আফগানিস্তানের শহুরে জীবনে এমনকী গত সোমবার মধ্যরাতে যুক্তরাষ্ট্রের শেষ ফ্লাইটটি কাবুল বিমানবন্দর ছেড়ে যাওয়ার আগেও ছিল সুরের মূর্ছনা। উজ্জ্বল আর আড়ম্বরপূর্ণ অনেক স্থানও নজরে এসেছে। কিন্তু সেই দৃশ্য এখন বদলাতে শুরু করেছে।
Published : 31 Aug 2021, 11:05 PM
আফগানিস্তান ছেড়ে যারা যাওয়ার তারা চলে গেছে। পেছনে পড়ে থাকা আফগানরা এখন নতুন তালেবান শাসকদের বেড়াজালে নিজেদের মানিয়ে নিতে শুরু করেছে।
তালেবান শাসনে আফগানিস্তানের অনেকেই ভয়ে আছেন। কারও কাছে জীবন হয়ে উঠেছে বন্দির মতো। আবার অনেকেই মরিয়া হয়ে আছেন হাতে নগদ অর্থ আর একটু রুটি, পানি পাওয়ার জন্য।
তালেবান আফগানিস্তান দখলের পর থেকেই দেশের অভ্যন্তরীন ব্যাংকিং ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়েছে। ত্রাণ সহায়তার ওপর বেশিমাত্রায় নির্ভরশীল আফগান অর্থনীতি আগে থেকেই নাজুক ছিল। তার ওপর এখন তালেবান শাসনের কারণে পশ্চিমা দেশগুলো আফগানিস্তানে সহায়তা বন্ধ করায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।
অর্থ হস্তান্তরের আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো আফগানিস্তানে সেবা দেওয়া বন্ধ করেছে। বিদেশ থেকে যে আফগান পরিবারগুলো অর্থ পেত তা এখন পাচ্ছে না। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে। আফগানি মুদ্রার মান দ্রুত পড়ে যাওয়ায় বাড়ছে খাবারের দাম। হাতে নগদ অর্থ পাওয়ার জন্য মানুষ ক্রমেই মরিয়া হয়ে উঠছে।
ওদিকে, তালেবান নেতারা আছেন জয়ের আনন্দ উদযাপনের মেজাজে। কাবুল বিমানবন্দর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের শেষ বিমান উড়ে যাওয়ার পরপরই কাবুলজুড়ে উল্লাসে করেছে তালেবান। সেনাদের আফগানিস্তান ত্যাগকে ‘অন্য আগ্রাসীদের জন্য শিক্ষা’ হিসেবে অভিহিত করেছে তারা।
কাবুলের বাসিন্দাদের কারও কারও কাছে মার্কিন সেনাদের আফগান ছাড়ার বিষয়টি কাম্য হলেও এ মুহূর্তে খাবার এবং অর্থের জরুরি চাহিদাই প্রাধান্য পেয়েছে। কাবুলের এক বাসিন্দা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, “আমাকে বলতেই হয় যে, আমরা আমাদের মাতৃভূমিতে অন্য কোনও দেশকে চাই না। নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে তাতে আমরা খুশি। কিন্তু আমাদের রুটি, পানি দরকার।”
অন্যান্য বাসিন্দারা ব্যাংক ব্যবস্থায় অচলাবস্থা এবং কর্মক্ষেত্র নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এমনই এক বাসিন্দা বলেন, “ইসলামিক আমিরাতের সরকারের কাছ থেকে আমরা আশা করি ব্যাংকগুলো চালু হোক। কর্মীদেরকে কাজে যেতে দেওয়া হোক। আমাদের কাছে অর্থটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
নিজের দুরবস্থার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি ১৭/১৮ দিন ধরে ঘরে বসে আছি। এটি সহজ ব্যাপার নয়। কারণ, আমাদেরকে বাসা ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল এবং অন্যান্য খরচ মেটাতে হয়।”
