করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নতুন মাত্রা পাচ্ছে?

দক্ষিণ কোরিয়ায় এক দিনেই নতুন করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে, প্রথমবারের মতো সংক্রমণ ধরা পড়েছে ইসরায়েল, লেবাননে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Feb 2020, 08:04 PM
Updated : 22 Feb 2020, 05:03 AM

প্রাণঘাতী এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে ইরানের আধা ডজন শহরে, মৃত্যু ঘটিয়েছে আরও দুইজনের। নতুন রোগীর সংখ্যা বেড়েছে ইতালি ও জাপানেও। জাপানের উপকূলে একটি প্রমোদতরীতে ছয়শর বেশি মানুষকে রাখা হয়েছে কোয়ারেন্টিনে।

এতদিন নতুন করোনাভাইরাসের প্রকোপ চীনের মধ্যেই ছিল বেশি। কিন্তু গত কয়েক দিনে চীনের বাইরে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যে গতিতে নতুন রোগী বাড়ছে তাতে কভিড-১৯ নাম পাওয়া এ রোগের প্রাদুর্ভাব নতুন দিকে মোড় নেওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে স্ট্রেইটস টাইমস।

অস্ট্রেলিয়া অ্যান্ড নিউ জিল্যান্ড ব্যাংকিং গ্রুপের এশিয়া রিসার্চের প্রধান খুন গো বলছেন, “এশিয়ার অন্যান্য অংশে বিশেষ করে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় হঠাৎ করে এই ভাইরাস সংক্রমণ যেভাবে বেড়েছে তা আবার উদ্বেগ তৈরি করেছে।

“এটা এই রোগ সংক্রমণের নতুন ধাপের দিকে ইঙ্গিত করছে এবং এতে জনজীবন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি আগে যা ভাবা হয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশি অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে ফেলবে।”

ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীনে প্রথম করোনাভাইরাস সংক্রমণ দেখা দেওয়ার পর ২৯টি দেশে এই রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। তবে চীনের মূল ভূখণ্ডের বাইরে আক্রান্তের সংখ্যা এতদিন ছিল তুলনামূলক কম। নতুন এই করোনাভাইরাসে সোয়া দুই হাজারের মতো মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যাদের মধ্যে চীনের বাইরে রয়েছে ১৫ জন।

এই রোগ যাতে অন্যান্য দেশেও মহামারি আকার না নেয় সেজন্য এখনই সর্বোচ্চ তৎপরতা চালানো জরুরি বলে মনে করছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানম গেব্রিয়েসাস।

তার মতে, এখনও মনে করেন এই ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকানো যাবে।

“তবে সুযোগগুলো ক্রমশ কমে আসছে। তাই সুযোগ পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই আমাদের দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।”

এই ভাইরাস সংক্রমণ যে কোনো দিকে যেতে পারে বলে সতর্ক করে তেদ্রোস বলেন, “যদি আমরা ঠিকভাবে কাজ করি তাহলে গুরুতর সংকট এড়াতে পারব। তবে আমরা যদি সুযোগগুলো নষ্ট করি তাহলে আমাদের সামনে ভয়াবহ বিপদ।”

গত দুই দিনের মধ্যে ইরানে নতুন ১৮ জনের নভেল করোনাভাইরাস ধরা পড়া এবং চারজনের মৃত্যুর খবর ‘খুবই উদ্বেগের’ বলে মন্তব্য করেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক।তেহরানকে এই রোগের পরীক্ষায় কিট সরবরাহ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে কওম শহর থেকে। সেখান থেকে মানুষের চলাচলের মধ্য দিয়ে ভাইরাস ছড়িয়ে গেছে তেহরান, বাবোল, আরাক, ইসফাহান, রাস্তসহ অন্যান্য শহরে। সব মিলিয়ে নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮ জনে।

নতুন আক্রান্তদের সাতজনই কওম শহরের। তেহরানে আক্রান্ত হয়েছে চারজন এবং গিলান প্রদেশে দুইজন আক্রান্ত হয়েছে বলে এক টুইটে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র।

কওম শহরে কাজ করা চীনা শ্রমিকদের কাছ থেকেই সম্ভবত এ ভাইরাস ছড়িয়েছে বলে ধারণা করছেন ইরানের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। বৃহস্পতিবার থেকে ওই শহরে সব ধর্মীয় সমাবেশ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

দক্ষিণ কোরিয়ায় উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলা করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। দেশটিতে নতুন করে ১০০ জন এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এবং দ্বিতীয় আরেকজনের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর এ বাস্তবতাকে ‘জরুরি পরিস্থিতি’ বলে বর্ণনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী চুং সাই-কিয়ুন।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ কোরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর দায়েগু ও চেওংডোকে ‘স্পেশাল কেয়ার জোন’ ঘোষণা করা হয়েছে। আতঙ্কে দায়েগু শহরের সব রাস্তা ফাঁকা হয়ে গেছে।

বৃহস্পতিবার দেশটিতে করোনাভাইরাসে একজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। শুক্রবার এ ভাইরাস সংক্রমিত দ্বিতীয় আরেকজনের মৃত্যু হয়। তারা দেশের প্রথম করোনাভাইরাস রোগী হিসাবে চেওংডোর একই মানসিক হাসপাতালে ছিলেন। সেখানকার আরও ১৫ রোগীরও ভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়েছে।

