অভিশংসিত প্রেসিডেন্ট কি জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারেন?

প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে অভিশংসিত হওয়া তৃতীয় প্রেসিডেন্ট, অপর একজন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন অভিশংসিত হওয়ার আগেই পদত্যাগ করেছিলেন।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Dec 2019, 10:32 AM
Updated : 19 Dec 2019, 03:42 PM

কিন্তু অন্যদের কাউকেই অভিশংসনের মাধ্যমে হোয়াইট হাউস থেকে সরানো যায়নি।

অভিশংসনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার পরও ক্ষমতায় থেকে যাওয়া ওই প্রেসিডেন্টদের জনপ্রিয়তা ‍ও তাদের রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ভবিষ্যৎ কী দাঁড়িয়েছিল, তা বিবিসি’র প্রতিবেদন অবলম্বনে তুলে ধরা হল।

এন্ড্রু জনসন

এন্ড্রু জনসন অভিশংসনের মুখোমুখি হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট।

যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধের শেষ দিকে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন নিহত হওয়ার পর ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে থাকা এন্ডু জনসন প্রেসিডেন্ট হন। গৃহযুদ্ধে পরাজিত যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণের রাজ্যগুলোর পুনর্গঠন নিয়ে ডেমোক্র্যাট এই প্রেসিডেন্টের সঙ্গে রিপাবলিকান-নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেসের ঠোকাঠুকি লেগেই ছিল।

ওই সময়ের ‘র‌্যাডিকাল রিপাবলিকানরা’ যুদ্ধে পরাজিত সাবেক কনফেডারেট নেতাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য আইন করতে ও মুক্ত দাসদের অধিকারের সুরক্ষা দিতে আইন করার জন্য চাপ দিয়ে আসছিল। কিন্তু তাদের প্রত্যেকটি উদ্যোগ বন্ধ করার জন্য প্রেসিডেন্টের ভিটো ক্ষমতা ব্যবহার করছিলেন জনসন।

সিনেটের অনুমোদন ছাড়া প্রেসিডেন্টকে মন্ত্রিসভার কোনো সদস্যকে বরখাস্ত করার ক্ষমতায় রাশ টানতে কংগ্রেসে একটি আইন পাশ করে। এই আইনকে অবজ্ঞা করে কংগ্রেসের ছুটি চলাকালীন জনসন তার মন্ত্রিসভার সদস্য ও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী এডউইন স্টান্টেনকে বহিষ্কার করেন। এর প্রতিক্রিয়ায় নিজের দপ্তরে অবস্থান নিয়ে স্টান্টেন পদ ছাড়তে অস্বীকার করেন।

স্টান্টেনের ঘটনায় মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ জনসনের বিরুদ্ধে অভিশংসনের প্রস্তাব আনে। রিপাবলিকানদের ভোটে প্রস্তাব পাস হওয়ার পর অভিযোগগুলো সিনেটে তোলা হয়। সিনেটে প্রেসিডেন্টকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের প্রয়োজন হলেও মাত্র এক ভোট কম থাকায় প্রস্তাব খারিজ হয়ে যায়।

প্রেসিডেন্ট মেয়াদের বাকি সময় পার করতে পারলেও স্বস্তি পাননি জনসন। পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও পরাজিত হয় তার দল।

রিচার্ড নিক্সন  

১৯৭২ সালে ওয়াশিংটন ডিসিতে ওয়াটারগেট অফিস কমপ্লেক্সে ডেমোক্র্যাট পার্টির সদরদপ্তরে পাঁচ ব্যক্তির অনুপ্রবেশের ঘটনা এবং এ অপরাধের সঙ্গে নিজের জড়িত থাকার বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের প্রশাসন। কিন্তু তদন্তে প্রকাশ পায়, নিক্সনের পুনর্নির্বাচনী শিবির থেকে ওই অনুপ্রবেশকারীদের অর্থ দেওয়া হয়েছিল।

ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি নামে পরিচিতি পাওয়া এ ঘটনায় হোয়াইট হাউসের শীর্ষ কর্মকর্তারাও জড়িয়ে পড়েন। প্রায় দুই বছর ধরে এ ষড়যন্ত্রে নিজের ভূমিকা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে নিজের রাজনৈতিক পতন ডেকে আনেন নিক্সন।

১৯৭৪ সালে প্রতিনিধি পরিষদের বিচার বিভাগীয় কমিটি নিক্সনের বিরুদ্ধে অভিশংসনের অভিযোগ প্রস্তুত করে। কিন্তু হাউসে ভোট হওয়ার আগেই ৮ অগাস্ট নিক্সন পদত্যাগ করেন।

ছয় সপ্তাহ পর জেরাল্ড ফোর্ড প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার পর দায়িত্বে থাকার সময় নিক্সন যেসব অপরাধ করেছিলেন সবগুলো ক্ষমা করে দেন। দুই বছর পর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট জিমি কার্টারের কাছে পরাজিত হন ফোর্ড।

