বিশ্বকে চমকে দেওয়া ইউক্রেইন ২০২৩ সালে পারবে যুদ্ধে জিততে?

যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আলোচনা ছিল ইউক্রেইন কতদিন প্রতিরোধ করতে পারবে? বছর শেষে এখন আলোচনা, যুদ্ধে জিততে কত সময় লাগবে ইউক্রেইনের?

রয়টার্স
Published : 14 Dec 2022, 05:15 PM
Updated : 14 Dec 2022, 05:15 PM

এ বছর ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া যখন ইউক্রেইনে সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করে তখন শক্তির বিচারে অনেকেই ভেবেছিল এ যুদ্ধ বড়জোর কয়েক দিন স্থায়ী হবে। কিন্তু ইউক্রেইন বিশ্বকে রীতিমত চমকে দিয়েছে, নিজেদের প্রতিরোধ সক্ষমতা দেখে হয়ত নিজেরাও খানিকটা চমকে গেছে।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রুশ সেনারা দলে দলে ইউক্রেইনে ঢুকে পড়লে লাখ লাখ মানুষ প্রাণহাতে নিয়ে পাগলের মত সীমান্তে ছুটতে থাকে। লক্ষ্য ইউক্রেইন সীমান্ত পেরিয়ে নিরাপদ কোথাও আশ্রয় নেওয়া। ‍হাজার হাজার মানুষ বোমাবর্ষণ থেকে রক্ষা পেতে বেজমেন্টে আশ্রয় নেয়। ইউক্রেইনের নগরীগুলোতে অনেক বেসামরিক মানুষ রাশিয়ার আক্রমণে বেঘোরে প্রাণ হারান।

একইসঙ্গে লাখো মানুষ দেশকে হানাদারদের হাত থেকে রক্ষার মিছিলে যোগ দেন, হাতে তুল নেন অস্ত্র। কেউ কেউ স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে হতাহতদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন, কেউ ফ্রন্ট লাইনে থাকা গ্রামগুলো থেকে পালিয়ে আসা মানুষদের বিনামূল্যে খাবার বিলিয়ে যান। একজন আরেকজনের শিশুকে বয়ে নিয়ে পরষ্পরকে সাহায্য করতে থাকেন।

ওইসব মানুষদেরই একজন ছিলেন কিইভের ন্যাশনাল অপারেতা থিয়েটারের ব্যালে নৃত্যশিল্পী ২৬ বছরের ভাদিম খুলুপিয়ানেৎস।

যুদ্ধ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে যিনি প্রতিরোধ বাহিনীতে যোগ দেন এবং নয় মাস পর পূর্ব ইউক্রেইনের একটি যুদ্ধক্ষেত্রে স্নাইপারের গুলিতে নিহত হন।

তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে থিয়েটারের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর বোহদান স্ত্রুৎনিস্কি বলেন, দারুণ প্রতিভাবান খুলুপিয়ানেৎসের অন্য ধরনের সম্মান পাওয়ার কথা ছিল।

‘‘পারফমেন্স শেষে তার জোরে হাততালি পাওয়ার এবং দর্শকদের আবার তাকে পারফমেন্স করার অনুরোধ জানিয়ে চিৎকার করার কথা ছিল।

‘‘আমার হৃদয় ভেঙে যাচ্ছে এবং এই বাচ্চাগুলোর জন্য আমার খুবই কষ্ট হচ্ছে। তারা একেবারে তরুণ প্রাণ।”

খুলুপিযানেৎসের মত দেশপ্রেমীদের কারণেই রাশিয়ার মত বৃহৎ ও অন্যতম শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে ১০ মাস ধরে প্রতিরোধ করে যাচ্ছে ইউক্রেইন। বরং এখন কোথাও কোথাও রুশ বাহিনী পিছু হটছে। তাদের যোদ্ধা, গোলাবারুদ এবং রসদে টান পড়েছে।

এই প্রতিরোধ কেন গুরুত্বপূর্ণ:

ইউক্রেইনে আক্রমণ করার পর রাশিয়া বলেছিল তারা পশ্চিমাদের সীমালঙ্ঘন থেকে নিজেদের নিরাপত্তা সুরক্ষিত রাখতে ‘বিশেষ এই সামরিক’ অভিযান পরিচালনা করছে।

আর ইউক্রেইনীয়রা বলেছে, যাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, তাদের জাতীয় পরিচয়ের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে এবং রাশিয়া অন্যায়ভাবে তাদের ভূমি কেড়ে নিয়েছে।

তারা জাতীয় এবং ব্যক্তিগতভাবে এই যুদ্ধকে তাদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই হিসেবে বিবেচনা করেছে।

যুদ্ধের প্রথম কয়েকঘণ্টার মধ্যে ইউক্রেইনের প্রতিরোধ সেনারা রাশিয়ার অভিজাত প্যারাট্রুপারদের কিইভের কাছের একটি বিমানঘাঁটি দখলের চেষ্টা প্রতিরোধ করে জানান দিয়েছিল, এত সহজে তারা দেশের মাটি ছেড়ে দেবে না।

তারপর এপ্রিলে তারা রাশিয়ার একটি ফ্ল্যাগশিপ ক্রুজ সমুদ্রে ডুবিয়ে দিয়ে পুতিনের মুখে সজোরে চপেটাঘাত করে। আর গত মাসে রুশ বাহিনী যখন খেরসন থেকে পিছু হটে নগরীটি ছেড়ে যাচ্ছিল তখন সেখানকার উচ্ছ্বসিত বাসিন্দারা তাদের যাওয়ার পথে ভিড় করে আনন্দ প্রকাশ করেছে।

অথচ, তার কয়েক সপ্তাহ আগেই পুতিন নিজে খেরসনকে রাশিয়ার সঙ্গে চিরদিনের জন্য সংযুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন।

ইউরোপে অতীতে হওয়া সব যুদ্ধে শীতকালকে বড় ভাগ্য নির্ধারক হয়ে উঠতে দেখা গেছে। ইউক্রেইন যুদ্ধ প্রথম শীতকালে প্রবেশ করেছে এবং এই মুহূর্তে রুশ বাহিনীকেই বরং আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে দেখা যাচ্ছে।

রাশিয়াকে ইউক্রেইনে তাদের দখল করা অঞ্চলের (ইউক্রেইনের মোট ভূখণ্ডের একপঞ্চমাংশ) সুরক্ষায় তাদের রিজার্ভ বাহিনীকে তলব করতে হয়েছে।

যেসব সামরিক বিশেষজ্ঞরা একসময় এই নিয়ে তর্কে মেতেছিলেন যে, ইউক্রেইন রুশ বাহিনীকে কয়েক দিনের বেশি প্রতিরোধ করতে পারবে কিনা, এখন তারাই এই আলোচনা করছেন যে, ইউক্রেইন এই যুদ্ধে জিততে পারবে কিনা।

কিইভ তো আগেই বলেছে, রাশিয়ার সর্বশেষ সেনাকে নিজেদের ভূখণ্ড থেকে তাড়াতে না পারা পর্যন্ত তারা থামবে না। এমনকি ২০১৪ সালের যুদ্ধে হাতছাড়া হওয়া ভূখণ্ডও তারা উদ্ধার করে ছাড়বে।

২০২৩ সালের জন্য এটা কতটা গুরুত্ববহ:

এই মুহূর্তে উভয় পক্ষকে নতুন কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে।

নিপ্রো নদীর ওপারের প্রশস্ত অঞ্চলসহ কিছু অঞ্চলে রুশ বাহিনীর পশ্চাদপসরণ যুদ্ধক্ষেত্রকে (ফ্রন্ট লাইন) অনেক ছোট করে এনেছে। ফলে রাশিয়া এখন তাদের দখলে থাকা অঞ্চলগুলোকে আরো বেশি সুরক্ষিত রাখতে পারছে। যা ইউক্রেইনের জন্য এখন নতুন করে রাশিয়ার দুর্বলতা খুঁজে পাওয়া কঠিন করে দিয়েছে। শরতে রাশিয়ার দুর্বল স্থ‍ানে আঘাত করেই তারা যুদ্ধের গতি বদলে দিতে সক্ষম হয়েছিল।

