অং সান সু চি: গণতন্ত্রের পাখি আবার খাঁচায় বন্দি

পনের বছরের গৃহবন্দিত্বের অবসানের পর ২০১০ সালে মুক্তি পেয়েছিলেন অং সান সু চি, তার ১০ বছর কাটতে না কাটতেই আবারও বন্দি করা হল তাকে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Feb 2021, 06:18 PM
Updated : 1 Feb 2021, 07:50 PM

সামরিক শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট মিয়ানমারে বন্দি সু চি হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বজুড়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অনুপ্রেরণার নাম।

অভ্যন্তরীণ আর আন্তর্জাতিক চাপ মিলিয়ে মিয়ানমার গণতন্ত্রে ফেরার প্রক্রিয়ায় ১০ বছর আগে মুক্তি মিলেছিল সু চির। নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায়ও গিয়েছিল তার দল।

তবে ক্ষমতার রাশ যে দেশটির প্রবল প্রতাপশালী সেনাবাহিনীর হাতেই ছিল, তা আঁচ করা যাচ্ছিল।

সে কারণে রোহিঙ্গা নির্যাতনের ঘটনা বিশ্বে সু চির আকাশছোঁয়া ভাবমূর্তি অনেকটা ম্লান করলেও দেশের রাজনীতিতে তিনি যে সেনাবাহিনীর হাতে অনেকটাই বাঁধা ছিলেন, তা তার সমালোচকরাও স্বীকার করেন।

আর তারই নগ্ন প্রকাশ ঘটল সোমবার; জরুরি অবস্থা জারি করে মিয়ানমারের শাসনভার নিল সেনাবাহিনী; বন্দি করা হল সু চিসহ তার দল এনএলডির নেতাদের।

মিয়ানমারে গণতন্ত্র সু চির উপর ভর করেই উড়ছিল, এখন তাতে আবার ছেদ পড়ল।

৭৫ বছর বয়সী সু চির জন্ম ১৯৪৫ সালের ১৯ জুন। উত্তরাধিকার সূত্রেই রাজনীতিতে আসা তার।

সু চির বাবা ছিলেন মিয়ানমারের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা অং সান; দেশটির জাতির জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাকে।

বাবার নামের প্রথম অংশটি যুক্ত হয়েছে সু চির নামের সঙ্গে। তার মা মা খিন কি ছিলেন একজন কূটনীতিক, ভারতে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বেও ছিলেন তিনি।

১৯৪৭ সালে মিয়ানমারের স্বাধীনতার পরপরই সেনা অভ্যুত্থানে হত্যা করা হয় অং সানকে; শুরু হয় সু চির ঝঞ্ঝাময় জীবন।

প্রথম জীবনের একটি অংশ ভারতে কাটানোর পর যুক্তরাজ্যে যান সু চি; সেখানে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়েন দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে।

১৯৭২ সালে বিয়েও করেন একজন ব্রিটিশকে, যার নাম মাইকেল অ্যারিস। তাদের দুই সন্তান কিম ও আলেক্সান্ডার। অ্যারিস ১৯৯৯ সালে মারা যান, তখন সু চি দেশে বন্দি।

ছবি: রয়টার্স

ঘটনাবহুল জীবনের ঘটনাক্রম

১৯৬৪: যুক্তরাজ্যে গমন, উদ্দেশ্য অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়া।

১৯৬৯-৭১: নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে সহকারী সচিব হিসেবে কাজ করেন।

১৯৮৫-৮৬: ভিজিটিং স্কলার হিসেবে কাজ করেন জাপানের কিয়োতো ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর সাউথইস্ট এশিয়ান স্টাডিজ বিভাগে।

১৯৮৭: ভারতের শিমলায় ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজে কাজ করেন।