বৃহস্পতিবার ৩৫ জন এ ভাইরাসে নতুন আক্রান্ত হয়েছেন। সব মিলিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০৪ জনে। চীনের চৌহদ্দি এবং জাপানের প্রমোদতরীর বাইরে দক্ষিণ কোরিয়াতেই করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।

এদিকে তিন সেনার করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ায় সব সামরিক ঘাঁটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

শুক্রবার নতুন আক্রান্ত ১০০ জনের ৮৬ জনই রাজধানী সিউলের ৩০০ কিলোমিটার দক্ষিণপূর্বে দায়েগু শহরের বাসিন্দা। সংক্রমণ বাড়তে থাকায় সরকার এ ভাইরাসের বিস্তার রোধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

বার্তা সংস্থা ইয়ুনহাপকে প্রধানমন্ত্রী চুং বলেছেন, “আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে যারা এসেছেন তাদের তাৎক্ষণিকভাবে খুঁজে বের করতে হবে এবং রোগীদের চিকিৎসা দিতে হবে।”

ভাইরাসটি এখন স্থানীয়ভাবে ছড়াচ্ছে বলে সতর্ক করেন তিনি।

এদিকে জাপানে নতুন করে নয়জনের নভেল করোনাভাইরাস ধরা পড়েছে এবং এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ৭২৬ জনে দাঁড়িয়েছে বলে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।

আক্রান্তদের মধ্যে ৬৩৯ জনই প্রমোদতরী ডায়মন্ড প্রিন্সেসের আরোহী। তাদের বাইরে জাপানের মূল ভূখণ্ডের ৮৭ জন এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।

সিএনএনের এক খবরে সিঙ্গাপুরে নতুন করে একজনের নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্তের খবর দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে দেশটিতে মোট ৮৬ জনের এই রোগ ধরা পড়ার তথ্য দিয়েছে সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

লেবাননেও অন্তত একজনের করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঘটেছে বলে দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী হামাদ হাসান জানিয়েছেন।

শুক্রবার তিনি এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, ৪৫ বছরের ওই নারী গতকালই ইরানের কওম শহর থেকে এসেছেন।

এর বাইরে আরও দুজন পর্যবেক্ষণে আছেন জানিয়ে লেবাননের স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, এখন থেকে ইরানফেরত সবাইকে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে রাখা হবে।

ইসরায়েলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও শুক্রবার সকালে বিবৃতিতে এক নারীর করোনাভাইরাস সংক্রমণের তথ্য জানিয়েছে। প্রমোদতরী ডায়মন্ড প্রিন্সেসের যে ১১ জন যাত্রীকে জাপান থেকে ইসরায়েলে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে ছিলেন ওই নারী।

তার সঙ্গীদের করোনাভাইরাস পরীক্ষায় নেভেটিভ ফল এলেও সবাইকে রাজধানী তেল আবিবের কাছে একটি মেডিকেল সেন্টারে ১৪ দিন আলাদা করে রাখা হচ্ছে।

জাপানের ইয়োকোহামা বন্দরে কোয়ারেন্টিনে থাকা প্রমোদতরী ডায়মন্ড প্রিন্সেস। ছবি: রয়টার্স

এই ১১ জনের বাইরে ইসরায়েলের আরও চার নাগরিক ওই প্রমোদতরীতে ছিলেন। আগেই তাদের করোনাভাইরাস ধরা পড়ায় তারা জাপানেই রয়ে গেছেন।

এদিকে ইতালির উত্তরাঞ্চলে একদিনেই ১৬ জনের নভেল করোনাভাইরাস ধরা পড়ার তথ্য দিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুক্রবার উত্তরাঞ্চলীয় লোমবারডি এলাকায় ১৪ জন এবং তার পাশের ভেনেতো এলাকায় দুই জনের এই ভাইরাস সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়া গেছে।

করোনাভাইরাসের সবচেয়ে বেশি আক্রমণ যেখানে সেই চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার দেশটির মূল ভূখণ্ডে ৮৮৯ জনের শরীরে নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। আগের দিন এই সংখ্যা ছিল ৩৯৪ জন।

সব মিলিয়ে চীনে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৫ হাজার ৪৬৫ জনে। আর অন্তত ২৬টি দেশে এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় বিশ্বে আক্রান্তের সংখ্যা ৭৬ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।

চীনের মূল ভূখণ্ডের বাইরে যে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে তাদের মধ্যে ইরানে চারজন, জাপানে তিনজন, হংকংয়ে দুজন এবং ফিলিপিন্স, ফ্রান্স, তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় একজন করে রয়েছে।

ডায়মন্ড প্রিন্সেস থেকে নেমে আসা এক যাত্রীর চারপাশে গণমাধ্যম কর্মীদের ভিড়। ছবি: রয়টার্স

মধ্য চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে গত ৩১ ডিসেম্বর নভেল করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত করা হয়। নিউমোনিয়ার মত লক্ষণ নিয়ে নতুন এ রোগ ছড়াতে দেখে চীনা কর্তৃপক্ষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সতর্ক করে। এরপর ১১ জানুয়ারি প্রথম একজনের মৃত্যু হয়।

ঠিক কীভাবে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হয়েছিল- সে বিষয়ে এখনও নিশ্চিত নন বিশেষজ্ঞরা। তবে ধারণা করা হচ্ছে, উহানের একটি সি ফুড মার্কেটে কোনো প্রাণী থেকে এ ভাইরাস প্রথম মানুষের দেহে আসে। তারপর মানুষ থেকে ছড়াতে থাকে মানুষে।