অবরুদ্ধ কাশ্মীরে একটি জন্ম, একটি মৃত্যু গাথা

মোহাম্মদ সিকান্দার ভাট যখন অবরুদ্ধ শ্রীনগরে নিজের বাড়িতে শুয়ে শেষবার প্রশ্বাস নিলেন, ঠিক তখন শফিক আহমেদ কাশ্মীরের সড়কে নিরাপত্তা চৌকির কড়াকড়ি পার হয়ে তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে ৫৩ মাইল দূরের কোনো এক হাসপাতালে পৌঁছানোর চেষ্টায় ছুটোছুটি করছিলেন উদভ্রান্তের মত।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 August 2019, 07:15 PM
Updated : 16 August 2019, 07:15 PM

ভারতের সংবিধানের ৩৭০ ধারা মুছে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জম্মু-কাশ্মীরকে ভাগ করে আলাদা দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার সিদ্ধান্ত দেওয়ার সময় থেকেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন কাশ্মীর।

ভূস্বর্গ হিসেবে পরিচিত এই উপত্যকায় এই কড়াকড়ির মধ্যেই একজন বাবাকে তিন মেয়েকে শেষবারের মত দেখার ইচ্ছাটি অতৃপ্ত রেখে চিরবিদায় নিতে হয়েছে।

এই জীবনযুদ্ধে অন্যজন টিকে গেছেন, হয়েছেন সন্তানের বাবা; স্ত্রীকেও তিনি বাঁচাতে পেরেছেন।

কাশ্মীর নিয়ে ভারত সরকারের ওই আকস্মিক সিদ্ধান্তের কারণে এ উপত্যকার ৭০ লাখ মানুষকে কতটা মূল্য দিতে হচ্ছে তা ওই একটি জন্ম আর একটি মৃত্যুর গল্পেই স্পষ্ট।

৫ অগাস্ট ভারতের সংবিধান থেকে ৩৭০ ধারা রদ করার পরের পাঁচটি দিনে সশস্ত্র সেনা সদস্যদের ঘেরাওয়ের মধ্যে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে শ্রীনগর। তল্লাশি চৌকি পার হতে চাইলে জেরার মুখে পড়তে হচ্ছিল সবাইকে।

সেদিন ছিল ৭ অগাস্ট। বেলা ২টা। সত্তর বছর বয়সী ক্যান্সারের রোগী মোহাম্মদ সিকান্দার ভাট তার ছেলেকে ডেকে তিন মেয়েকে নিয়ে আসতে বললেন।

অন্য সময় গাড়ি চালিয়ে বোনদের বাসায় পৌঁছাতে ১০ মিনিটও লাগে না; কিন্তু সেদিন লেগেছিল এক ঘণ্টা।

সিকান্দার ভাটের ছেলে বলেন, “আমি ফিরে আসার আগেই বাবা মারা গেলেন।”

পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে ডাক্তার ডেকে এনে বাবাকে বাঁচানোর একটা শেষ চেষ্টা করতে পারতেন তিনি। কিন্তু সেদিন তারা কিছুই করতে পারেননি। টেলিযোগাযোগ বন্ধ থাকায় ডাক্তার ডাকারও উপায় তাদের ছিল না।

রয়টার্সের কাছে নিজের নাম বলতে চাননি বাবাকে হারানো ওই কাশ্মীরি যুবক। তার ভয়, গণমাধ্যমের সাথে কথা বলাটা প্রশাসন হয়ত ভালো চোখে দেখবে না।

ভারত সরকার বলেছে, এই কড়াকড়ি, কাশ্মীরের শতাধিক রাজনীতিকদের আটক করে রাখা- সবই করা হয়েছে যাতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়তে না পারে।

চলাফেরার ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ শিথিল করেছে ভারত সরকার। কিন্তু ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পর দ্বাদশ দিনেও মাত্র কয়েকশ পাবলিক টেলিফোন ছাড়া আর সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থবির করে রাখা হয়েছে।

যাত্রাপথের যন্ত্রণা

কাশ্মীরের দক্ষিণের শহর কোকেরনাগ। স্ত্রী আর এক মেয়েকে নিয়ে ওই শহরেই থাকেন আহমেদ। নিরাপত্তার কড়াকড়িতে ৭ অগাস্ট তারাও কার্যত বন্দি হয়ে ছিলেন।

