পুতিনের জন্য বড় ধাক্কা মস্কোর কনসার্ট হলে হামলা

ফের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার সপ্তাহ না পেরোতেই মস্কো এমন প্রাণঘাতী হামলার শিকার হয়েছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 March 2024, 03:54 PM
Updated : 24 March 2024, 03:54 PM

ভ্লাদিমির পুতিন পঞ্চম মেয়াদে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার এক সপ্তাহ না পেরোতেই ক্রাসনোগর্স্কে একটি সিটি হলের কনসার্টে ভয়াবহ প্রাণঘাতী হামলার শিকার হয়েছে রাজধানী মস্কো। দেশের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেওয়া পুতিনের জন্য এ এক ধাক্কা।

ক্রোকাস সিটি হলে শুক্রবার হামলা শুরুর সময় গান শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল সোভিয়েত আমলের রক সঙ্গীত দল ‘পিকনিক’। ৬২০০ দর্শক আসনের সিটি হলটি হামলার আগ মুহূর্তে কানায় কানায় পূর্ণ ছিল।

কনসার্ট উপভোগ করতে সমবেত দর্শকরা তাদের আসন গ্রহণ করার সময়ই একের পর এক গুলির শব্দের মধ্যে তারা চিৎকার করে বের হওয়ার দরজার দিকে ছুটে যান। হামলায় ১৫০ জন আহতও হয়েছে।

ইসলামিক স্টেট (আইএস) এ হামলার দায় স্বীকার করেছে। তবে পুতিন হামলাকারীদের সঙ্গে আইএস এর যোগ থাকা নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলেননি।

পুতিনের দাবি, ধরা পড়া চার সন্দেহভাজন ইউক্রেইনে পালানোর চেষ্টা করে এবং ইউক্রেইনের পক্ষ থেকে তাদেরকে সীমান্ত পেরোনোর পথ করে দেওয়া হয়।

তিনি বলেছেন, ওই চারজন কনসার্ট হল থেকে পালিয়ে মস্কো থেকে প্রায় ৩৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ব্রায়ানস্কের দিকে রওনা হয়েছিল। ওই অঞ্চলটি ইউক্রেইন সীমান্তে অবস্থিত। সেখানে ওই বন্দুকধারীদের লুকানোর ব্যবস্থা করে রেখেছিল ইউক্রেইন।

তবে শুক্রবারের হামলায় জড়িত থাকার দাবি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে ইউক্রেইন। মস্কো এ অভিযোগকে আক্রমণ বাড়ানোর অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করতে পারে বলেও সতর্ক করেছে কিইভ।

তবে আরও হামলার আশঙ্কা থাকায় রাশিয়াজুড়ে প্রধান পরিবহন কেন্দ্রগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। পাবলিক কনসার্ট ও ক্রীড়া ইভেন্ট পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।

রাশিয়ানরা মূলত দেশের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য এবার পুতিনকে ভোট দিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের এই উদ্দেশ্য ব্যর্থ হচ্ছে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

রাশিয়ার মতো সুবিশাল এবং টালমাটাল একটি দেশের নিরাপত্তা ও  শৃঙ্খলার নিশ্চয়তা দিতে বছরের পর বছর ধরে ক্রেমলিনের শক্তিশালী এই ব্যক্তিকেই যোগ্য নেতা হিসেবে বেছে নেওয়া হয়ে আসছে। কিন্তু আজ রাশিয়া পুতিনের ২৪ বছরের ক্ষমতার সবচেয়ে অনিরাপদ ও অস্থির সময় পার করছে বলেই মনে হচ্ছে।

ইউক্রেইন যুদ্ধের তৃতীয় বছর চলছে। এর চড়া মূল্য দিতে হয়েছে রাশিয়ার নাগরিকদেরকে। রাশিয়ার সামরিক বাহিনী হতাহতের পরিসংখ্যান প্রকাশ না করলেও যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া হিসাব বলেছে, আনুমানিক ৩ লাখের বেশি রুশ হতাহত হয়েছে।

গত বছর মোতায়েন অনেক সেনাকেই এখনও যুদ্ধের সম্মুখসারি থেকে সরানো হয়নি। এতে তাদের স্বজনরা উদ্বিগ্ন হচ্ছে। যুদ্ধ যতই এগিয়ে যাচ্ছে ততই নৃশংসতা আরও বেড়ে যাওয়া এবং আরও অনেকের যুদ্ধের বলি হওয়া নিয়ে ভয় বেড়ে যাচ্ছে রুশদের।

