হিরো থেকে জিরো সু চি

এক সময় হিরোর মত মিয়ানমারের গণতন্ত্রের প্রতীক হয়ে ওঠা অং সান সু চি এখন ঘরে-বাইরে তার কর্মকান্ডে জিরোতে পরিণত হচ্ছেন। হয়ে পড়ছেন সমাজচ্যুত।

>> দ্যনিউ ইয়র্ক টাইমস
Published : 30 Sept 2018, 03:38 PM
Updated : 30 Sept 2018, 06:19 PM

রোহিঙ্গা সংকটে সু চি তার ভূমিকা নিয়ে বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে সমালোচিত হওয়ার পর এখন মিয়ানমারেও হতাশার নাম হয়ে উঠছেন তিনি।

সু চি ঘুষ নিচ্ছেন এবং দেশে বিভেদ সৃষ্টি করছেন বলে অভিযোগ করেছেন মিয়ানমারের সেনাবাহিনী-পন্থি এক কলামনিস্ট এনগার মিন সোয়ে।

ফেইসবুকে এক মাসে সু চিকে নিয়ে ১০টি পোস্ট দিয়েছেন তিনি। যার একটিতে সু চির নাম উল্লেখ না করে সোয়ে লিখেছেন, “তিনি একজন ক্ষমতা-পাগল পতিতা।”

‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’ জানায়, ফেইসবুকে সু চির সমালোচনার পর পুলিশ রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মিন সোয়েকে গ্রেপ্তার করে। এ মাসে আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করে সাত বছরের কারাদণ্ডও দেয়।

সমালোচকরা বলছেন, সু চি সরকার চাইলে মামলাটি আদালত পর্যন্ত গড়াত না। কিন্তু এক সময়কার গণতন্ত্রের প্রতীক এবং নোবেলজয়ী সু চি’র নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্যই এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে সমালোচনাকে দমন করা।

মিয়ানমারে বাক স্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চার এক  আইনজীবী মাউং সাউংখা বলেন, “সরকার এভাবে দেশ পরিচালনা করতে থাকলে আমাদের দেশে কখনোই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে না এবং আমরা আবারও একনায়কতন্ত্রে ফিরে যাব।”

মিয়ানমারে সামরিক শাসনামলে সরকারের সমালোচনা করায় মাউং সাউংখাকেও ছয় মাসের কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়েছিল।

অর্ধ শতকের সেনা কর্তৃত্বের অবসান ঘটিয়ে আড়াই বছর আগে নির্বাচনের মাধ্যমে যখন সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) ক্ষমতায় আসে তখন প্রায় পুরো বিশ্ব মিয়ানমারে গণতন্ত্র ফেরা নিয়ে আশাবাদী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এখন আর সে পরিস্থিতি নেই।

এক সময় মিয়ানমারে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রায় একাই লড়াই চালিয়ে যাওয়া সু চি এখন জাতিগত নিধন চলতে দিচ্ছেন এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বড় শত্রুতে পরিণত হয়েছেন।

সু চির দল এনএলডি’র পাঁচ বছর মেয়াদের অর্ধেক সময় পেরিয়ে গেলেও সেখানে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। বরং দেশটি ফের আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে, যেমনটি ছিল সামরিক শাসনের আমলে।

সম্প্রতি ব্রাসেলসভিত্তিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) সু চির সমালোচনা করে বলেছে, একজন নোবেলজয়ীর অধীনে রাজনৈতিক পটভূমি বদলের বিশেষ আন্তর্জাতিক খবর থেকে মিয়ানমার এখন হতাশার বিপজ্জনক উপাখ্যান হয়ে উঠেছে।

“একজন নেতার খ্যাতির এত বড় এবং দ্রুত পতন খুব বিরল।”

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানের মুখে বাধ্য হয়ে রাখাইন রাজ্য থেকে সাত লাখ রোহিঙ্গার পালিয়ে বাংলাদেশে আসার ঘটনায় শুরু থেকেই ‘নিষ্ক্রিয় ভূমিকা’ রাখায় অং সান সু চির সরকারকে ব্যর্থ বলছে তারা।

রোহিঙ্গা নিধন নিয়ে প্রতিবেদন লেখার জন্য মিয়ানমারে দুই রয়টার্স সাংবাদিকের সাজার পর তাদেরকে ছেড়ে দেওয়ার জন্যও দেশটি এখন চাপের মুখে আছে।

গণতান্ত্রিক আন্দোলনকর্মী এবং সাবেক প্রাদেশিক আইনপ্রণেতা নিয়ো নিয়ো থিন বলেন, “এনএলডি সরকার ক্ষমতায় আসার আগে আন্তর্জাতিক বিশ্ব আমাদের দেশের জন্য সমবেদনা অনুভব করত, কারণ, আমরা সেনাশাসনের অধীনে ছিলাম। কিন্তু এখন বিশ্ব আমাদের দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠদের হাতে সংখ্যালঘুদের খুন হতে দেখছে।”

১৯৯০ সালে সু চির নেতৃত্বাধীন দল মিয়ানমারের জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করলেও সেনাবাহিনী তাকে ক্ষমতায় যেতে দেয়নি। শান্তিতে নোবেলজয়ী মিয়ানমারের গণতন্ত্রের নেতা ৭৩ বছর বয়সী সু চি গত দুই দশকের প্রায় পুরোটা সময় গৃহবন্দি ছিলেন।

