জাপান কেন টোকিও অলিম্পিকস বাতিল করছে না?

টোকিও অলিম্পিকস যতই এগিয়ে আসছে, ক্রীড়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই আয়োজনের এবারের আসরটি মহামারীর কারণে বাতিলের আহ্বান ততই জোড়াল হচ্ছে। কিন্তু জাপান তাতে সাড়া দিচ্ছে না কেন?

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 May 2021, 06:39 PM
Updated : 16 May 2021, 06:39 PM

অলিম্পিক গেইমসের চুক্তির শর্তসহ নানা দিক বিশ্লেষণ করে এবং বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা হয়েছে বিবিসির এক প্রতিবেদনে।

অলিম্পিকস শুরুর আগে হাতে আছে আর দুই মাস। মহামারীতে জাপানের পরিস্থিতি যে ভালো, তেমনটা বলা যাচ্ছে না। সংক্রমণ বাড়তে থাকায় রাজধানী টোকিও এবং তিনটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় জরুরি অবস্থার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।

এ অবস্থায় অলিম্পিকস বাতিল করার পক্ষে জনমত ক্রমশ বাড়ছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও এ বিষয়ে একমত। কিন্তু আয়োজকদের পক্ষ থেকে এখনও কোনো আওয়াজ আসছে না।

সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, দেশটির ৭০ শতাংশ মানুষই চায় না অলিম্পিকস আয়োজন আর সামনে বাড়ুক। কিন্তু আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি (আইওসি) তাদের সিদ্ধান্তে অনড়।

২০২০ সালের গ্রীষ্মে টোকিও অলিম্পিকস হওয়ার কথা থাকলেও মহামারীর কারণে তা পেছানো হয়। জাপান সব সময় বলে আসছে, নিরাপদেই তারা এ আয়োজন সারবে।

ছবি: রয়টার্স

তবে জনমতের চাপের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিদে সুগা এ সপ্তাহের শুরুতে প্রথমবারের মত বলেন, সরকার অলিম্পিকসকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে- বিষয়টা তেমন নয়। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা আইওসির হাতে।

তাহলে অলিম্পিকস বাতিলের ক্ষমতা কার হাতে? সেরকম কোনো সিদ্ধান্ত কি আদৌ হবে?

অলিম্পিক গেইমস কীভাবে বাতিল হতে পারে?

আইওসি এবং আয়োজক নগরী টোকিওর সঙ্গে চুক্তিটা খুব সোজা। চুক্তির সনদে সেটা বাতিলের বিষয়ে কেবল একটি ধারা আছে, যেখানে বাতিলের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে কেবল আইওসি।

ক্রীড়া আইনজীবী আলেকজান্ডার মিগুয়েল মেস্ত্রে বিবিসিকে বলেন, চুক্তির ওই ধারার কারণ হল, অলিম্পিক গেইমস আইওসির ‘একক সম্পত্তি’। এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতার ‘মালিক’ হিসেবে চুক্তি বাতিল করতে পারে একমাত্র আইওসি।

অলিম্পিকস বাতিল করতে হলে যুদ্ধ এবং আয়োজক দেশে কোনো ধরনের নাগরিক অসন্তোষ বা আন্দোলন ছাড়া আর একটি মাত্র কারণই দেখানোর সুযোগ আছে।

আইওসির যদি মনে করে যে, প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদের নিরাপত্তা কোনো কারণে সত্যি সত্যি ‘হুমকির’ সম্মুখিন, তাহলে তারা কোনো আসর বাতিলের সিদ্ধান্ত দিতে পারে।

ছবি: রয়টার্স

এবারের মহামারীকে যৌক্তিকভাবেই সেরকমই একটি ‘হুমকি’ বিবেচনা করা যেতে পারে।

আইনজীবী মেস্ত্রে বলেন, অলিম্পিক চার্টারেও বলা আছে, অ্যাথলটদের সুস্বাস্থ্য এবং নিরাপদে খেলার ব্যবস্থা আইওসিকে নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু সব কিছুর পরও আইওসিকে এ আয়োজন এগিয়ে নিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বলেই মনে হচ্ছে।

সেক্ষেত্রে  জাপান কি আইওসির সিদ্ধান্তের বিপরীতে গিয়ে অলিম্পিকস থেকে নিজেদের ফিরিয়ে নিতে পারে?

ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্নের অধ্যাপক জ্যাক অ্যান্ডারসন বলেন, “চুক্তির বেশ কিছু ধারা অনুযায়ী জাপান যদি এককভাবে চুক্তি বাতিল করে, তাহলে ঝুঁকি এবং লোকসানের দায়ভার স্থানীয় আয়োজক কমিটির ওপর পড়বে।”

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ক্রীড়া আইনের এই বিশেষজ্ঞ বলেন, চুক্তিটি খুবই সাধারণ এবং সই করার আগে টোকিও সেসব বিষয় অবশ্যই জেনে নিয়েছে। কিন্তু এরকম একটা মহামারী যে হঠাৎ দৃশ্যপটে আবির্ভূত হবে, সেটা ছিল তাদের অনুমানের বাইরে।

“চুক্তি করার সময় ভবিষ্যতের সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবেলার মত অনেকগুলো বিষয়ও মাথায় রাখা হয়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি একেবারেই নজিরবিহীন।”

অধ্যাপক অ্যান্ডারসন বলেন, “বিশ্ব ক্রীড়ার সূচিতে অলিম্পিকস হল সবচেয়ে বড় আয়োজন। এর সম্প্রচার স্বত্বের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের হিসাব। এটা অনেক বড় একটা আয়োজন এবং সব পক্ষেরই এখানে অনেক শর্ত রয়েছে।”

ফলে জপানের জন্য বাস্তবসম্মত একমাত্র উপায় হল শর্ত মেনে আইওসির সঙ্গে যৌথভাব চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসা।

ছবি: রয়টার্স

যদি সেটা হয়, তখন সামনে আসবে বীমার প্রশ্ন। এই আয়োজন নিয়ে আইওসির বীমা করা আছে, স্থানীয় আয়োজক কমিটিরও বীমা আছে। অন্যান্য সম্প্রচার মাধ্যম এবং পৃষ্ঠপোষকদেরও বীমা আছে।

অধ্যাপক অ্যান্ডারসন বলেন, “টোকিও অলিম্পিকস যদি বাতিল হয়, তাহলে হয়তে এটা বলাই নিরাপদ হবে যে, প্রশ্নাতীতভাবেই এটা হবে বীমা পরিশোধের সবচেয়ে বড় ঘটনা।”

বীমার মাধ্যমে হয়ত আয়োজকদের মূল খরচটা উঠবে, কিন্তু এ আয়োজন ঘিরে সারা দেশে যে বিনিয়োগ হয়েছে, সেই পরোক্ষ খরচ আসবে না। যেমন পর্যটকদের জন্য হোটেল এবং রেস্তোরাঁগুলোর সংস্কারে অনেক খরচ হয়েছে, খেলা না হলে পর্যটকও আসবে না। 

জোর পাচ্ছে বিরোধীরা

টোকিও অলিম্পিকস ঘিরে কেবলই দীর্ঘ হচ্ছে অনিশ্চয়তা।

মহামারীর কারণে গত বছর এ অনুষ্ঠান স্থগিত করা হয়। রীতি অনুযায়ী অলিম্পিক মশাল দেশে দেশে ঘুরিয়ে আনার আয়োজনও বার বার বাধার মুখে পড়েছে। আন্তর্জাতিক দর্শকরা অলিম্পিকস দেখতে টোকিও যেতে পারবে না। এখন এমনকি স্টেডিয়াম খালি রেখেও প্রতিযোগিতার আয়োজন করার সম্ভাবনাও বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে।

বছরের পর বছর প্রশিক্ষণের পর একজন ক্রীড়াবিদ অলিম্পিক গেইমসের জন্য তৈরি হন। এ আয়োজনে অংশ নিতে পারা তার ক্রীড়াজীবনের উজ্জ্বলতম অংশ হয়ে থাকে।

এ সঙ্কট নিয়ে ক্রীড়াবিদদের মধ্যে যারা কথা বলেছেন, তাদের বক্তব্যে এসেছে দোটানায় পড়ে যাওয়ার কথা। মহামারীর মধ্যে নিজেদের এবং সবার স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টিও তাদের উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।

