাকি! এখন আর নেই সেই ভৈরবী সুর– জানি, রাত শেষে কাক হয়ে আসবে কর্কশ ভোর।
৫. ইতিহাসের গুহাচিত্র
এক সুবর্ণ ভোরে আমরা হেঁটেছি হাত ধরাধরি করে। আর এক উজ্জ্বল দুপুর আমরা কাটিয়েছি মুখোমুখি বসে পরস্পর। বর্ষার বৃষ্টি শেষে এক পৌষের সন্ধ্যায় উষ্ণতার খোঁজে তুমি থরথর করে কেঁপে উঠেছো। আর আমি নিপুণ তুলিতে তোমার অনাবৃত শরীরে এঁকে দিয়েছি গুহাচিত্রের ছায়া। সেই থেকে কুঁজো পিঠে বয়ে চলেছি সভ্যতার দু:সহ ভার।
আজ এই নক্ষত্রের রাতে আমি ফিরে পেতে চাই পূর্বজন্মর সেইসব স্মৃতি, ইতিহাসের গুহাচিত্রে লেখাতে চাই নাম।
৬. শিউলি রায় বাড়ি আছো
বৃষ্টির আগুনে পুড়ছিল বাগানের গোলাপগুচ্ছ। জানালার কাঁচের ওপাশে দাঁড়িয়ে তুমি কি শুনছিলে তার মোহন আহ্বান, হাজার নক্ষত্রের গান?
দেবদার” গাছের নীচে ভেজাকাঠের বেঞ্চ। বাতাসে দীর্ঘশ্বাস। নগ্নমাঠ বরাবর হেঁটে যেতে যেতে দূর থেকে আমি ঠিকই টের পাই রক্তের ঢেউ। পবিত্র আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে আত্মা, আর আমি তখন ক্রমশ কবি হয়ে উঠি। মন্দিরের ওপাশে দাঁড়িয়ে কানপেতে শুনি তার পায়ের আওয়াজ।
আজও মনে পড়ে সেই শ্যামল কিশোরী মুখ। স্মৃতির ধূলো হাতড়ে আজও আমি তুলে আনি সেইসব উজ্জ্বল পাতাবাহার দিন। তার আলতামাখা পায়ে নূপুরের ধ্বনিতে আজও আমি পথ খুঁজি, নতুন পথ। সব কৃত্রিম মগ্নতা আর ভুল অবগাহন শেষে প্রতি পূর্ণিমায় আমি তার উঠোনে গিয়ে ডেকে উঠি শিউলি রায় বাড়ি আছো?
৭. মায়া
একদিন সেই অপরূপ ডাক দিয়ে নিয়ে যেতো অলৌকিক ফলবতী বৃক্ষের ছায়ায়, বৃষ্টির শব্দের মতো তার নূপুরের ধ্বনি রক্তে জাগাতো সুর। সে ছিল নিখাদ সরল কিশোরী, জলের মেয়ে, দুপানির দেবী।
আজ এই ভর পূর্ণিমায় উত্থাল বাতাসে তার কথা বার বার ঘুরে ফিরে আসে। তার কথা ভেবেই হয়তো হয়েছি কবি।
দেবীর মুখ ভাবলে আজও জলের ধারায় ভাসি,
এখনো রাত জাগিয়ে রাখে দেবী সর্বনাশী।
দেবীর মুখে নেইতো আলো মহাকালের ছায়া,
দেবীতো নেই, তবুও টানে তার ছড়ানো মায়া!