ইউক্রেইন ভিত্তিক রুশ জঙ্গিগোষ্ঠী ইউক্রেইনীয় ড্রোন ও সীমান্ত হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইউক্রেইনীয় ফ্রন্টে অস্ত্রসহ রুশ কমান্ডারদের দুর্বল অবস্থা অস্থিতিশীলতাসহ রাশিয়ার অভ্যন্তরে বিদ্রোহ, বিশেষত সামরিক ব্লগার ও সামরিক কট্টরপন্থিদের ভিন্নমত প্রকাশের একটি অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা বাড়াচ্ছে।

গত বছর রাশিয়ার ভাড়াটে সেনাদল ওয়াগনার প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিনের বিদ্রোহ ছিল তারই প্রমাণ। ওয়াগনারের বিদ্রোহ ক্রেমলিন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এক অন্যতম বিস্ময় এবং নজিরবিহীন অধ্যায় ছিল।

তবে ওই বিদ্রোহের বেশ কিছুদিন পর নানা নাটকীয়তা শেষে রহস্যময় বিমান দুর্ঘটনায় প্রিগোজিনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। এতে করে প্রিগোজিন নামক হুমকি পুতিনের পথ থেকে চিরস্থায়ীভাবে সরে যায়। কিন্তু প্রিগোজিন না থাকলেও অন্যান্য অসন্তুষ্ট কট্টরপন্থির আবির্ভাব ঘটতেও পারে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।

একইভাবে রাশিয়ার বিরোধীদলীয় নেতা অ্যালেক্সি নাভালনির সাম্প্রতিক মৃত্যুতে ক্রেমলিনের একজন সোচ্চার সমালোচকের চির প্রস্থান ঘটেছে। কিন্তু নাভালনির শেষকৃত্যে অংশ নিতে যারা মস্কোয় উপস্থিত হয়েছিলেন, কিংবা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের শেষ দিনে ভোটকেন্দ্রে মধ্য-দুপুরে পুতিনের বিরুদ্ধে ভোট দিতে বেরিয়েছিলেন, তারা এ ইঙ্গিতই দিয়েছেন যে, পুতিন-বিরোধীরা এখনও আছে, অসন্তোষের ভিত আছে।

কিন্তু এখন দৃষ্টি নিবদ্ধ হল রাশিয়ায় বড় ধরনের জঙ্গি হামলার পুনরুত্থানের দিকে, যার সঙ্গে ইউক্রেইন যুদ্ধ কিংবা ক্রেমলিনের অভ্যন্তরীন বিরোধিতার কোনও সম্পর্ক নেই। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সরকার মার্চের শুরুতেই এ ধরনের হামলার বিষয়ে রাশিয়াকে গোয়েন্দা বার্তা দিয়ে সতর্ক করেছিল। মার্কিন কর্মকর্তাদের দাবি, তারা কয়েক মাস ধরে রাশিয়াকে গোয়েন্দা তথ্য জানিয়ে এসেছেন।

কিন্তু কিছু কারণে পুতিন তা উপেক্ষা করেছেন। বিশেষ করে বতর্মান সময়ে আন্তর্জাতিক উত্তেজনা এবং অবিশ্বাসের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আসা সতর্কবার্তাকে হয়ত সন্দেহের চোখেই দেখেছেন তিনি।

মার্কিন গোয়েন্দা সতর্কবার্তাকে ‘উস্কানি... রুশ সমাজকে ভীত-সন্ত্রস্ত এবং অস্থিতিশীল করার’ অভিপ্রায় হিসেবে বর্ণনা করেছেন পুতিন। কারণ, এ সময়েই যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া সম্পর্ক ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ পর্যায়ে রয়েছে।

তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা তথ্য অনেক বেশি অস্পষ্ট এবং কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার মতো না বলেও মনে করে থাকতে পারে রাশিয়া। সেটিও হতে পারে আরেকটি কারণ।

কিন্তু একজন নেতা, যিনি রাশিয়ার জনগণকে নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতা এনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার জন্য রাশিয়ার মাটিতে বড় ধরনের একটি হামলা হওয়া অনেক বড় এক ধাক্কাই বটে।

সূত্র: সিএনএন