১৯৮৮ (এপ্রিল): মায়ের গুরুতর অসুস্থতার পর দেশে ফিরলেন।

১৯৮৮ (২৬ অগাস্ট): দেশে জনসমক্ষে প্রথম ভাষণ, বললেন বহুদলীয় গণতন্ত্রের কথা।

১৯৮৮ (২৪ সেপ্টেম্বর): প্রতিষ্ঠা করলেন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি); দলের মহাসচিবে দায়িত্ব নিলেন।

১৯৮৯ (২০ জুলাই): গৃহবন্দি হলেন; অভিযোগ, সেনাবাহিনীতে বিভেদ ছড়ানোর চেষ্টা, যদিও অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।

অং সান সু চি। ছবি: রয়টার্স

১৯৯০ (২৭ মে): নির্বাচনে আইনসভার ৮০ শতাংশ আসনে জয়ী এনএলডি। তবে ফল দেখে সে নির্বাচনকে স্বীকৃতি দিল না স্টেট ল অ্যান্ড অর্ডার রেস্টোরেশন কাউন্সিল।

১৯৯১ (১০ জুলাই): ইউরোপীয় পার্লামেন্ট কর্তৃক শাখারভ পুরস্কারে ভূষিত মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সরব থাকার জন্য।

১৯৯১ (১৪ অক্টোবর): গণতন্ত্রের জন্য অহিংস সংগ্রামের জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়।

১৯৯৫ (১০ জুলাই): গৃহবন্দি দশা থেকে মুক্তি, তবে রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ নিয়ন্ত্রিত থাকল।

২০০০ (সেপ্টেম্বর): আবারও গৃহবন্দি।

২০০০ (৬ ডিসেম্বর): যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন দিলেন প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম।

২০০২ (৬ মে): গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি।

২০০৩ (৩০ মে): রাস্তায় গাড়িবহরে জান্তা সরকারের সমর্থকদের হামলা; এরপর ফের গৃহবন্দি।

২০০৪ (২৯ নভেম্বর): গৃহবন্দিত্বের মেয়াদ আরও এক বছর ‍বৃদ্ধি।

২০০৬ (মে): গৃহবন্দিত্বের মেয়াদ বাড়ল আরও এক বছর।

অং সান সু চি। ছবি: রয়টার্স

২০০৬ (৯ জুন): অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার খবর প্রকাশ।

২০০৭ (২৫ মে): আরও এক বছর বাড়ানো হল গৃহবন্দিত্বের মেয়াদ।

২০০৮: যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল পেলেন।

২০০৮ (২৭ মে): গৃহবন্দি দশার মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানো হল।

২০০৯ (১৪ মে): গৃহবন্দিত্বের শর্ত ভাঙার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হল।

২০০৯ (১৮ মে): গৃহবন্দিত্বের শর্ত ভাঙার অভিযোগের বিচার শুরু।

২০০৯ (১১ অগাস্ট): গৃহবন্দিত্বের শর্ত ভাঙায় দোষি সাব্যস্ত; সাজা ১৮ মাসের বন্দিজীবন।

২০১০ (৭ মে): নির্বাচনে অংশ নিতে নিবন্ধন করাতে অস্বীকার এনএলডির। ফলে রাজনৈতিক দল হিসেবে সক্রিয় থাকায় অযোগ্য ঘোষণা।

২০১০ (১৩ নভেম্বর): ২১ বছরের মধ্যে ১৫ বছর বন্দি থাকার পর মিলল মুক্তি।

২০১০ সালে মুক্তি পাওয়ার পর সমর্থকদের সঙ্গে অং সান সু চি। ছবি: রয়টার্স

২০১০ (১৫ নভেম্বর): মুক্ত হয়ে দলের দপ্তরে সংবাদ সম্মেলন করে বললেন, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় লড়াই চালিয়ে যাবেন।

২০১১ (২৮ জানুয়ারি): বিশ্ব অ্থনৈতিক ফোরামে সু চির রেকর্ড করা ভাষণ প্রচার।

২০১১ (১৮ নভেম্বর): পরবর্তী নির্বাচনের এনএলডি জানাল, প্রার্থী হবেন সু চি।

২০১১ (১৩ ডিসেম্বর): ভোটে অংশ নিতে নিবন্ধন করাল এনএলডি।

২০১২ (১ এপ্রিল): ১৯৯০ সালের পর মিয়ানমারে প্রথম নির্বাচনে একটি আসনে জিতে এলেন সু চি।