ছবি: রয়টার্স

জাপানের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া তারকা টেনিস চ্যাম্পিয়ন নাওমি ওসাকা তার দ্বিধার কথা বলেছেন খুব সতর্কতার সঙ্গে।

“আমি অবশ্যই চাই অলিম্পিকস হোক। কিন্ত আমার মনে হয়, অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও এর মধ্যে ঘটছে, বিশেষ করে গত বছর।

“আমার কাছে মনে হয়, এটা যদি মানুষকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে… তাহলে এটা নিয়ে অবশ্যই আলোচনা হওয়া উচিত। দিন শেষে আমি শুধুই একজন অ্যাথলেট, আর এদিকে রীতিমত একটা মহামারী চলছে।”

সুরক্ষা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে এ সপ্তাহের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড টিম জাপানে তাদের প্রশিক্ষণ শিবির বন্ধ করে দিয়েছে।

ওই দলকে আমন্ত্রণ জানানো জাপানের প্রাদেশিক গভর্নর বলেন, “আমার মনে হয় বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্তটাই নিয়েছে।”

এ প্রতিযোগিতার আয়োজনে জড়িতরাও একই ধরনের অনিশ্চয়তা বোধ করছেন।

অলিম্পিকস অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় টোকিওর বেশ কিছু শহর এরই মধ্যে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে।

এ সপ্তাহে স্থানীয় একজন গভর্নর জানিয়েছেন, অ্যাথলেটদের জন্য হাসপাতালে শয্যার ব্যবস্থা রাখার অনুরোধ তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন। আর আয়োজন স্থগিত কিংবা বাতিল করার বিষয়টি তিনি বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছেন।

ছবি: রয়টার্স

এ সপ্তাহে চিকিৎসকরদের একটি সংগঠন মহামারীর গতি প্রকৃতি তুলে ধরে সরকারকে বলেছে, এমন পরিস্থিতিতে ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন ‘অসম্ভব’।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের হুঁশিয়ারি এবং ক্রীড়া প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা জনমত গত কয়েক সপ্তাহে অনেকের দ্বিধা কাটিয়ে দিয়েছে।

অর্থের চেয়েও বড় যা

কেবল টাকার অংক নয়, অলিম্পিকস বাতিল করার ক্ষেত্রে আরও অনেক বিষয় বিবেচনা করার আছে জাপানের।

আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতে বসবে শীতকালীন অলিম্পিকসের আসর, আর এবারের আসরের আয়োজক হল চীন, যারা জাপানের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী।

ফলে জাপন যে টোকিও অলিম্পিকস আয়োজনের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ খুব বেশি নেই।

সবশেষ জাপানে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকস হয়েছিল সেই ১৯৬৪ সালে। আর সেই আয়োজন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশটির পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের প্রতীক হয়ে উঠেছিল।

টোকিও ২০২০/২০২১ গেইমসেরও যে একটি প্রতীকী গুরুত্ব আছে, সে বিষয়টি অধ্যাপক অ্যান্ডারসন ব্যাখ্যা করেন এভাবে: “দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিকভাবে স্থবির হয়ে আছে জাপান, সুনামি এবং ফুকুশিমার পারমাণবিক বিপর্যয় পার হয়েছে, তাই এই গেইমস হতে পারে জাপানের পুনর্জাগরণের প্রতীক। সে হিসেবে এর বিশেষ গুরুত্ব আছে।”

ফলে এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এগিয়ে নেওয়া উচিত কিনা, আর জাপান এই আয়োজন নিয়ে সামনে আগাবে কি না- দুটো আসলে ভিন্ন প্রশ্ন।

আধুনিক অলিম্পিকসের ইতিহাসে এ আয়োজন বাতিল করা হয়েছে মোট তিনবার। ১৯১৬, ১৯৪০ ও ১৯৪৪ সালের ওই তিন আসরই বাতিল হয়েছিল বিশ্বযুদ্ধের কারণে।

দাবি আর আহ্বান যতই প্রবল হোক, আইওসির অনড় অবস্থানের কারণে বেশিরভাগ বিশ্লেষক মনে করছেন, এবারের অলিম্পিক গেইমস যথাসময়ে, জুলাই মাসের ২৩ তারিখই শুরু হবে। তবে সেটা কীভাবে হবে, তা এখনও অস্পষ্ট।