মিটু’র ধাক্কা: নারী বর্জনের পথে ওয়াল স্ট্রিট

নারী সহকর্মীর সঙ্গে ডিনারে যাওয়া বন্ধ। বিমান ভ্রমণে পাশাপাশি সিটে বসা চলবে না। ব্যবসায়িক সফরে হোটেলে উঠতে হলে ভিন্ন তলায় রুম নাও। এড়িয়ে চলো নারীদের সঙ্গে একাকী সাক্ষাৎ।

হাসান বিপুলবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Dec 2018, 12:25 PM
Updated : 8 Dec 2018, 01:47 PM

মিটু’র জামানায় ওয়াল স্ট্রিটজুড়েই পুরুষরা নারীদের এড়াতে বিভিন্ন পন্থা বেছে নিচ্ছেন, আর এর ফলে জীবন আরও কঠিন হয়ে উঠছে নারীদের জন্য। সম্প্রতি এমন চিত্র ফুটে উঠেছে সংবাদসংস্থা ব্লুমবার্গ পরিচালিত এক জরিপে।

সম্পদ ব্যবস্থাপনাবিষয়ক এক পরামর্শক বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যা করে বলেন, “আদতে, নারীদের চাকরিতে নেওয়া এখন একটা অজানা ঝুঁকি হিসেবে হাজির হয়েছে। এমন যদি হয় যে, আপনি একরকম ভেবে একটি কথা বললেন আর তিনি সেটার ভিন্ন অর্থ ধরে নিলেন?”

ওই জরিপের ফলাফল নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে একে ‘পেন্সের প্রভাব’ বলেও আখ্যা দেওয়া হয়েছে । মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্স মাইক পেন্স সম্প্রতি বলেছেন, তিনি এখন কেবল নিজের স্ত্রীর সঙ্গেই একাকী খাবার টেবিলে বসেন, অন্য কারও সঙ্গে নয়।

এই দৃষ্টিভঙ্গির চূড়ান্ত ফল গোটা সিস্টেম থেকে নারীদের বিচ্ছিন্নকরণে দাঁড়াতে পারে, এমন আশঙ্কাও করা হচ্ছে।

এই প্রতিবেদনের জন্য ব্লুমবার্গ ওয়াল স্ট্রিটের অন্তত ৩০ জন জ্যেষ্ঠ নির্বাহীর সাক্ষাৎকার নিয়েছে। এদের অনেকেই মিটু’র বাস্তবতায় ভীত, চেষ্টা করছেন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার।

মর্গান স্ট্যানলি'র সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডেভিড বানসেন এখন কাজ করছেন ফ্রিল্যান্স উপদেষ্টা হিসেবে। তার হাতে এখন প্রায় দেড়শ’ কোটি ডলার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব রয়েছে।

“পরিস্থিতি এখন অনেকটা ডিমের খোসার ওপর দিয়ে সাবধানে হাঁটার মতো,” বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। 

এটা কেবল যে ওয়াল স্ট্রিটের বাস্তবতা, এমন নয়। গোটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই পুরুষরা এখন কর্মক্ষেত্রে নিজেদের আচরণের প্রতি খেয়াল রাখছেন, বিশেষ করে যারা উচ্চপদে আছেন; আর এটা তারা করছেন নতুন বাস্তবতার চাপে।

তাদের ভাষায়, ‘আচরণে বিশুদ্ধতার’ নামে তাদের ওপর ‘অযৌক্তিক পরিস্থিতি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে’ অথবা তার এসব করছেন ‘স্রেফ সঠিক কাজটি করার জন্য’।

ওয়াল স্ট্রিটে, যেখানে উচ্চপদে নারীর সংখ্যা হাতে গোনা, এ হাওয়া যথেষ্টই জোরদার; আর এখানে হয়রানির অভিযোগগুলো সাধারণত বাইরে প্রকাশ পায় না। এর ওপর এসব অভিযোগ আদালতের বাইরে ফয়সালা করার পুরোনো রেওয়াজও বর্তমান রয়েছে। এর ফলে ওয়াল স্ট্রিট থেকে হার্ভি ওয়াইনস্টিনের মতো মেগা স্ক্যান্ডাল বেরোয়নি। 

বিশাল ক্ষতি

এখন, মিটু আন্দোলনের এক বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। এরই মধ্যে হলিউড, সিলিকন ভ্যালি আর অন্যান্য জায়গায় হয়রানির বোমাফাটানো সব ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে, ছিটকে গেছেন অনেক রথীমহারথীরা। এ সময়েই এক-দুইজনকে ঝেড়ে না ফেলে বরং আরও পুরুষমুখী হওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছে ওয়াল স্ট্রিট।

ওয়েলস ফার্গো এন্ড কোংয়ের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ফাইন্যান্সিয়াল উইমেন্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যারেন এলিনস্কি বলেন, “এই পরিস্থিতি মোকাবেলা নিয়ে নারীরা উদ্বিগ্ন। কারণ, এই ধাক্কা এসে লাগছে আমাদের ক্যারিয়ারে।” তার ভাষায়, “এই ক্ষতি বিশাল।”

ফোর্ডহ্যারিসনের কর্মসংস্থান অ্যাটর্নি স্টিফেন জুইগ বলেন “এতে বিপদও রয়েছে। বিশেষ করে সেই সব প্রতিষ্ঠানের জন্য যারা এই পরিস্থিতি সামলাতে, প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্তাদের এই বিষয়ে উদার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে এবং সর্বোপরি সবার জন্য এ বিষয়ে খোলামেলা আলোচনার নিরাপদ পরিবেশ তৈরিতে ব্যর্থ হবে।”

