ইসাবেলা: ‘অ্যাঙ্গোলাকে শোষণ’ করে আফ্রিকার শীর্ষ ধনী নারী

আফ্রিকার শীর্ষ ধনী নারী কিভাবে নিজের দেশকে শোষণ করে ও দুর্নীতির মাধ্যমে নিজের ভাগ্য গড়ে তুলেছেন ফাঁস হওয়া নথিতে তা প্রকাশ পেয়েছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Jan 2020, 10:38 AM
Updated : 20 Jan 2020, 10:55 AM

আফ্রিকার খনিজ সম্পদে সম্পদ দেশ অ্যাঙ্গোলার নারী ইসাবেল দোস সান্তোস দেশটির জমি, খনিজ তেল, হীরা ও টেলিকম খাতের লাভজনক চুক্তিতে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন যখন তার বাবা হোসে এদুয়ার্দো দোস সান্তোস দেশটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন।

এদুয়ার্দো দোস সান্তোস ১৯৭৯ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত একটানা অ্যাঙ্গোলার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি অ্যাঙ্গেলার সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফও ছিলেন। পাশাপাশি রাজনৈতিক দল পিপলস মুভমেন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব অ্যাঙ্গোলার (এমপিএলএ) সভাপতিও ছিলেন তিনি। 

১৯৭৫ সালে পতুর্গালের উপনিবেশ অ্যাঙ্গোলা স্বাধীনতা লাভ করার কয়েক বছরের মধ্যেই দেশটির প্রেসিডেন্ট হন এদুয়ার্দো দোস সান্তোস। এরপর ৩৮ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকাকালে কঠোর হস্তে দেশ শাসন করেন তিনি। 

বিবিসি প্যানারোমা জানিয়েছে, সম্প্রতি ফাঁস হওয়া নথিতে দেখা গেছে তার কন্যা ইসাবেল ও ইসাবেলের স্বামী সিন্ধিকা দোকলোকে একের পর এক সন্দেহজনক ‍চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের মূল্যবান সম্পদ ক্রয় করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। 

অ্যাঙ্গোলার সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসে এদুয়ার্দো দোস সান্তোস ৩৮ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকাকালে কঠোর হস্তে দেশ শাসন করেন। ছবি: রয়টার্স

এর মধ্যে অন্যতম সবচেয়ে সন্দেহজনক চুক্তিটি অ্যাঙ্গোলার রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি সোনাঙ্গোলের যুক্তরাজ্যভিত্তিক অধীনস্থ একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করা হয়েছিল।

২০১৬ সালে ইসাবেলকে ধুঁকতে থাকা সোনাঙ্গোলের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর পরের বছর ২০১৭-র সেপ্টেম্বরে তার বাবা প্রেসিডেন্ট পদ থেকে অবসরে যান। এর দুই মাসের মাথায় ইসাবেলকে পদচ্যুত করা হয়।

ফাঁস হওয়া নথিতে দেখা গেছে, সোনাঙ্গোলা ছাড়ার সময় ইসাবেল দুবাইয়ের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘ম্যাটার বিজনেস সলিউশন্স’কে পাঁচ কোটি ৮০ লাখ ডলার পারিশ্রমিক দেওয়ার অনুমোদন দিয়ে গেছেন।

ম্যাটারের সঙ্গে তার কোনো আর্থিক লেনদেন নেই বলে দাবি করেছেন ইসাবেল। কিন্তু ফাঁস হওয়া নথিতে দেখা গেছে তার নিজের ব্যবসার পরিচালকই ম্যাটারের পরিচালক এবং সেটির মালিক তার এক বন্ধু।

যেদিন ইসাবেলকে পদচ্যুত করা হয় সেইদিনই সোনাঙ্গোলার লন্ডন দপ্তরে ৫০টিরও বেশি ইনভয়েস পাঠায় ম্যাটার। ম্যাটার পরামর্শ দেওয়ার কিছু কাজ করলেও ইনভয়েসে যে বড় অঙ্কের বিল তারা পাঠিয়েছে সেটির ন্যায্যতা প্রমাণ করার মতো বিস্তারিত নথি তারা দেখাতে পারেনি বলে জানিয়েছে বিবিসি প্যানারোমা।

