‘ঘরে’ ফিরতে চায় আইএস যোদ্ধাপত্নী ব্রিটিশ-বাংলাদেশি

সিরিয়ায় আইএস উৎখাতে আশ্রয় হারিয়ে শরণার্থী শিবিরে ঠাঁই হওয়া এক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ তরুণী এখন লন্ডনে ফিরে যেতে চান।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Feb 2019, 01:12 PM
Updated : 7 Feb 2020, 02:31 PM

ব্রিটিশ দৈনিক টাইমসের সাংবাদিক অ্যান্থনি লয়েডকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শামিমা বেগম নামে ১৯ বছরের ওই তরুণী বলেছেন, আইএসে যোগ দিতে সিরিয়ার আসার জন্য অনুতাপ নেই তার। তবে অনাগত সন্তানের জন্য লন্ডনের বেথনাল অ্যান্ড গ্রিন এলাকায় পরিবারের কাছে ফিরতে চান তিনি।

২০১৫ সালের শুরুর দিকে বেথনাল গ্রিন একাডেমির নবম শ্রেণির ছাত্র শামিমা ও তার সহপাঠী আরেক ব্রিটিশ-বাংলাদেশি খাদিজা সুলতানাসহ তিন তরুণী আইএসে যোগ দিতে সিরিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিলেন।

আইএস জঙ্গিদের ওপর বোমা হামলায় খাদিজা নিহত হয়েছেন বলে শামিমা জানিয়েছেন। তবে আমিরা আব্বাসি নামের তাদের অপর সহযাত্রীর ভাগ্যে কী ঘটেছে তা জানা যায়নি।

সিরিয়ায় আইএস ঘাঁটিতে গিয়ে ধর্মান্তরিত এক ডাচকে বিয়ে করা শামিমা এখন নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এর আগেও তার দুটি সন্তান হলেও তারা মারা গেছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

সিরিয়ায় শরণার্থী শিবিরে বসে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শামিমা বলেছেন, ‘শিরশ্ছেদ করা মুন্ডু’ ময়লার ঝুঁড়িতে দেখেছেন তিনি। তবে তাতে ‘খুব একটা খারাপ লাগেনি’ তার।

‘স্বাভাবিকই ছিল সব কিছু’

২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন যুক্তরাজ্য ছাড়েন তখন শামিমা ও আমিরার বয়স ছিল ১৫ বছর, আর খাদিজা ছিলেন তাদের এক বছরের বড়।

বাসায় ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে গ্যাটউইক বিমানবন্দর থেকে তুরস্কের ইস্তানবুলে আসেন তারা। সেখান থেকে সীমান্ত পেরিয়ে চলে যান সিরিয়ায়।

আইএসের ‘খেলাফতের’ কথিত রাজধানী রাকায় পৌঁছে এই জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্যদের বিয়ে করতে নতুন আসা মেয়েদের সঙ্গে একটি বাড়িতে ছিলেন শামিমা।

“আমি ২০ থেকে ২৫ বছরের একজন ইংরেজি ভাষী যোদ্ধাকে বিয়ে করার আবেদন জানিয়েছিলাম।”

১০ দিন পর ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম গ্রহণকারী ২৭ বছরের এক ডাচ যুবকের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। এরপর থেকে তার সঙ্গেই ছিলেন শামিমা। সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলে আইএসের সর্বশেষ দখলে থাকা শহর বাঘুজ থেকে দুই সপ্তাহ আগে পালান এই দম্পতি।

পরে আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইরত সিরীয় যোদ্ধাদের একটি গ্রুপের কাছে আত্মসমর্পণ করেন শামিমার স্বামী। আর তার আশ্রয় হয়েছে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের এই ক্যাম্পে, যেখানে আশ্রয় নিয়েছেন ৩৯ হাজার মানুষ।

আইএসের সবচেয়ে শক্ত ঘাঁটি রাকায় বসবাসের সময় তার মনোবল বেড়েছিল কি না, তা জানতে চেয়েছিলেন সাংবাদিক অ্যান্থোনি লয়েড।

জবাবে শামিমা বলেন, “হ্যাঁ, তাই হয়েছিল। স্বাভাবিক জীবনের মতোই ছিল সবকিছু।

“যখন তখন বোমার শব্দ। কিন্তু এই ছাড়া…”

তিনি বলেন, ময়লার পাত্রে প্রথম কাটা মুণ্ডু দেখে ‘মোটেও বিচলিত হননি তিনি।

“সেটা ছিল যুদ্ধের ময়দানে ধরা পড়া একজনের, একজন ইসলামের শত্রুর। সুযোগ পেলে একজন মুসলিম নারীকে সে কী করত, আমি শুধু তাই ভেবেছিলাম।”