এক হারা গড়নের হাসিখুশি আহমেদ তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে নিয়ে গিয়েছিলেন কাছের একটি হাসপাতালে।

কিন্তু আহমেদের স্ত্রীর রক্তচাপ মেপে দেখে একটু উদ্বেগই প্রকাশ করলেন ডাক্তার। তারপর আহমেদকে বললেন স্ত্রীকে ১৬ মাইল দূরের অনন্তনাগ জেলা হাসপাতালে নিয়ে যেতে।

ডাক্তারের যুক্তি ছিল, এই সবকিছু বন্ধ থাকায় কর্মীরা হাসপাতালে আসেনি। এর মধ্যে প্রসূতির অবস্থা খারাপের দিতে গেলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় তার পক্ষে করার কিছু থাকবে না।

উপায় না দেখে আহমেদ, তার স্ত্রী, কন্যা আর শ্যালিকা একটি অ্যাম্বুলেন্সে চড়ে বসেন।

অনন্তনাগ জেলা হাসপাতালে পৌঁছাতে এমনিতে ৪৫ মিনিটের বেশি লাগার কথা না। কিন্তু সেদিন আটটি তল্লাশি চৌকি পেরিয়ে যেতে দুই ঘণ্টা লেগে গিয়েছিল বলে জানান আহমেদ।

অনন্তনাগে জেলা হাসপাতালে পৌঁছানোর পর সেখানকার কর্মীরা আহমেদের স্ত্রীকে দ্রুত পরীক্ষা করে দেখলেন। কিন্তু তারাও ঝুঁকি নিতে চাইলেন না। আহমেদকে বলা হল তার স্ত্রীকে ৩৭ মাইল দূরে শ্রীনগরের প্রধান মাতৃসদনে নিয়ে যাওয়ার জন্য।  

শ্রীনগরে যাত্রাপথে আহমেদদের ১০ বার থামানো হয়েছিল। এক ঘণ্টার পথ যেতে লেগেছিল আড়াই ঘণ্টা।

এই পুরোটা সময় আহমেদের বাড়িতে পরিবারের বাকি সদস্যরা ছিলেন অন্ধকারে। যোগাযোগের উপায় না থাকায় তারা জানতেও পারছিলেন না, কোথায় আছেন আহমেদরা- কোকেরনাগ, অনন্তনাগ নাকি অন্য কোথাও।

একইভাবে সিকান্দার ভাটের মৃত্যুর খবরও বেশিদূর পৌঁছাতে পারেনি।

গত সপ্তাহে এক মেঘলা সকালে শখানেক পুরুষ আর কিশোরের একটি দল শ্রীনগরে ঝিলম নদীর তীরে সিকান্দার ভাটের কবরে গিয়েছিল তার জন্য প্রার্থনার হাত তুলতে।

ওই সময় তাদের মাথার উপর চক্কর দিচ্ছিল একটি সামরিক হেলিকপ্টার। কাছেই একটি সেতুর উপর দাঁড়িয়েছিল পুলিশের কয়েকজন।

সিকান্দার ভাটের ছেলে বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে বন্ধু-আত্মীয়সহ হাজারও মানুষ সেদিন জড়ো হতেন সেখানে। কিন্তু তিনি বাবার মৃত্যু সংবাদটিও তাদের দিতে পরেননি।

কাশ্মীরে এখন মুখে মুখে খবর পৌঁছে দেওয়া ছাড়া যোগাযোগের একটি উপায় হল পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া।

যে কটা পত্রিকা এখনো সেখানে প্রকাশিত হচ্ছে, সেগুলোতে বিয়ের দাওয়াত বাতিল করার খবরও বিজ্ঞাপন আকারে ছাপতে দেখা গেছে।

সিকান্দার ভাটের জামাতা বলেন, যাই ঘটুক না কেন, পরিবারের একেবারে কাছের মানুষকেও খবর দেওয়ার কোনো উপায় ছিল না।

এমনকি মাত্র দশ মাইল দূরে সিকান্দার ভাটের মেয়ের পক্ষেও সেদিন বাবার অবস্থা জানার সুযোগ ছিল না।