আসাম নাগরিকপঞ্জি: পিতা ভারতীয়, পুত্র নন

ভারতের আসাম রাজ্যে ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ চিহ্নিত করতে যে নাগরিকপঞ্জি প্রস্তুত করা হচ্ছে সেখানে শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হাতে না থাকায় বা কাগজপত্রে ভুল তথ্য থাকায় অনেকে নাগরিকত্ব হারাতে বসেছেন।

>>রয়টার্স
Published : 17 August 2018, 07:13 AM
Updated : 17 August 2018, 07:50 AM

এমন একজন ৩৩ বছরের রিয়াজুল ইসলাম। তার দাবি, ১৯৫১ সালের আগে থেকে তার পরিবার আসামে বসবাস করছে এমন প্রমাণপত্র জমা দেওয়ার পরও নাগরিক তালিকায় তার ও তার মায়ের জায়গা হয়নি। যদিও বাবা এবং পরিবারের বাকি সদস্যদের নাম তালিকায় আছে।

রিয়াজুল ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ভারতীয় প্রমাণ করতে তার বা তার মায়ের হাতে আরও কোনো কাগজ নেই।

আসামের ছোট্ট শহর ধুবরিতে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “যদি আমার বাবা ভারতীয় নাগরিক হয় তবে আমি কেন নই? তাদের এর চেয়ে বেশি আর কি প্রমাণ চাই?”

প্রতিবেশী বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাজ্য আসামে অনেক বাংলাদেশি অবৈধভাবে বসবাস করছে বলে দাবি ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির।

দুই বছর আগে বিজেপি আসামের ক্ষমতায় আসার পর অবৈধ বাংলাদেশিদের চিহ্নিত করে তাদের ফেরত পাঠানোর লক্ষ্যে আসাম ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেন্স (এএনআরসি) প্রস্তুতের কাজ শুরু হয়।

তালিকায় জায়গা পেতে হলে আসামের বাসিন্দাদের ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে রাজ্যে আবাস গেড়েছেন এমন প্রমাণপত্র জমা দিতে হয়েছে।

মোট তিন কোটি ২৯ লাখ আবেদনকারীর মধ্যে এ বছর জানুয়ারিতে প্রকাশিত প্রথম তালিকায় মাত্র এক কোটি ৮০ লাখ মানুষের নাম ছিল।

গত ৩০ জুলাই প্রকাশিত সংশোধিত তালিকায় দুই কোটি ৮৯ লাখ মানুষের নাম ঠাঁই হলেও বাকি প্রায় ৪০ লাখ মানুষের নাম তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। তাদের কেন বাদ দেওয়া হয়েছে সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি।

যদিও যাদের নাম নেই তারা আবারও যথাযথ প্রমাণ নিয়ে আপিল করার সুযোগ পাবেন বলে জানিয়েছে রাজ্য সরকার।

কিন্তু বাদ পড়াদের বেশিরভাগের অবস্থাই রিয়াজুল বা তার মার মত। তাদের হাতে নাগরিকত্ব প্রমাণ হতে পারে এমন বড়াতি আর কোনো কাগজপত্র নেই।

নাগরিকপঞ্জির নামে আসামের সংখ্যালঘু বাঙালি বিশেষত মুসলমানদের ‘উইচ হান্টিং’য়ের শিকার হতে হবে বলে আশঙ্কা অনেক পর্যবেক্ষকের।

খসড়া এ তালিকা ঘিরে ভারতের উত্তর পূর্ব রাজ্যটিতে সংঘাত ও সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কাও করা হচ্ছে।

সর্বশেষ তালিকা থেকে বাদ পড়া বেশিরভাগই বাংলা ভাষী মুসলমান।

আসামের অধিকাংশ মানুষ হিন্দু এবং তাদের ভাষা ‘আসামিয়া’।

তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন এমন কয়েকজনের কাগজপত্র পরীক্ষা করে রয়টার্স জানায়, তালিকা থেকে বাদ পড়া বেশিরভাগই দরিদ্র ও অশিক্ষিত।

তাদের কেউ কেউ আবেদনপত্রে নামের বানান বা বয়স ভুল লেখার কারণে বাদ পড়েছে।

দরিদ্র জনগোষ্ঠির মধ্যে জন্মসনদ গ্রহণ বা সংগ্রহ করার প্রবণতা অনেক কম। তারা স্কুলে যায় না বা বিবাহের সনদ সংগ্রহ করে না।

এমনকি নামের বানান, পদবি বা নিজের বয়স নিয়েও তারা সচেতন নন বিধায় এখন তারা নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারছেন না বলে জানান স্থানীয় আইনজীবী আমান ওয়াদুদ। তিনি নিজে এরকম শতাধিক মামলা দেখছেন।

তিনি বলেন, “বেশিরভাগ মুসলমানের পদবি নিয়ে ঝামেলা আছে। যেহেতু তারা অশিক্ষিত এবং পূর্বপুরুষের পদবি নিয়ে সচেতন নন তাই তারা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই আলি, আহমেদ আর হুসাইন পদবি ব্যবহার করে।”

তিনি রয়টার্সকে এরকম একটি ঘটনার কাগজপত্র দেখান। সেখানে দেখা যায়, তাজাব আলি (Tajab Ali) নামে এক ব্যক্তি ১৯৬৬ সাল থেকে আসামে বসবাস করছে এমন প্রমাণ হিসেবে কয়েকটি ভোটার লিস্ট জমা দিয়েছেন। কিন্তু ১৯৮৫ সালের ভোটার লিস্টে তার নাম তাজাপ আলি (Tajap Ali) লেখা আছে। সেখানে তার পিতার নামও ভুল লেখা। তার বয়স নিয়েও ভুল তথ্য আছে।

ভারতের বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দল বিজেপি আসলে আগামী বছর জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে মুসলমানদের নাগরিকত্ব বাতিল করে হিন্দু জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে।

আসামে বিজেপির মুখপাত্র বিজন মহাজন এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

তবে মোদীর মন্ত্রিসভার জ্যেষ্ঠ সদস্য অরুণ জেটলি সম্প্রতি ফেইসবুকে এক পোস্টে এনআরসি’র প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, আসামে মুসলিমদের সংখ্যা হিন্দুদের ছাড়িয়ে যাচ্ছে।