রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক যুদ্ধ কী আসন্ন?

বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরমাণু অস্ত্রের ভাণ্ডার রয়েছে পুতিনের হাতে।

রয়টার্সবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Oct 2022, 03:33 PM
Updated : 4 Oct 2022, 03:33 PM

ইউক্রেইন যু্দ্ধে রাশিয়া যদি কোনোভাবে আক্রান্ত হয় তবে সেটিকে উসকানি হিসেবে ধরে নিয়ে পরমাণু অস্ত্রের মাধ্যমে তার জবাব দেওয়ার হুমকি পশ্চিমাদের দিয়ে রেখেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সত্যিই কী পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবেন?

যদি পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে চান তবে তার হাতে এ ধরনের কতগুলো অস্ত্র আছে? যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন নেটো সামরিক জোট কিভাবে তার জবাব দেবে?

এসব প্রশ্নের উত্তর অনেকটাই নির্ভর করছে পুতিন রাশিয়া বা তার শাসনের বিরুদ্ধে ওঠা হুমকিগুলোকে কতটা গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছেন।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স বিষয়টি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে।

পুতিন ইউক্রেইন যুদ্ধকে রাশিয়া এবং পশ্চিমাদের মধ্যে একটি অস্তিত্বের লড়াই হিসাবে ছুড়ে দিয়েছেন। তার অভিযোগ, পশ্চিমারা রাশিয়াকে ধ্বংস করা এবং দেশটির বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদের ভাণ্ডারের নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।

পুতিন পশ্চিমাদের হুঁশিয়ার করে বলেছেন, যখন তিনি বলেন রাশিয়াকে রক্ষা করতে তিনি পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করতে প্রস্তুত আছেন সেটা যেন তারা ‘ধাপ্পা’ বলে ধরে না নেয়। 

কয়েকজন যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ অবশ্য একে পুতিনের ‘ধাপ্পবাজি’ বলেই মনে করছেন। তাদের একজন প্রাগ ভিত্তিক সামরিক বিশেষজ্ঞ ইউরি ফিওদোরভ। পুতিন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘এ মুহূর্তে তিনি ধাপ্পাই দিচ্ছেন। কিন্তু এখন থেকে এক সপ্তাহ বা একমাস পর কী হবে সেটি বলা খুব কঠিন...যখন তিনি বুঝতে পারবেন যুদ্ধে তিনি হেরে যাচ্ছেন।”

কিন্তু ওয়াশিংটন পুতিনের হুঁশিয়ারিকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে।

গত শুক্রবার ইউক্রেইনের জাপোরিজিয়া, খেরসন, লুহানস্ক এবং দোনেৎস্ক-কে রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত করার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন পুতিন। যা ইউক্রেইনের মোট ভূখণ্ডের প্রায় ১৮ শতাংশ। ওই চার অঞ্চলে কোনও ধরনের হামলাকে এখন পুতিন রাশিয়ার উপর হামলা বলে বিবেচনা করতে পারেন।

যদি পুতিন পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের পথেই হাঁটেন তবে কী হবে এমন প্রশ্নে জবাবে সিআইএ পরিচালক উইলিয়াম বার্নস বলেন, ‘‘ঝুঁকির মধ্যে থাকা সবকিছুর নিরীখে তার এ ধরনের হুমকি আমাদেরকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতেই হবে।”

তবে পুতিন এখনই যুদ্ধে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করতে যাচ্ছেন এ সংক্রান্ত কোনও ‘বাস্তব প্রমাণ’ এখনও যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দারা পায়নি বলেও জানান তিনি।

কী ধরনের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার হতে পারে?

যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইউরোপ এবং এশিয়ার কোনও শহরে আঘাত হানতে সক্ষম এমন কোনও ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে কৌশলগত পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের কোনও পরামর্শ এখন পর্যন্ত রাশিয়ার কোনও কর্মকর্তা দেননি।

পুতিনকে সবচেয়ে স্পষ্ট ভাষায় যিনি পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি হলেন চেচনিয়া অঞ্চলের প্রধান রমজান কাদিরভ। তবে তিনি মস্কোকে ইউক্রেইনে স্বল্প ক্ষমতার কৌশলগত পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করতে বলেছেন।

কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রগুলো মূলত একটি ‘কৌশলগত’ উদ্দেশ্যে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করার মত পরমাণু অস্ত্র। যেগুলো মস্কো, ওয়াশিংটন বা লন্ডনের মত বৃহৎ নগরীকে ধ্বংস করতে যত বড় পরমাণু বোমার প্রয়োজন তার থেকে অনেক কম ক্ষমতা সম্পন্ন।

