কোভিড টিকা: বিশ্ব যখন সঙ্কটে, যুক্তরাষ্ট্র বসে আছে মজুদ নিয়ে

বিশ্বের বড় অংশ যখন করোনাভাইরাসের টিকা পাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায়, যুক্তরাষ্ট্র তখন কেবল বিপুল পরিমাণ ভ্যাকসিনই মজুদ করেনি, কাঁচামাল ও সরঞ্জামেরও বড় মজুদ গড়েছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 May 2021, 02:50 PM
Updated : 9 May 2021, 02:50 PM

কীভাবে তা সম্ভব হল? টিকা উৎপাদনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি কাঁচামালসহ সরঞ্জাম পাওয়ার ক্ষেত্রে দেশীয় কোম্পানিগুলো অগ্রাধিকার পেয়েছে। আর সরকার পেয়েছে টিকাপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা।

বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সরবরাহকারীদের সঙ্গে করা ডজন খানেকের বেশি চুক্তি পর্যালোচনা করে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে এ তথ্য।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের এই মজুদদারির কারণে টিকা নিয়ে সঙ্কটে থাকা কিছু দেশ ভীষণ দুরাবস্থায় পড়েছে; তাদের বিকল্প সংস্থান হচ্ছে না।

এর প্রভাব টিকা সরবরাহ ব্যবস্থাতেও পড়ছে। আর তাতে বৈষম্য বাড়ার চিত্র উঠে এসেছে সরবরাহকারী, অন্য দেশের উৎপাদক ও বাজার বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যে।

কোভিড-১৯ টিকার পেটেন্ট ও মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ চুক্তি সাময়িকভাবে শিথিলের জন্য যারা যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে চাপে রেখেছিলেন, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাতে সমর্থন দেওয়ায় তারা দারুন উচ্ছ্বসিত।

এখন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) ওই প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হলে অন্যান্য দেশও নিজেরা টিকা উৎপাদনের সুযোগ পাবে।

কিন্তু শুধু শর্ত শিথিল হলেই হবে না, টিকা বানাতে লাগবে উপকরণ আর প্রযুক্তি। পেটেন্ট ও মেধাস্বত্ব নিয়ে শোরগোলে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি আড়ালে পড়ে গেছে, তা হল- বিশ্বজুড়ে টিকা উৎপাদনের কাঁচামাল ও উৎপাদন সরঞ্জামের ক্রমবর্ধমান সঙ্কট।

টিকা তৈরি জন্য অত্যাবশ্যকীয় ফিল্টার, টিউবিং ও বিশেষায়িত ডিসপোজেবল ব্যাগের মত উপকরণ ও সরঞ্জামের বড় অংশের ওপর যুক্তরাষ্ট্র কড়া নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে।

ভারতসহ অন্য যেসব দেশ করোনাভাইরাসের সংক্রমণে বিপর্যস্ত, প্রস্তুতপ্রণালী জানা থাকলেও এসব উপকরণ ও সরঞ্জাম ছাড়া তারা টিকা উৎপাদন বাড়াতে পারবে না।

এই সঙ্কটের গোড়ায় রয়েছে ১৯৫০ এর দশকে কোরিয়া যুদ্ধের সময় প্রণীত ‘ডিফেন্স প্রোটেকশন অ্যাক্ট (ডিপিএ)’। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলোকে জাতীয় প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত কেনাকাটায় অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।

আর কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে সর্বাগ্রে স্থান দেওয়ার জন্য বিগত ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ওই আইন ব্যবহার করেছে।

এর ফলে আমেরিকার তৈরি টিকা ও অন্যান্য পণ্য কেনার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার প্রাধান্য পেয়েছে। প্রতিদানে টিকা উৎপাদকেরা যুক্তরাষ্ট্রের চাহিদা পূরণের স্বার্থে টিকা বানানোর যে কোনো উপকরণ সংগ্রহে অগ্রাধিকার পাচ্ছে।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, সরকার, ওষুধ কোম্পানি ও অন্যান্যদের একত্রিত করে গড়ে তোলা জোট গ্যাভি বিশ্বজুড়ে টিকার সহজলভ্যতা বাড়াতে বাইডেন প্রশাসনের পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে।

দরিদ্র দেশগুলোর জন্য টিকার সরবরাহ নিশ্চিত করতে গ্যাভি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মিলে গড়ে তুলেছে আন্তর্জাতিক জোট কোভ্যাক্স। আর কোভ্যাক্সে যুক্তরাষ্ট্রের ৪০০ কোটি ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতির কথাও গ্যাভির বার্তায় তুলে ধরা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সংরক্ষণমূলক আইন ‘ডিপিএ’ নিয়ে রয়টার্সের প্রশ্নের জবাবে গ্যাভির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, “কোভ্যাক্সের লক্ষ্য অর্জনের পথে সবচেয়ে বড় সঙ্কট হলো বিশ্বে টিকা সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেওয়া। কাঁচামাল রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ ও নিষেধাজ্ঞা এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে, যার ফলে মহামারীর স্থায়ীত্বই বাড়বে।”

তবে বাইডেন প্রশাসনের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, টিকা উৎপাদনের কাঁচামাল রপ্তানিতে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সব সরবরাহকারীই দেশের টিকা উৎপাদকদের চাহিদা মেটানোর পর তাদের পণ্য রপ্তানি করছে।

ওই কর্মকর্তার দাবি, টিকা উৎপাদনের উপকরণ নিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে ঘাটতি দেখা দেওয়ার পেছনে ডিপিএর কোনো ভূমিকা নেই। বরং অভূতপূর্ব চাহিদা সৃষ্টি হওয়াতেই সঙ্কট দেখা দিয়েছে।