২০১২ (২ মে): পার্লামেন্টে বিরোধী দলের সদস্য হিসেবে দলের ৩৩ নেতাকে নিয়ে শপথ গ্রহণ।

অং সান সু চি। ছবি: রয়টার্স

২০১২ (২৯ মে): দুই দশকে প্রথম বিদেশে পা রাখলেন থাইল্যান্ড সফরের মধ্য দিয়ে।

২০১২ (১ জুন): বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামে প্রথম ভাষণ দিলেন।

২০১২ (১৬ জুন): নোবেল পদক পাওয়ার সময় থাকতে পারেননি; দুই দশক পর অসলোতে গিয়ে দিলেন ভাষণ।

২০১২ (২১ জুন): যুক্তরাজ্য সফরে হাউস অব লর্ডস ও হাউস অব কমন্সে দিলেন ভাষণ।

২০১২ (সেপ্টেম্বর ১৯):  ওয়াশিংটন সফরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সঙ্গে সাক্ষাৎ।

২০১৩ (১০ মার্চ): পার্লামেন্টে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে পুনর্নির্বাচিত।

২০১৫ (১০-১৪ জুন): প্রথম সফরে চীনে; শি জিনপিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ।

২০১৫ (১৩ নভেম্বর): মিয়ানমারের প্রথম অবাধ নির্বাচনে এনএলডির ঐতিহাসিক জয়। তবে সু চির প্রেসিডেন্ট হওয়ায় সাংবিধানিক বাধা আছে বলে জানানো হয়, কারণ তিনি একজন বিদেশিকে বিয়ে করেছেন।

২০১৬ (৫ এপ্রিল): স্টেট কাউন্সেলর হিসেবে সু চির নাম ঘোষণা, যে পদটি বিশেষভাবে তার জন্যই সৃষ্টি করা হয়। আর এরমধ্য দিয়ে দৃশ্যত রাষ্ট্র পরিচালনায় আবির্ভূত হন তিনি।  

২০১৭ (৫ এপ্রিল): বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রাখাইনে রোহিঙ্গা নিপীড়নের অভিযোগ অস্বীকার করেন।

২০১৭ (অগাস্ট): রাখাইনে সেনা অভিযানে নিপীড়নের মুখে লাখ লাখ রোহিঙ্গার বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ।

সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে অং সান সু চি। ছবি: রয়টার্স

২০১৮ (৭ মার্চ): সু চিকে দেওয়া পদক রোহিঙ্গা নিপীড়নের জন্য প্রত্যাহার করল যুক্তরাষ্ট্রের হলোকাস্ট মিউজিয়াম।

২০১৮ (১৩ নভেম্বর): সু চিকে দেওয়া সম্মাননা প্রত্যাহার করল অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও।

২০১৯ (ডিসেম্বর): রোহিঙ্গা গণহত্যার জন্য নেদারল্যান্ডসে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে বিচারে মিয়ানমার সরকারের প্রতিনিধি দলে নেতৃত্ব দেন সু চি।

২০২০ (২৩ জানুয়ারি): রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধ এবং গণহত্যার প্রমাণ নিশ্চিহ্ন করা বন্ধ করতে মিয়ানমারকে জাতিসংঘ আদালতের নির্দেশ।

২০২০ (নভেম্বর): নির্বাচনে আবারও এনএলডির জয় ঘোষণা, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন। সেনা সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) জানাল, ভোট সুষ্ঠু হয়নি, তাই আবার নির্বাচন দিতে হবে।

২০২১ (১ ফেব্রুয়ারি): ক্ষমতা নিল সেনাবাহিনী। সু চিসহ এনএলডির শীর্ষনেতারা বন্দি। এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা জারি।