এ ধরণের অস্ত্র সাধারণত উড়োজাহাজ থেকে ফেলা হয়, ভূমি, জাহাজ বা সাবমেরিন থেকে ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে ছোড়া হয় বা পদাতিক বাহিনী নিক্ষেপ করতে পারে।

রাশিয়া তাদের সেনাবাহিনীর বিশেষ পারমাণবিক বাহিনীকে পরমাণু যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াইয়ের জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দেয়। কিন্তু তাদের নিয়মিত সেনা, ভাড়াটে সেনা, সংরক্ষিত সেনা এবং স্থানীয় মিলিশিয়ারা পরমাণু যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই করতে সক্ষম কিনা তা স্পষ্ট নয়।

যুক্তরাষ্ট্র কী করবে?

রাশিয়া যদি পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করে তবে বৈশ্বিক প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে তার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের হাতেই বিশ্বের ৯০ শতাংশ পরমাণু অস্ত্রের (নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড) নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। স্নায়ু যুদ্ধের সময় তারা এই অস্ত্রভাণ্ডার গড়ে তোলে। সে সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের পরমাণু অস্ত্র ভাণ্ডার আজকের আধুনিক রাশিয়ার হাতে তুলে দেয়।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নানা ভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেন। যার মধ্যে একটি বিকল্প হতে পারে অসামরিক প্রতিক্রিয়া। অথবা তিনি যদি পাল্টা পরমাণু অস্ত্র হামলা চালান তবে যুদ্ধ উত্তেজনা আরও বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকবে। এছাড়া, তিনি একটি সম্মিলিত আক্রমণও চালাতে পারেন। সেক্ষেত্রে ওয়াশিংটন মস্কোর সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে।

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেছেন, যদি পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করা হয় তবে যে ‘বিপর্যকর পরিণতি’ নেমে আসবে যে বিষয়ে ওয়াশিংটন বিশেষভাব মস্কোকে সতর্ক করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল এবং সিআইএ-র সাবেক প্রধান ডেভিড পেত্রাউস সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, যদি মস্কো পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করে তবে যুক্তরাষ্ট্র এবং নেটো জোট ইউক্রেইনে রাশিয়ার সব সেনা ও সমরাস্ত্র ধ্বংস করে দেবে, কৃষ্ণসাগরে তাদের পুরো নৌবহর ডুবিয়ে দেবে।

ওদিকে, পুতিন ওয়াশিংটনকে অতীত স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রই এখন পর্যন্ত পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করেছে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি নগরীর উপর পরমাণু বোমা ফেলে।

কার হাতে সবচেয়ে বেশি পারমাণবিক অস্ত্র আছে?

ফেডারেশন অব আমেরিকান সাইন্টিস্টস এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাশিয়ার হাতে ৫ হাজার ৯৭৭টি নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড আছে। যুক্তরাষ্ট্রের হাতে আছে ৫ হাজার ৪২৮টি। সংখ্যার বিবেচনায় রাশিয়া পরমাণু অস্ত্রে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর দেশ।

অস্ত্রের এই তালিকায় মজুদকৃত এবং মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া ওয়ারহেডগুলো রয়েছে। তবে এটা ঠিক, মস্কো এবং ওয়াশিংটন উভয়েরই বিশ্বকে বহুবার ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট পরমাণু অস্ত্র রয়েছে।

সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, রাশিয়ার তাদের এক হাজার ৪৫৮টি নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড মোতায়েন করে রেখেছি। যেগুলো যেকোনো সময় নিক্ষেপের জন্য প্রস্তুত আছে। যুক্তরাষ্ট্রের হাতে এ ধরনের অস্ত্রের সংখ্যা এক হাজার ৩৮৯টি।

এই ওয়ারহেডগুলো আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র, ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, সাবমেরিন এবং কৌশলগত বোমা হিসেবে আছে।

আর কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রের বেলায় রাশিয়ার হাতে তার পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ১০ গুণ বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের হাতে কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র আছে প্রায় দুইশ টি। যেগুলোর প্রায় অর্ধেক ইউরোপের নানা ঘাঁটিতে মোতায়েন করা।

যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রগুলো বিস্তৃতি ০ দশমিক ৩ থেকে ১৭০ কিলোটন পর্যন্ত। হিরোশিমায় যে পারমাণবিক বোমা ফেলা হয়েছিল সেটাতে ১৫ কিলোটন ডায়নামাইট ছিল।