ফার্স্ট লেডি, সিনেটর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে আসা হিলারি ক্লিনটন আর রিয়েল এস্টেট ব্যবসার সাম্রাজ্য বিস্তার করতে করতে ঢুকে পড়া ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে কার হাতে যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররা সেই চাবি তুলে দেবে তা দেখার অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে পুরো বিশ্ব।
মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে এই ভোটের পদ্ধতি ও নানা খুঁটিনাটি জানাচ্ছে বিবিসি।
কে যোগ্য
বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর এ রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে অবশ্যই ‘জন্মসূত্রে’ দেশটির নাগরিক হতে হবে। বয়স হতে হবে অন্তত ৩৫ বছর এবং ন্যূনতম ১৪ বছর ধরে আমেরিকাবাসী হতে হবে।
‘শীর্ষ আমেরিকান’ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে গুরুত্ব পাবে দেশসেবা ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা।
গত ৮৩ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে যারা নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের প্রায় প্রত্যেকেই আগে ছিলেন গভর্নর, সিনেটর কিংবা পাঁচ তারকা জেনারেল।
এবারের নির্বাচনের শুরুতে যারা প্রধান দুই দল ডেক্রোক্রেটিক পার্টি ও রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছিলেন, তাদের অর্ধেকও বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের গভর্নর কিংবা সাবেক গভর্নর। বাকিদের অধিকাংশ ছিলেন সিনেটর বা সাবেক সিনেটর।
সংবিধান অনুযায়ী প্রতি চার বছর পরপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়। একজন প্রেসিডেন্ট দুই মেয়াদের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারেন না।
কেন মঙ্গলবার?
ঐতিহাসিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়ে আসছে নভেম্বরের প্রথম সোমবারের পরেরদিন। এ কারণে অনেকে একে ‘প্রথম মঙ্গলবারও’ বলে থাকেন।
১৮শ’ শতকের মাঝামাঝি তখনকার কৃষিনির্ভর যুক্তরাষ্ট্রে নভেম্বরের প্রথম সোমবারের পরেরদিন নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এর আগে সিদ্ধান্ত ছিল- নভেম্বরের শুরু থেকে ডিসেম্বরের প্রথম বুধবার পর্যন্ত যে কোনো দিন ভোট করতে পারবে অঙ্গরাজ্যগুলো। কিন্তু আগাম ভোটের ফলাফল চূড়ান্ত ভোটকে বিঘ্নিত করছে এমন বিবেচনায় পরে একদিনে সব রাজ্যে ভোটের সিদ্ধান্ত হয়।
তখনকার দিনে দূর দূরান্তের ভোটকেন্দ্রগুলোতে পৌঁছানোও সহজ ছিল না। কোনো কোনো কেন্দ্রে যেতে পাড়ি দিতে হত একদিনের পথ। এসব বিবেচনায় রোববারের পর সোমবারও বাদ যায়। ঠিক হয়, ভোট হবে সোমবারের পরের দিন।
তবে নভেম্বরের ১ তারিখই যদি মঙ্গলবার পড়ে যায়, তাহলে এ নিয়ম খাটবে না। ভোট চলে যাবে পরের মঙ্গলবার, যেমনটা এবার হয়েছে।
কীভাবে ভোট
এবার প্রায় ১৪ কোটি ৬০ লাখ ভোটার নিবন্ধন করলেও তাদের সরাসরি ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন না। তারা ভোট দিয়ে আসলে ‘ইলেকটর’দের নির্বাচিত করেন। তারপর ইলেকটোরাল বা নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটসংখ্যাই ঠিক করে দেবে- কে হবেন প্রেসিডেন্ট। নিয়মটা বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা থেকে অনেকটাই আলাদা।
সাধারণত বেশিরভাগ রাজ্যের ব্যালট পেপারে ছবি থাকবে বিভিন্ন দলের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের। ছবির সঙ্গে থাকা মার্কায় ভোট দিয়ে ওই রাজ্যে দল বা প্রার্থী মনোনীত ইলেকটরদের বিজয়ী করবেন ভোটাররা। ভোটের আগেই প্রার্থীরা ওই অঙ্গরাজ্যে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে ইলেকটরদের মনোনয়ন দিয়ে আসেন।
বেশিরভাগ রাজ্যে নিয়ম হল- ‘উইনার-টেইক-অল’। মানে কোনো রাজ্যে যদি দশটি ইলেকটোরাল ভোট থাকে, তার মধ্যে যে দল অন্তত ছয়টি, অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ ইলেকটোরাল ভোট পাবে, ওই রজ্যের সবগুলো, অর্থাৎ দশটি ইলেকটোরাল ভোটই সেই দলের বলে গণ্য হবে।
মাত্র দুটি রাজ্যে- নেব্রাস্কা ও মেইনে বিজয়ী প্রার্থী সব ইলেকটোরাল ভোট একা পায় না, সেটা পপুলার ভোট বিজয়ী ও কংগ্রেসনাল জেলায় বিজয়ী প্রার্থীর মধ্যে ভাগ হয়ে যায়।
ইলেকটোরাল কলেজ কী?
