ইমরান খান: পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মিত্র থেকে শত্রু

ইমরান খান কি সেনাবাহিনীর সঙ্গে শত্রুতা চাইছেন? নাকি তিনি চাইছেন, সেনাবাহিনী আগের মতো তার মিত্র থাকুক।

নিউজ ডেস্ক
Published : 28 May 2023, 03:05 AM
Updated : 28 May 2023, 03:05 AM

অনেক দিন ধরেই পাকিস্তান সামরিক বাহিনী দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে দেশের জন্য একজন ত্রাণকর্তা হিসেবে দেখে আসছিল। কিন্তু লেখক ও সাংবাদিক মোহাম্মদ হানিফ লিখেছেন, ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোর এক বছরের মধ্যেই তিনি চিরশত্রু হওয়ার হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। সেইসঙ্গে ইমরান খানের চরম আক্রোশ থেকে নিজেদের বাঁচাতে সর্বশক্তি কাজে লাগাচ্ছে সামরিক বাহিনী।

বিবিসিতে হানিফ লিখেছেন, ইমরান খান ও তার দল দেশব্যাপী সাঁড়াশি অভিযানের মুখোমুখি হওয়ায় পাকিস্তান স্থবির হয়ে পড়ার অবস্থা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

গোটা জাতি চরম মুদ্রাস্ফীতির মুখোমুখি। গ্রীষ্মে ইতিহাসের সবচেয়ে তীব্র গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা, ক্রমাগত বিদ্যুৎ যাচ্ছে। এই অবস্থায় ইমরান খান পরবর্তী কী করবেন, আর তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সামরিক বাহিনী কী করতে পারেন এবং এতে গোটা দেশে কী প্রভাব পড়তে পারে, তা বোঝা যাচ্ছে না।

ইমরান খানকে অপসারণ করা হয়েছে এক বছরেরও বেশি সময় আগে। কিন্তু তার সমর্থকরা বলছেন, খান ‘রেড লাইন’-এ রয়েছেন। আর তাকে গ্রেপ্তার করা হলে পাকিস্তান জ্বলবে। বেশ কয়েকবার ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর দেশটির আধাসামরিক বাহিনীর একটি দল গত ৯ মে ইমরানকে গ্রেপ্তার করে। তবে ওই গ্রেপ্তারকে বেআইনি উল্লেখ করে ইমরানকে মুক্তির নির্দেশ দেয় পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট।

ইমরানের সমর্থকদের বিক্ষোভে গোটা দেশ না জ্বললেও তারা সংঘাত ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যান।

পাকিস্তানে সম্ভবত সব থেকে নিরাপদ জায়গা হল সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর। কিন্তু ইমরানকে গ্রেপ্তারের পর তার সমর্থকরা সেখানে ঢুকে পড়ে এবং সামরিক লোগো সম্বলিত সাইনবোর্ডগুলো খুলে পায়ে পিষে ফেলে।

লাহোরে একজন সিনিয়র জেনারেলের বাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছিল। খানের সমর্থকরা তার আসবাবপত্র ও গাড়িতে আগুন দেওয়ার সময় ভিডিও করেন। জেনারেলের পোশাক পরে একজনকে চলে যেতে দেখা যায়। আরেকজন দেখা যায়, তার পোষা ময়ূর নিয়ে চলে যাচ্ছেন।

এটি বিপ্লব না হলেও বিপ্লবের সব নমুনাই ছিল। ইমরান খানকে প্রথমে সেনাবাহিনী পছন্দ করে, তারপর তারা তাকে দূরে ঠেলে দেয়; আর এখন তার সমর্থকরা প্রতিশোধ নিচ্ছেন। এটি বিপ্লবের চাইতে কম, তবে রোমান্টিক সম্পর্কের খুনসুঁটিমূলক ঝগড়ার চেয়ে বেশি কিছু। ফলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে ছিটকে পড়া পাকিস্তানের প্রত্যেক প্রধানমন্ত্রীর জন্য রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পাকিস্তানে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। তার মেয়ে দুইবারের প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো বরখাস্ত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে আত্মঘাতী বোমা হামলায় তিনি নিহত হন। সেই ঘটনার এখনও সম্পূর্ণ তদন্ত হয়নি।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ বরখাস্ত হয়েছিলেন। জেল খেটেছেন এবং নির্বাসিত হয়েছেন, এখনও নির্বাসনেই আছেন। ছোটভাই শেহবাজ শরীফের মাধ্যমে ‘প্রক্সি’ হিসেবে পাকিস্তান শাসন করছেন, কিন্তু এখনও দেশে ফিরতে পারছেন না।

ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের পর তার সমর্থকেরা যা করেছে, তার এর আগে মূলধারার কোনো রাজনৈতিক শক্তিই করেনি। গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে রাজপথে নামার পরিবর্তে তারা সেনানিবাস এলাকায় আক্রমণ করেছে। নাগরিকদের দেখিয়েছেন, পাকিস্তানি জেনারেলরা কীভাবে বাস করেন। তাদের বিশাল প্রাসাদে রয়েছে সুইমিং পুল। ভেতরে একরের পর একর জমিতে বিচরণ করে ময়ূর।

গ্রেপ্তারের আগমুহূর্তে ‍নিজের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই ইনসাফকে (পিটিআই) ‘ধ্বংস করার পাঁয়তারার’ পেছনে আর্মি চিফ অব স্টাম জেনারেল অসীম মুনীরের প্রতি ইঙ্গিত করেন ইমরান খান।

এর আগে তিনি সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল বাজওয়াকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ অ্যাখ্যা দিয়েছিলেন। যদিও তিনিই তাকে ক্ষমতায় আনতে এবং টিকিয়ে রাখতে ভূমিকা রেখেছিলেন। একটি ব্যর্থ হত্যাচেষ্টার পেছনে ইমরান ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্সের (আইসআই) এক জেনারেলকে দায়ী করেন। ইমরান ও তার সমর্থকেরা জনসমাবেশে সেই জেনারেলকে ‘ডার্টি হ্যারি’ হিসেবে বার বার অভিহিত করেছেন।

পাকিস্তানি অনেক রাজনীতিবিদ অতীতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে আপত্তি বা প্রশ্ন তুলেছেন; কিন্তু একজন সেনা কমান্ডারের বাড়িতে আগুন, সেনা সদরদপ্তরের গেইটে নারী বিক্ষোভকারীদের হট্টগোল আর সজ্জিত সেনামূর্তি ভেঙে ফেলার চিত্র দেখতে অভ্যস্ত ছিল না পাকিস্তানিরা।

পিটিআই সমর্থকদের এই পদক্ষেপে ইমরানের বিরোধিতাকারী প্রায় সব রাজনৈতিক দলের জোটের বর্তমান সরকারের পাল্টা আঘাত হানাই প্রত্যাশিত ছিল। উপরন্তু সেখানে সরকার একটি আসন্ন জাতীয় নির্বাচন থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। অনেক জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে, সেখানে ইমরানের জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের অনেক রাজনীতিবিদ এখন পিটিআইকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধের আহ্বান জানাচ্ছেন।

পাকিস্তানের একজন নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্য আলী ওয়াজির তালেবানের প্রতি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতি সহানুভূতির কথা প্রকাশ করেছিলেন। তাকে দুই বছরের জেল দেওয়া হয়েছিল এবং এখনও তাকে পার্লামেন্টে বসতে দেওয়া হয়নি।

বেলুচিস্তানের হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মী নিখোঁজ রয়েছেন। কিন্তু তাদের বিষয়ে আগ্রহ নেই পাকিস্তানের কোনো আদালত বা মূলধারার রাজনৈতিক দলের। তাহলে ডজন ডজন অভিযোগের সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও ইমরান খান কীভাবে এখনও স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন?

মোহাম্মদ হানিফ তার মূল্যায়নে বলেছেন, ইমরান সেনাবাহিনীকে মেরুকরণ করেছেন। সেনাবাহিনীর মধ্যে এমন কিছু কর্মকর্তা এবং পরিবার রয়েছে, যারা তাকে পছন্দ করেন। বিচার বিভাগ তার জামিনের মেয়াদ বাড়িয়েছে। হাজতখানায় একদিন কাটানোর পর পাকিস্তানের সর্বোচ্চ বিচারক তাকে আদালতে ডেকে বলেছিলেন, ‘আপনাকে দেখে ভালো লাগল’। ইমরানকে তিনি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে রেখেছিলেন। পরদিন আরেক বিচারক তাকে ছেড়ে দেন।

ইমরান খান পাকিস্তানের একটি বিশাল নির্বাচনী এলাকায় জয় পেয়েছেন, যে অঞ্চলগুলো এক সময় রাজনীতি আর রাজনীতিবিদদের ঘৃণা করত। ইমরান স্বচ্ছ শাসন আর ন্যায়বিচারের যে বার্তা দিয়েছেন, তা বেশ জনপ্রিয়; যদিও তার শাসনের সময় আসলে দুর্নীতি বেড়ে যায় এবং অনেক রাজনৈতিক বিরোধীদের কারাগারে রেখেছিলেন।

কিন্তু ক্ষমতা থেকে তাকে সরানোর পর তার সমর্থন আরও বেড়েছে, যাদের অনেকে নারী ও তরুণ এবং তারা এর আগে কখনও ভোট দেয়নি এবং কোনো রাজনৈতিক সমাবেশেও যোগ দেয়নি।

এসব সমর্থকদের প্রায়ই রাজনৈতিকভাবে ‘বোকাসোকা’ অভিহিত করা হয়, যারা বর্তমান সংকটকে একটি ঐতিহাসিক দৃষ্টি থেকে দেখে না এবং দাবি করে, এখন যা ঘটছে তা পাকিস্তানের ইতিহাসে কখনও ঘটেনি।