স্টিফেন জুইগ বলেন, “পরিস্থিতি যদি এমন হয় যে- পুরুষরা নারী সহকর্মীদের সঙ্গে পেশাগত কাজে ভ্রমণ বন্ধ করে দিলেন বা কখনও যৌন হয়রানির অভিযোগ আসতে পারে এই ভয়ে তাদের পেশাগত বুদ্ধি-পরামর্শ দেওয়া বা মেন্টরশিপ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিলেন, সেটি তখন আসলে যৌন হয়রানির অভিযোগের বদলে তাদের লৈঙ্গিক বৈষম্যের অভিযোগে অভিযুক্ত করবে।”

পেন্সের দেখানো পথ

যদিও মিটু’র জামানায় আচরণের জন্য নতুন ব্যক্তিগত রেওয়াজগুলো গৃহীত হচ্ছে যেগুলো একেবারেই আনকোরা, তার ফল ইতোমধ্যেই ফলতে শুরু করেছে; অন্তত এমনই ধারণা দিয়েছেন সাক্ষাৎদাতারা। তাদের কর্মক্ষেত্রের মধ্যে রয়েছে ব্যাংক, ঝুঁকি নিয়ে বিনিয়োগ করে এমন আর্থিক প্রতিষ্ঠান, আইনী প্রতিষ্ঠান, প্রাইভেট ইকুইটি সংস্থা এবং বিনিয়োগ-ব্যবস্থাপনা সংস্থা, আর এরা সবাই কথা বলেছেন পরিচয় গোপন রাখার শর্তে। 

সঙ্গত কারণেই অল্প সংখ্যক ব্যক্তিই এই বিষয়ে খোলাখুলি কথা বলেছেন। সেই খোলাখুলি আলাপও তারা করেছেন গোপনীয়তা বজায় রেখে আর তাদের মোদ্দা কথা হলো, তারা আসলে মাইক পেন্সের দেখানো পথে হাঁটছেন। তারা বর্ণনা করেছেন, নারী সহকর্মীদের সঙ্গে একাকী আলাপচারিতায় তাদের কেমন অস্বস্তি বোধ হয়, বিশেষ করে সেই নারীটি যদি হন তরুণী এবং আকর্ষণীয়া। এটা অনেকটা নিজের ওপর ‘অজানা কোনো দায় চাপিয়ে দেওয়ার অনুভূতি’।

অবকাঠামোতে বিনিয়োগ নিয়ে কাজ করেন এমন একজন ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, তিনি এখন আর কোনো বদ্ধ ঘরে কোনো নারী সহকর্মীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন না। লিফটে ওঠার সময়ও তিনি সতর্ক থাকেন যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়ে।

প্রাইভেট ইকুইটি নিয়ে কাজ করেন এমন এক নির্বাহী জানিয়েছেন, তিনি নারী সহকর্মী বিষয়ে তার স্ত্রীর দেওয়া পরামর্শ মেনে চলেন। তার আইনজীবী স্ত্রী সোজা বলে দিয়েছেন, ‘অনূর্ধ্ব ৩৫ বছরের কোনো নারীর সঙ্গে নৈশভোজ বা ডিনার নয়’।

এই পরিবর্তনগুলো সাদাচোখে খুব একটা বোঝা যাবে না, কিন্তু এগুলো যথেষ্ট প্রভাব রাখছে। একজন নারী উদাহরণ দিয়ে বললেন, তিনি এখন অফিসের পরে সহকর্মীদের সঙ্গে সন্ধ্যার আড্ডা থেকে বাদ পরে যাচ্ছেন যেখানে পুরুষ সহকর্মীরা ওই সব আড্ডায় ঝালাই করে নিতে পারেন বন্ধুত্ব বা পেশাদারী সম্পর্ক। অবার কোনো সিনিয়র সহকর্মীর সঙ্গে যেখানে কোনো গোপন পরামর্শ করা দরকার সেখানে করতে হচ্ছে দরজা খোলা রেখে।

সামাধান কঠিন নয়

ওয়াল স্ট্রিট বা অন্য কোনো পেশায় মিটুর ফলাফল ভীতি তৈরি করতে পারে, বিশেষ করে যেখানে মেলা অর্থের লেনদেন হয়।

আইনজীবী স্টিফেন জুইগ বলেন, “অনেকপুরুষই ভিত্তিহীন বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগের ভয় পাচ্ছেন।”

তার ভাষায়, “মানুষ যা কিছু নিয়ন্ত্রন করতে পারে না, তাকেই ভয় পায়।”

অবশ্য এমন অনেক পুরুষ আছেন যারা সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছেন। একজন বললেন, তিনি একবার নারী সহকর্মীর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎ এড়ানোর চিন্তা করেছিলেন, আর একবার ভেবেছেন দরোজা খোলা রেখে মিটিংটা সেরে নেবেন, আবার ভেবেছেন ওই মিটিংয়ে তৃতীয় কাউকে হাজির রাখবেন; শেষ পর্যন্ত অবশ্য তিনি নিজেই সমাধান বের করেছেন, আর তা হল, “কোনো বেকুবি না করলেই হলো।”

কনটেক্সট ক্যাপিটাল পার্টনার্সের প্রধান নির্বাহী রন বিসকার্ডি একই কথা জানিয়ে বলেছেন, “এটা আসলে খুব কঠিন কিছু নয়।”