এর মধ্যে প্রতিটি ছয় লাখ ৭৬ হাজার ৩৩৯ পাউন্ডের দুটি ইনভয়েস একই তারিখের পুরোপুরি একই কাজের জন্য হলেও ইসাবেল দুটিতেই স্বাক্ষর করেছেন।  

ইসাবেল তার অধিকাংশ সম্পদ অর্জন করেছেন পর্তুগিজ জ্বালানি কোম্পানি গালপ এর মালিকানার অংশীদারিত্বের মাধ্যমে। ২০০৬ সালে সোনাঙ্গোলার কাছ থেকে গালপ এর শেয়ারগুলো কিনে নিয়েছিল ইসাবেলের মালিকানাধীন একটি কোম্পানি।

নথিতে দেখা যায়, এইসব শেয়ারের জন্য ইসাবেলের কোম্পানিকে মাত্র ১৫ শতাংশ অর্থ পরিশোধ করতে হয়েছে বাকি ছয় কোটি ৩০ লাখ পাউন্ড সোনাঙ্গোলার কাছ থেকে স্বল্প সুদে নেওয়া ঋণ হিসেবে দেখানো হয়েছে।

ইসাবেল দোস সান্তোস ও তার স্বামী সিন্ধিকা দোকলো। ছবি: টাইম টোয়েন্টিফোর নিউজ

উদার শর্তাবলীর কারণে অ্যাঙ্গোলার জনগণের কাছ থেকে নেওয়া তার ঋণ পরবর্তী ১১ বছরেও শোধ করতে হয়নি। 

গালপে ইসাবেলের মালিকানাধীন শেয়ারের মূল্য এখন ৭৫ কোটি পাউন্ডেরও বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সোনাঙ্গোলা থেকে নেওয়া ঋণ ২০১৭ সালে পরিশোধের প্রস্তাব দেয় ইসাবেলের কোম্পানি। কিন্তু ঋণের প্রায় ৯০ লাখ পাউন্ড সুদ যুক্ত না থাকায় ঋণ পরিশোধের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা উচিত ছিল সোনাঙ্গোলার। কিন্তু সোনাঙ্গোলার প্রধান হিসেবে ইসাবেল ওই সময় সেটিকেই তার নিজের ঋণের পুরো পেমেন্ট হিসেবে গ্রহণ করেন।

এর ছয় দিন পর তাকে পদচ্যুত করা হয় এবং সোনাঙ্গোলার নতুন ব্যবস্থাপনা পরিষদ ওই ঋণ পরিশোধের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে গ্রহণ করা অর্থ ফেরত দেয়।   

অ্যাঙ্গোলার ডায়মন্ড শিল্প, টেলিকমিউনিকেশ খাত ও জমি ক্রয় ও বরাদ্দ নিয়েও এ ধরনের বহু কাহিনী তৈরি করেছে ইসাবেলের মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো। এসব খাত থেকে অ্যাঙ্গোলার জনগণের সম্পদ শোষণ করে দুর্নীতির মাধ্যমে বিশাল বিত্ত-বৈভবের মালিক বনে গেছেন দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্টের এই কন্যা।

তার বিরুদ্ধে ওঠা এসব অভিযোগ অস্বীকার করে এগুলোকে পুরোপুরি মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে দাবি করেছেন ইসাবেল। তিনি বর্তমান অ্যাঙ্গোলা সরকারের ‘উইচ হান্টের’ শিকার বলে দাবি করেছেন।

দুর্নীতির অভিযোগ অ্যাঙ্গোলার বর্তমান কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি তদন্ত শুরু করেছে এবং দেশটিতে থাকা তার সব সম্পদ জব্দ করেছে। 

বর্তমানে ইসাবেল স্থায়ীভাবে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন। সেন্ট্রাল লন্ডনে অনেকগুলো ব্যয়বহুল সম্পত্তির মালিক তিনি। এখন ইসাবেল ও তার স্বামীকে প্রায়ই চলচ্চিত্রের জমকালো প্রিমিয়ার শোগুলোতে ও তারকা ঠাসা উৎসবগুলোতে উপস্থিত থাকতে দেখা যায়।