১৫ বছর গৃহবন্দি থাকার পর বিচ্ছিন্নতা থেকে দেশে-বিদেশে হিরোর মতই সম্মান নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন তিনি। ২০১৫ সালের নির্বাচনে জিতে তার দল ক্ষমতায় আসে। এখন দেশটির পার্লামেন্ট এবং দেশ পরিচালনা তাদেরই হাতে।

সু চি’র পদবি এখন স্টেট কাউন্সিলর। পররাষ্ট্রমন্ত্রী নামও নিয়েছেন তিনি। কিন্তু এইসব ভূমিকায় তিনি অনেকটাই রক্ষণশীলতা এবং কর্তৃত্বমূলক নেতৃত্বের পরিচয় দিয়েছেন।

অথচ এই সু চিই তার বন্দিত্বের সময়গুলোতে দেশবাসীর উদ্দেশে অনুপ্রেরণামূলক বক্তৃতা দিতেন। সেকথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদনে বলা হয়, “দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে তিনি ভীষণ রকম নীরব হয়ে পড়েছেন। জাতির উদ্দেশে প্রতি মাসে বেতারে প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন ভাষণ দিতেন, সেই চর্চাও বন্ধ করে দিয়েছেন সু চি। প্রায় কোনো গণমাধ্যমেই তিনি সাক্ষাৎকার দেন না এবং খুব কমই দেশের ভেতরে ভ্রমণ করেন।”

সু চির অনেক পুরোনো সমর্থকই সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। যদিও অনেকে বলছেন, মিয়ানমারের ক্ষমতাধর সেনাবাহিনী এবং সেনা আমলে তৈরি আইনের কারণে সু চির হাতে খুব বেশি কিছু করার ক্ষমতা নেই।

নিয়ো নিয়ো থিন বলেন, “একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে এনএলডি পার্লামেন্টে যেকোনো আইন পাস বা বাতিল করার ক্ষমতা রাখে। অথচ খুব কম ক্ষেত্রেই তাদের সেই ক্ষমতা ব্যবহার করতে দেখা গেছে।”

সেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকে এমনকি সামরিক শাসনামলের নিপীড়নমূলক আইনগুলো সু চির সরকার বিলুপ্ত করেনি। সেরকম একটি আইন হচ্ছে ‘রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা আইন’ যে আইনে দুই রয়টার্স সাংবাদিকের বিচার করেছে মিয়ানমার।

সমালোচকরা বলছেন, শুধু আইনই নয় নারীদের জন্যও সু চি কোনো সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করেননি। মন্ত্রিসভায় একটি মাত্র নারী হচ্ছেন সু চি। পার্লামেন্টে তার দলের সদস্যদের ১৪ শতাংশ মাত্র নারী। নারী বিষয়ক পার্লামেন্টারি কমিটি পরিচালনা করছেন একজন পুরুষ।

নারী অধিকার বিষয়ক একটি গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা বলেছেন, “সু চি নারী-পুরুষ সমতায় বিশ্বাসী কি না আমি ঠিক জানিনা।” সু চির সমালোচকরা বলছেন, সীমিত ক্ষমতা নিয়েও সু চি গণতন্ত্র চালু করা এবং বাক স্বাধীনতা রক্ষায় অনেক কিছুই করতে পারতেন।

কিন্তু গণতন্ত্রের সংগ্রামের জন্য একসময়ের নন্দিত নেত্রী সু চি রোহিঙ্গা সঙ্কটের পর নিন্দাই কুড়াচ্ছেন বেশি। এরই মধ্যে তিনি অনেক সম্মাননা ও পুরস্কার হারিয়েছেন।

মিয়ানমারে নৃসংশতা বন্ধে সু চি তার ক্ষমতাকে কাজে লাগান নি। তার সরকারের কর্মকর্তারা বরং মিথ্যা বর্ণনা দিয়েছে, সামরিক বাহিনীর ভুল কিছু করার কথা অস্বীকার করেছে, ধ্বংসের আলামত দেখেও না দেখার ভান করেছে এবং জাতিসংঘ মিশনসহ স্বাধীন তদন্ত বাধাগ্রস্ত করেছে।

রোহিঙ্গা সঙ্কটের বিস্তৃতির জন্য মিয়ানমার সরকারের সক্রিয়তার অভাবকে চিহ্নিত করে ক্রাইসিস গ্রুপ বলছে, অদূর ভবিষ্যতে এর পরিবর্তন হওয়ার তেমন সম্ভাবনা তারা দেখছে না।

“পরিস্থিতির সমাধানে অর্থবহ পদক্ষেপ নিতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ ও চাপ গড়ে তুলতে জাতিসংঘের বিশেষ দূতসহ শক্তিশালী কূটনৈতিক উদ্যোগের প্রয়োজন পড়বে।”

আন্তর্জাতিক অপরাধের জবাবদিহিতার প্রশ্নে জাতিসংঘের সহায়তায় একটি স্বাধীন প্রক্রিয়াইসম্ভাব্য পদ্ধতি হতে পারে বলে মনে করে সংগঠনটি।