আর যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি ক্যাথরিন টাই বুধবার পেটেন্ট শিথিলের প্রস্তাব সমর্থনের পর বিবৃতিতে বলেছেন, তাদের প্রশাসন ‘টিকার প্রয়োজনীয় কাঁচামালের উৎপাদন বাড়াতে কাজ করছে’।

তবে কীভাবে কী করা হচ্ছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু তিনি বলেননি।

ভারতের আবেদন

টিকা উৎপাদনের জন্য দরকারি উপকরণ যুক্তরাজ্য ও চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তৈরি হয়। কিন্তু থার্মো ফিশার সায়েন্টিফিক ইনকরপোরেশন ও ডানাহার করপোরেশনের অধীনে সিটিভা ও প্যালের মতো শীর্ষস্থানীয় সরবরাহকারীরা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক।

টিকা উৎপাদনে দরকারি উপকরণের কতটা আমেরিকায় তৈরি হয় সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেনি রয়টার্স।

তবে ডিপিএ যুক্তরাষ্ট্রকে এরইমধ্যে টিকার বড় মজুদ গড়ে তুলতে সহায়তা করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ কোম্পানিগুলোও এ থেকে বড় মুনাফা অর্জন করেছে।

যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৪৫ শতাংশ মানুষ টিকা নিয়েছেন। অথচ দক্ষিণ আমেরিকার গুয়াতেমালা থেকে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার থাইল্যান্ডের মত অনেক দেশই এখন পর্যন্ত এক শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে পারেনি।

বিশ্বজুড়ে কড়া সমালোচনার মুখে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের এই বৈষম্যমূলক আইন ডিপিএ। সমালোচকদের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে বড় টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইনডিয়াও রয়েছে।

ভারতীয় এ কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি টিকা উদ্ভাবক কোম্পানি নোভাভ্যাক্সের সঙ্গে মিলে বছরে একশ কোটি ডোজ টিকা উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র থেকে কাঁচামাল না পাওয়া গেলে তাদের উৎপাদন অর্ধেকের নিচে নেমে আসবে বলে সেরাম ইনস্টিটিউটের ওই পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত একজন রয়টার্সকে জানিয়েছেন।

অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত এবং এর লাইসেন্সের অধীনে কোভিশিল্ড নামে করোনাভাইরাসের টিকা উৎপাদন করছে সেরাম ইনস্টিটিউট। কয়েক সপ্তাহ ধরে অনুনয়  বিনয়ের পর গত মাসে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে টিকা উৎপাদনের ফিল্টার পাঠাতে রাজি হয়েছে।

শুধু সেরামই নয়, কোষ কালচারের জন্য দরকারি বায়োরিঅ্যাক্টর ব্যাগের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার টিকা উৎপাদক কোম্পানি বায়োভ্যাকও যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল।

বায়োভ্যাকের প্রধান নির্বাহী মোরেনা ম্যাখোয়ানা বলেন, ডিপিএর কারণে এসব ব্যাগ পেতে স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ সময় লাগতে পারে এবং চালান ১৪ মাস পর্যন্ত পেছাতে পারে বলে যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহকারী তাদের এরইমধ্যে সতর্ক করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে বিশ্ব বাজারে কী প্রভাব পড়ছে জানতে চাইলে অ্যাস্ট্রাজেনেকাম মডার্না বা জে অ্যান্ড জে কোনো মন্তব্য করেনি রয়টার্সের কাছে।

সরাসরি ডিপিএর কথা না তুললেও ফাইজার বলেছে, “আমাদের ব্যাপক ধকল পোহাতে হয়েছে... যেহেতু আমরা বিশ্বের সব জনগণকেই সেবা দিতে আগ্রহী।”

‘কল্পনাতীত চাহিদা’

কিছু সরবরাহকারী মনে করে, বিশ্বজুড়ে কাঁচামালের সরবরাহ নিশ্চিত করতে সীমাবদ্ধ সম্পদের ব্যবস্থাপনায় সরকারের চেয়ে শিল্পখাতের প্রতিষ্ঠানগুলোই ভালো কাজ করতে পারে।

থার্মো ফিশারের ভাইস প্রেসিডেন্ট মিশেল ল্যাগারদে বলেন, “যদি লক্ষ্যটি হয় টিকা উৎপাদন, তাহলে আমরা বিশ্বাস করি যে, আপনার উচিত শিল্পখাতকে সুযোগ করে দেওয়া, যাতে তারা কাঙ্ক্ষিত পণ্যটি উৎপাদনের জন্য সব ধরনের সংশ্লিষ্ট অংশ একত্রিত করতে পারে।”

বাইডেন প্রশাসনের এক কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সংস্থার বিশেষজ্ঞরা ওই আইনের ব্যবহার নিয়ে পর্যালোচনা করছেন।

অন্য দেশের টিকা পাওয়া নিশ্চিত করতে অনেক সময় কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রে সরবরাহের তারিখ পরিবর্তন করতে পারেন। তবে সরবরাহকারীরা চাহিদার চেয়ে এগিয়ে থাকার পরিকল্পনা করছে।

সিটিভা, প্যাল ও থার্মো ফিশারের মতো কোম্পানিগুলো তাদের উৎপাদন অবকাঠামোর বিস্তার করছে যুক্তরাষ্ট্রে এবং অন্যান্য দেশে।

সিটিভা এক বিবৃতিতে বলেছে, যে তারা উৎপাদন বাড়াচ্ছে, কিন্তু নিজেরাই কিছু কাঁচামালের ঘাটতিতে রয়েছে।

তাদের ভাষায়, বায়োফার্মাসিউটিক্যালস পণ্য ও প্রযুক্তির একটি ‘অভূতপূর্ব চাহিদার’ মুখোমুখি হয়েছে বিশ্ব।