এখন অনেক পরিণত হয়েছেন দাবি করে এই তরুণী বলেন, “চার বছর আগে যে ১৫ বছরের বোকা ছোট স্কুলবালিকা বেথনাল গ্রিন থেকে পালিয়ে এসেছিল, আমি আর এখন তেমনটি নই।

“এখানে আসার জন্য আমার কোনো অনুতাপ নেই।”

তবে আইএসের খেলাফত এখন শেষের পথে বলে মনে করছেন শামিমা।

“আমার আর বড় কোনো আশা নেই। তারা শুধু ছোট থেকে ছোটই হচ্ছে।

“এত বেশি দমন-পীড়ন ও  ‍দুর্নীতি চলছে যে আমি মনে করি না, তারা জয়ী হতে পারে।”

তার স্বামীকে যেখানে রাখা হয়েছে বলে শামিমা জানিয়েছেন, সেখানে বন্দীদের ওপর অত্যাচার করা হয়।

খাদিজা সুলতানার পরিবারের একজন আইনজীবী ২০১৬ সালে জানিয়েছিলেন, রুশ বিমান হামলায় তার মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

শামিমা টাইমসকে বলেন, তার ওই বন্ধু একটি বাড়িতে বোমা হামলায় নিহত হয়েছিলেন, যেখানে মাটির নিচে ‘গোপন কোনো কার্যক্রম চলত’।

“আমি কখনও ভাবিনি এমনটা ঘটতে পারে। প্রথমে আমি বিশ্বাস করি নাই। কারণ সব সময় ভাবতাম, যদি মারা যাই তাহলে একসঙ্গে মরব।”

দুই সন্তানের মৃত্যু তার জন্য খুব কষ্টের বলে জানান শামিমা বেগম।

প্রথম সন্তান মেয়ে মারা গেছে এক বছর নয় মাস বয়সে, এক মাস আগেই বাঘুজে তাকে কবর দেওয়া হয়েছে।

দ্বিতীয় সন্তান মারা গেছে তিন মাস আগে। অপুষ্টিজনিত অসুস্থতায় আটমাসের ওই শিশুর মৃত্যু হয় বলে টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

শামিমা জানান, তিনি সন্তানকে একটি হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন।

“সেখানে কোনো ওষুধ ছিল না। ছিল না পর্যাপ্ত চিকিৎসক-নার্সও।”

 

সে কারণেই অনাগত সন্তানকে নিয়ে বেশি ভাবছেন শামিমা। এই চিন্তাও তাদের বাঘুজ ছাড়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা রেখেছে বলে জানান তিনি।

“আমি খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থানের ক্ষেত্রে যে কষ্ট-দুর্দশা হয়, তা আমি নিতে পারছিলাম না।

“আমার এই ভয়ও হচ্ছিল যে, আমি যদি এখানে থাকি তাহলে আমার যে সন্তান হতে চলেছে সে অন্য দুজনের মতো মারা যাবে।”

এই শরণার্থী শিবিরেও তার শিশু অসুস্থ হয়ে পড়বে বলে শঙ্কিত তিনি।

“এই জন্যই আমি ব্রিটেনে ফিরে যেতে চাই। কারণ আমি জানি তাতে তার যত্ন হবে, অন্তত স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রে।”

“ঘরে ফিরে আমার সন্তানকে নিয়ে শান্তভাবে বেঁচে থাকতে যা করতে হয়, আমি তা-ই করব।”

বিবিসি লিখেছে, শামিমার আবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে আইনগত কারণে সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস।

তবে তিনি বলেছেন, যে ব্রিটিশ নাগরিকই আইএসে যোগ দিতে বা তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সহযোগিতার জন্য সিরিয়ায় গেছেন, তারা যুক্তরাজ্যে ফিরলে জিজ্ঞাসাবাদ, তদন্ত ও সম্ভাব্য বিচারের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে হবে।

তিনি বলেন, সিরিয়ায় তাদের কোনো কনস্যুলার সেবা নেই। তাই কোনো ব্রিটন সহায়তা চাইলে তাকে ওই অঞ্চলের যেসব জায়গায় কনস্যুলার সেবা আছে, সেগুলোর কোনোটিতে যেতে হবে।

শামিমার মতো লোকদের ফিরিয়ে আনতে সরকার তড়িত কোনো পদক্ষেপ নেবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সন্ত্রাসী বা সাবেক সন্ত্রাসীদের খুঁজে বের করতে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পাঠিয়ে আমি ব্রিটিশ জনগণের জীবন ঝুঁকিতে ফেলতে পারি না।”