তবে পিছু হটে যুদ্ধের ময়দান ছোট করে রাশিয়া যতই নিজেদের শক্তি সঞ্চয় করার চেষ্টা করুক, নিষ্ঠুর শীতকাল কিন্তু ইউক্রেইনের দেশপ্রেমী প্রতিরোধ যোদ্ধাদের পক্ষই নিয়েছে। তারা তাদের নিজেদের দেশকে ওই বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করছে যাদের হাজার হাজার কিলোমিটার দূরের দেশ থেকে খাবার ও রসদ এনে সেনাদের দিতে হবে।

ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের পদাতিক বাহিনীর সাবেক কমান্ডার মার্ক হার্টলিং টুইটারে এক পোস্টে লেখেন, ‘‘ইউক্রেইন এতদিনে রুশ বাহিনীকে আক্রমণ ও পরাজিত করতে পারদর্শী হয়ে উঠেছে। এখন তাদের পরবর্তী লক্ষ্য দেশের পূর্ব‍াঞ্চলের যুদ্ধক্ষেত্রগুলোতে রাশিয়ার শক্ত প্রতিরোধ ভেঙে ফেলা এবং নিপ্রো নদীর দক্ষিণ পাড়ের দখল নেওয়া।

‘‘এবং যে কোনো সেনাবাহিনীর জন্যই এটা সবচেয়ে কঠিন কাজ হবে। তারা জিতবে, কিন্তু সেই জয় খুব দ্রুত আসবে না।”

কিইভ এখন তাদের ভূখণ্ডে একজনও রুশ সেনা থাকা অবস্থায় যুদ্ধ অবসানে কোনো ধরনের আলোচনা বা এমনকি যুদ্ধবিরতি কিছুই চাইছে না। তাদের আশঙ্কা, সাময়িক যুদ্ধবিরতিও রাশিয়াকে পুনরায় শক্তি সংগ্রহ করা এবং যেসব অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে আছে সেখানে দখল আরও পাকাপোক্ত করার সুযোগ করে দেবে।

যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের নড়বড়ে অবস্থানের কারণে রাশিয়া এখন যুদ্ধের কৌশল পাল্টেছে। তারা একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে ইউক্রেইনের বিদ্যুৎ অবকাঠামোগুলো ধ্বংস করে দিচ্ছে। ফলে ইউক্রেইনের লাখ লাখ মানুষ প্রচণ্ড শীতে অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে।

মস্কো একে যুদ্ধের কৌশল বলছে। আর ইউক্রেইন বলছে, এই কৌশলে শুধু তার দেশের বেসামরিক নাগরিকরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এতে যুদ্ধের দিক পরিবর্তন হবে না।

রাশিয়াকে উদ্দেশ্য করে গত সেপ্টেম্বরে এক ভাষণে জেলেনস্কি বলেছিলেন, ‘‘আপনাদের ‘বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ব’ আমাদের জন্য যতটা প্রাণঘাতী ও আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে; ঠাণ্ডা, ক্ষুধা, অন্ধকার ও তৃষ্ণা আমাদের জন্য ততটা আতঙ্কের নয়।

‘‘গ্যাস ছাড়া বা আপনাদের ছাড়া? আপনাদের ছাড়া বেছে নেব। আলো ছাড়া অথবা আপনাদের ছাড়া? আপনাদের ছাড়া। পানি ছাড়া বা আপনাদের ছাড়া? আপনাদের ছাড়া। খাবার ছাড়া অথবা আপনাদের ছাড়া? আপনাদের ছাড়া।”