মর্যাদা হারিয়ে পদত্যাগ করার ২০ বছর পর ১৯৯৪ সালের এপ্রিলে মারা যান নিক্সন। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন বিল ক্লিনটন। 

বিল ক্লিনটন

প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার এক বছরের মাথায় বিচার বিভাগের বিশেষ প্রসিকিউটরের অনুসন্ধানের মুখে পড়তে হয় ক্লিনটনকে।

গত শতকের নব্বইয়ের দশকে রিয়েল এসটেট ব্যবসায় (যা হোয়াইট ওয়াটার কেলেংকারি হিসেবে পরিচিত) প্রেসিডেন্টের বিনিয়োগের অনুসন্ধান চলছিল স্পেশাল কাউন্সেল কেনেথ স্টারের নেতৃত্বে। ১৯৯৮ সালের জানুয়ারিতে হোয়াইট হাউসের তৎকালীন শিক্ষানবীশ মনিকা লিউইনস্কির সঙ্গে ক্লিনটনের সম্পর্কের বিষয়টিও পরে সেই অনুসন্ধানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

পলা জোনসের তোলা যৌন হেনস্থার অভিযোগের তদন্তের সময় ওই বছরের ১৭ জানুয়ারি ক্লিনটনের কাছে মনিকার সঙ্গে তার সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল। সে সময় প্রেসিডেন্ট দাবি করেছিলেন, হোয়াইট হাউসের ওই সাবেক কর্মীর সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।

পরবর্তীতে মনিকা লিউইনস্কি বিশেষ সেই তদন্তে অংশ নিতে সম্মত হন। কয়েকদিন পর প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন আবারও তার বিরুদ্ধে ওঠা কেলেংকারির অভিযোগ অস্বীকার করেন।

হোয়াইট হাউসে গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে উপস্থিত হয়ে তিনি বলেন, “আমি চাই আপনারা আমার কথা শুনুন। আমার সাথে ওই নারী, মনিকা লিউইনস্কির কোনো যৌন সম্পর্ক হয়নি। আমি কখনো কারও সাথে, কোনো মিথ্যা কথা বলিনি।”

১৯৯৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর কেনেথ স্টারের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ৪৪৫ পৃষ্ঠার সেই প্রতিবেদনে প্রেসিডেন্টকে অভিসংশন করার মতো ১১টি সম্ভাব্য ক্ষেত্রও চিহ্নিত করা হয়।

এরই ধারাবাহিকতায় ‘মিথ্যা বলা এবং কংগ্রেসের কাজে বাধার অভিযোগে’ প্রেসিডেন্টকে অভিশংসন করতে ওই বছরের ডিসেম্বরে সিনেটের প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যরা ভোটাভুটিতে অংশ নেন। ফেব্রুয়ারিতে রিপাবলিকান-নিয়ন্ত্রিত সিনেটেও নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে সক্ষম হন ক্লিনটন।

যে বছর লিউইনস্কির সঙ্গে কেলেংকারির ঘটনা, তখন থেকেই ক্রমাগত প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবি উঠছিল। কিন্তু ১৯৯৮ সালের জানুয়ারিতে সিএনএন এর পক্ষে গ্যালাপের এক মতামত জরিপে সর্বোচ্চ ৬৭ শতাংশ জনসমর্থন পান ক্লিনটন।

প্রেসিডেন্টর যৌন কেলেংকারিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে রিপাবলিকানরা ওই বছর মধ্যবর্তী নির্বাচনে জয়লাভের যে পরিকল্পনা করেছিল, তা হোঁচট খায়। সেই নির্বাচনে সিনেটের দুই কক্ষেই ডেমোক্র্যাটদের দখলে চলে যায়। 

২০০১ সালে বিল ক্লিনটন যখন হোয়াইট হাউস ছাড়েন, তখন তার প্রতি দেশের ৫৬ শতাংশ নাগরিকের সমর্থন ছিল। পঞ্চাশ বছরে তার পূর্বসূরিদের মধ্যে যা ছিল সর্বোচ্চ। কিন্তু ওই নির্বাচনে ফ্লোরিডায় ভোটের ফল পুনর্গণনায় জর্জ ডব্লিউ বুশের কাছে আল গোর হেরে গেলে ডেমোক্র্যাটদের হাতছাড়া হয়ে যায় হোয়াইট হাউস।

মনিকা লিউইনস্কি কেলেংকারির পরই কি অভিশংসনের ঘটনা ঘটেছিল? এমন প্রশ্নের পক্ষে খুব কমই উত্তর মিলবে। কারণ পুরো মেয়াদজুড়ে ক্লিনটনের যে জনপ্রিয়তা দেখা গেছে, তাতেই এটি স্পষ্ট যে, পূর্বসূরিদের মতো খুব একটা ক্ষতির শিকার হননি বিল ক্লিনটন।