৮. তোমার শাড়ি
আহা, কে জানতো আজ নামবে এমন ঘাতক পূর্ণিমা। কে জানতো এই শিউলিফোটা রাতে, থাকবে না পাশে কেউ। স্মৃতির বিষণ্ন রুমাল হাতে একা কে জানতো আজ হূদয়ে জাগবে ঢেউ।
কে জানতো আজ চাঁদের মোহন আলোয় ডাক দিয়ে যাবে এপিটাফগুলো শুধু। অবেলায় শুকাবে জলের ধারা হূদয়ে জাগবে গড়ের মাঠ, বালুচর ধূ ধূ।
কে জানতো আজ এই পূর্ণিমা হঠাৎ অকস্মাৎ
তরবারী হয়ে তোমার শাড়ি ঘটাবে রক্তপাত
৯. শচীন দেবের গান
আজ আমি আর তুমি বিষণ্নতা। আজ আমি আর তুমি দূরের আকাশে ম্লান চাঁদ
আজ আমি তার তুমি এপার ওপার। এতো কাছে তবু দূরে, মাঝখানে ফারাক্কা বাঁধ।
আজ আমি আর তুমি সমানে সমান,
বিরহী পথরেখা শচীন দেবের গান।
১০. দূরবর্তিনী
নক্ষত্রের রাতে মাঝে মাঝে উথালপাতাল ঝড় আসে। নীল আলোয় পাখা মেলে ওড়ে রহস্যময় কোনো চিঠি। নিস্তব্ধতার খুঁটিগুলো দুলে ওঠে অকস্মাৎ। ঝরাপাতার কাছে, ভুলের বাগানে বিপন্ন ঘাসফুলের কাছে আমি আজ তোমার ঠিকানা খুঁজি। আর এক মোহময় স্পর্শের খোঁজে বামপকেটে গচ্ছিত রুমালে হাত রাখি বার বার।
দূরবর্তিনী নিশিরাতে দূরের জানালায় তুমিও কি টের পাও এই হাহাকার?
১১. ভাঙনের শব্দ
নীল কষ্টকে শিশিরে ধুয়ে আমি আজ সাদা করবো, কিংবা সবুজ।
বছরের প্রথম বৃষ্টিতে যেমন পবিত্র হয়ে ওঠে শহরের পিচ ঢালা কালো পথ আজ এই জ্যোৎস্নাবৃষ্টিতে তুমিও কি আমার কাছে দৃশ্যের ভেতর থেকে সেরকম কোনো দৃশ্যমান হয়ে উঠেছো?
রজনীগন্ধা কিংবা বেলীফুলের চেয়ে আমার কাছে প্রিয় মহুয়ার গন্ধ। বনে বনে কদম ফুটলে নাগরিক দালালগুলো কি রকম জানি আর্তনাদ করে ওঠে।
মহুয়া মাতাল আমিও আজ বুকের ভেতর ভাঙনের শব্দ শুনি।
১২. চিলেকোঠার খবর
বিষণ্নতার রেখাপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে আজ আমি জ্যোৎস্নার আগুনে পরিশুদ্ধ হবো। যারা বাউন্ডেলে মেঠোপথে কোনোদিন রাখেনি পা, শিশিরভেজা ভোরে মাড়ায়নি ক্ষেতের আইল, অমরত্মের আশায় হাজার বছর ধরে যারা শুধু হেঁটেছে পিচঢালা পথে আমি আর হাঁটবো না তাদের পেছন পেছন। ওরা সুখে থাক বিচ্ছেদনগরীর কাঁচঘরে।
শুকনো মালাটি বকুল তলায় ফেলে যারা গিয়েছে চলে, তাদের কথা মনে করতে করতে বিষাদের জানালা খুলে আজ আমি খুঁজে নেবো একটি নদী। নদীর বুকে ভাসাবো কাগজের লাল নীল নৌকা। শীতরাতে ছাদের কার্নিশে ঝুলছে যে স্ট^পু তাকে দেবো মায়াবতী পাখির ডানা। ও পাখি তুই উড়ে গিয়ে আয় না নিয়ে তার চিলেকোঠার খবর।
১৩. জলরঙে আঁকা ছবি
জ্যোস্নাও তবে চরাচরে ঢালে নীল দু:খ। বিপন্ন বিস্ময়ে আমিও গিয়ে দাঁড়াই শেষে সুরমার তীরে। ভাঙনের শব্দ শুনি, ভাঙনের শব্দ শুনি।
নিপুণ তুলিতে জলরঙে আঁকা এই ছবি- জগৎ জানে না এ ছবির মানে, জানে শুধু এই কবি।
১৪. বেদনাপাখি
নি:সঙ্গ বেহালার তারে বেজে ওঠে হাহাকার
কে রাখে দমিয়ে তারে এমন সাধ্য কার?
যারে উড়ে যা, উড়ে যা বেদনাপাখি
এই ভালো, তবু একলা থাকি।