ইলেকটোরাল কলেজই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আনুষ্ঠানিক কর্তৃপক্ষের ভূমিকা পালন করে। সাংবিধানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সংসদের দুই কক্ষে থাকা আসনের (হাউজ অব রিপ্রেসেনটেটিভের ৪৩৫, সিনেটের ১০০) বিপরীতে রাজ্যগুলো তাদের জন্য নির্ধারিত ইলেকটর পায়। ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ায় কোনো কংগ্রেস প্রতিনিধি না থাকায় সেখান থেকে আসেন তিনজন ইলেকটর।
ইলেকটরদের সংখ্যা নির্ধারিত জনসংখ্যার বিচারে। এবার সবচেয়ে বেশি ইলেকটোরাল ভোট রয়েছে ক্যালিফোর্নিয়ায়- ৫৫টি। এরপর রয়েছে টেক্সাস, ৩৮টি; নিউ ইয়র্কে ২৯টি; ফ্লোরিডায় ২৯টি; ইলিনয়ে ২০টি এবং পেনসিলভানিয়ায় ২০টি।
এছাড়া ওয়াশিংটন ডিসিতে ১২টি, মিনেসোটায় ১০টি, উইসকনসিনে ১০টি, মিশিগানে ১৬টি, নিউ হ্যাম্পশায়ারে ৪টি, মেইনে ৪টি, ম্যাসাচুসেটসে ১১টি, রোড আইল্যান্ডে ৪টি, কানেকটিকাটে ৭টি, নিউ জার্সিতে ১৪টি, ম্যারিল্যান্ডে ১০টি, ওরিগনে ৭, ইডাহোতে ৪টি, নেবরাস্কায় ৫টি, আইওয়াতে ৬টি, ইন্ডিয়ানায় ১১টি, ওহাইওতে ১৮টি, নেভাদায় ৬টি, ইউটায় ৬টি, কলোরাডোতে ৯টি, কানসাসে ৬টি, মিসৌরিতে ১০টি, কেন্টাকিতে ৮টি, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় ৫টি, ভার্জিনিয়াতে ১৩টি, আরিজোনায় ১১টি, নিউ মেক্সিকোতে ৫টি, টেনেসিতে ১১টি, নর্থ ক্যারোলিনায় ১৫টি, লুইজিয়ানায় ৮টি, মিসিসিপিতে ৬টি, আলাবামায় ৯টি, জর্জিয়ায় ১৬টি, সাউথ ক্যারোলিনায় ৯টি, হাওয়াইতে ৪টি, মন্টানায় ৩টি, নর্থ ডাকোটায় ৩টি, ভারমন্টে ৩টি, ডেলাওয়ারে ৩টি, ওয়াইওমিং এ ৩টি, সাউথ ডাকোটায় ৩টি, ওকলাহোমায় ৭টি, আরকানসাসে ৬টি এবং আলাস্কায় ৩টি ইলেকটোরাল ভোট রয়েছে।
জনগণের ভোট সংখ্যায় এগিয়ে থেকেও ইলেকটোরাল ভোটে হেরে যাওয়ার নজির আছে যুক্তরাষ্ট্রে। সর্বশেষ ২০০০ সালে ডেমোক্রেট প্রার্থী আল গোরের কাছে পপুলার ভোটে হেরে যাওয়ার পরও ইলেকটোরাল ভোটে জিতে হোয়াইট হাউজের টিকেট পান জর্জ ডব্লিউ বুশ।
‘সাদা বাড়ি’র ঠিকানা
টানা ৮ বছর চেয়ারে থাকা প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার উত্তরসূরী নির্বাচিত হবেন মঙ্গলবার। এরই মধ্যে প্রবাসীরা ডাকযোগে বা অনলাইনে ভোট দিচ্ছেন, ৩৮টি অঙ্গরাজ্যে চলছে আগাম ভোট।
সব ভোটের মিলিত ফল জানা যাবে মঙ্গলবারের পর। তবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসবে আরও পরে।
১৯ ডিসেম্বর বিভিন্ন রাজ্যের ইলেকটররা মিলিত হয়ে ভোট দেবেন। সেই ভোট গোণা হবে ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি। নিয়ম অনুযায়ী ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সিনেটের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সেই ফলাফল নাম ঘোষণা করবেন।
২০ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব নেবেন নতুন প্রেসিডেন্ট, চার বছরের জন্য হোয়াইট হাউজই হবে তার ঠিকানা।