তালেবান নেতারা এবং ঊর্ধ্বতন তালেবান কর্মকর্তারা এবার ক্ষমতা দখলের শুরু থেকেই লোকজনকে ভয় না পাওয়া, কাজে যাওয়া এবং ঐক্যের ডাক দিয়ে এসেছেন, যোদ্ধাদেরকে মানুষের সঙ্গে সম্মানজনক আচরণ করারও নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে ভিন্ন পরিস্থিতির কারণে দেশজুড়েই লোকজন আতঙ্কে আছে। অনেকেই তালেবান নেতাদের আশ্বাসে ভরসা পাচ্ছেন না এবং মাঠ পর্যায়ে তালেবান যোদ্ধাদের ওপর নেতারা নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবে বলে মনে করছেন না।
আফগানিস্তানের তৃতীয় বৃহত্তম নগরী হেরাতের এক বাসিন্দা তালেবান শাসনে জীবনের অনুভূতি জানিয়ে বলেছেন, “আমি যেনো এক বন্দি।” তালেবান এ মাসে ক্ষমতা দখলের পরই জীবন একেবারে বদলে গেছে বলে জানান তিনি। হেরাতের অন্যান্য বাসিন্দারাও জানিয়েছেন একই কথা আর বলেছেন, তারা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত।
আফগানিস্তানে গত ২০ বছরের পশ্চিমা-সমর্থিত সরকার ব্যবস্থায় রাজধানী কাবুল ও অন্যান্য নগরীতে গড়ে উঠেছিল প্রাণবন্ত এক জনপ্রিয় সংস্কৃতি। বডিবিল্ডিং, রকমারি চুলের স্টাইল, জোর আওয়াজে পপ গান কত কীই না চলেছে! তুর্কি সোপ অপেরা থেকে শুরু করে নানা অনুষ্ঠান এবং টিভিতে ‘আফগান স্টার শো’ হয়েছে বহুল জনপ্রিয়।
জালালাবাদ শহরে নেই কোনও সুরের মূর্ছনা। তালেবান যোদ্ধারা সেখানে মানুষজনকে মারধর করছে। লোকজন তাই এখন ভীত-সন্ত্রস্ত; এমনটিই জানিয়েছেন পূর্বাঞ্চলীয় নানগহর প্রদেশের এক সাবেক কর্মকর্তা।
তালেবান কাবুল দখলের পরই সম্প্রীতির ভাষায় কথা বলেছিল, শান্তির বার্তা দিয়ে তারা জানিয়েছিল সবকিছু শরিয়া আইন মতোই চলবে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিয়েও তারা বলেছিল, সবই চলবে; যতক্ষণ পর্যন্ত না তা শরিয়া আইনের বিরুদ্ধে এবং আফগানিস্তানের ইসলামিক সংস্কৃতির বাইরে যায়।
শরিয়া আইন অনুযায়ী যেন সব হয় তা নিশ্চিত করার প্রক্রিয়া এরই মধ্যে শুরুও করে দিয়েছে তালেবান। কাবুলের কাছের লেগমান প্রদেশের এক সাংবাদিক জানান, তালেবানের স্থানীয় সাংস্কৃতিক কমিশন রাষ্ট্র-পরিচালতি একটি রেডিও এবং ৬ টি বেসরকারি রেডিও স্টেশনকে শরিয়া আইনানুযায়ী অনুষ্ঠান করতে বলেছে।
কান্দাহারে তালেবান কর্তৃপক্ষ গত সপ্তাহে আনুষ্ঠানিকভাবেই নির্দেশ দিয়ে রেডিও স্টেশনগুলোকে গান-বাজনা এবং নারী কণ্ঠের ঘোষণা বন্ধ করতে বলেছে। যদিও এমন নির্দেশের কোনও দরকারই ছিল না। কারণ, তালেবানের ভয়ে অনেক কিছু আগে থেকেই বদলাতে শুরু করেছে।
বিউটি পার্লারের বাইরের রঙচঙে সাইনবোর্ড পেইন্ট দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। জিন্স বদলে মানুষজন দেশের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরছে। রেডিও স্টেশনগুলোতেও হিন্দি এবং পারস্য পপের বদলে টক-শো হচ্ছে এবং ভাবগম্ভীর দেশাত্মবোধক বাজনা বাজছে।
গজনি নগরীর একটি বেসরকারি রেডিও স্টেশনের প্রোডিউসার খালিদ সিদ্দিকীর কথায়, “তালেবান যে আমাদেরকে কিছু পরিবর্তন করার নির্দেশ দিয়েছে তা নয়, আমরা নিজেরাই অনুষ্ঠান পরিবর্তন করছি। তালেবান আমাদেরকে কিছু বন্ধ করতে বাধ্য করুক তা আমরা চাই না।”
“আর দেশের কোনও মানুষও এ মুহূর্তে বিনোদোনের মেজাজে নেই। আমরা সবাই একরকম অভিঘাতের মধ্যে আছি। কেউ এখন রেডিও শুনছে কিনা সে ব্যাপারেও আমি নিশ্চিত নই,” বলেন সিদ্দিকী।