তারা নিজেদেরকে একটি সংস্কারবাদী আন্দোলনের অংশ মনে করেন, যেখানে সমস্ত দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের থেকে দেশকে তারা মুক্ত করতে চান। ইমরান খানের মতো তারাও একসময় সেনাবাহিনীকে ভালোবাসতেন। কিন্তু এখন সবকিছুর জন্য সেনাবাহিনীকেই এই সমর্থকেরা দায়ী করেন।

ইমরান খান বারবার সেনা নেতৃত্বের উপর আক্রমণ করেছেন। কিন্তু অনেকে বিশ্বাস করেন, তিনি সত্যিকার অর্থেই সেনাবাহিনীর ক্ষমতা কমাতে চান না। ইমরান চান, জেনারেলরা তাকে আর দলকে ভালোবাসুক ও সমর্থন করুক, যেমনটি আগে তারা করেছেন।

কিন্তু ইমরানের গ্রেপ্তার ঘিরে গত ৯ মে দাঙ্গার পর সেনাবাহিনীর হাইকমান্ড মনে করছে ‘যথেষ্ট হয়েছে’। বর্তমান সেনাপ্রধান এই দিনটিকে ‘পাকিস্তানের ইতিহাসে কালো দিন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইমরান খান হয়ত পাকিস্তানে একটি নতুন ধরনের ‘পপুলিস্ট’ রাজনীতির সূচনা করেছেন। সেনাবাহিনী তাকে নামানোর জন্য একই পদ্ধতি ব্যবহার করছে, যেটি ইমরানের পূর্বসূরিদের বিরুদ্ধে তারা করেছে। কিন্তু কয়েক ডজন দুর্নীতির মামলা, গণগ্রেপ্তার এবং সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করে একটি পরিষ্কার বার্তা দিয়ে ইমরান খানই একমাত্র যিনি ‘রেড লাইন’ অতিক্রম করেছেন।

৯ মে সামরিক স্থাপনায় হামলার ঘটনায় সেনাবাহিনী ‘শহীদদের’ অভিবাদন জানিয়ে একটি গান প্রকাশ করে সকলের মন জয় করার চেষ্টা করেছে। তারা ‘শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা’ দিবস উদযাপন করেছে। অথচ সমালোচকরা বলছেন, ওই দিন কোনো সেনা শহীদ হয়নি। কেবল বিক্ষুব্ধ জনতা একটি অভিজাত ভবনে ভাংচুর চালিয়েছে মাত্র।

প্রধান শহরগুলোর মূল সড়কগুলোতে পোস্টারে সেনাবাহিনীর স্তুতি গাওয়া হয়েছে এবং চির আনুগত্যের অঙ্গীকার করা হয়েছে। সেনাবাহিনী ধর্মীয় দলগুলোকেও খেলায় নিয়ে এসেছে, যারা অতীতে আক্রমণ চালিয়েছে। ওই দলগুলো গত সপ্তাহে রাস্তায় নেমে সেনাবাহিনীর প্রতি তাদের ভালবাসা ঘোষণা করেছে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীও নিজেদের মধ্যে ইমরান খানের প্রতি সহানুভূতিশীলদের খুঁজছে।

৯ মে দাঙ্গায় যোগ দিয়েছিলেন খাদিজা শাহ নামের এক নারী, যিনি ফ্যাশন ডিজাইনার থেকে রাজনৈতিক কর্মী হয়েছেন। তিনি একজন প্রাক্তন সেনাপ্রধানের নাতনি এবং ক্যান্টনমেন্টের তৃতীয় প্রজন্মের সন্তান।

কোনো ধরনের অপরাধ করার অস্বীকার করেন খাদিজা। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে, ইমরান খান কিছু সেনাপরিবারের সন্তানদের এতটাই মন্ত্রমুগ্ধ করেছেন যে, তারা নিজের বাড়িতেও আগুন দিতে চাইবে।

অন্যদিকে খাদিজাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানোর মধ্য দিয়ে সেনা পরিবারগুলোকে ইমরান খানের রাজনীতি থেকে দূরে থাকার সুস্পষ্ট সংকেত দিয়েছে সেনাবাহিনী। এছাড়া সেনাবাহিনী গণগ্রেপ্তারের মাধ্যমে ইমরানের পিটিআইকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে এবং সেনানিবাসে হামলায় জড়িত কর্মী ও নেতাদের সামরিক বিচারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বিবিসিতে লেখক-সাংবাদিক হানিফ লিখেছেন, খানের অনেক সিনিয়র নেতা তার পিটিআই দল ছাড়ার জন্য প্রবল চাপের মধ্যে রয়েছেন। কেউ কেউ চলেও গেছেন, যারা দাবি করছেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতি খানের মুখোমুখি অবস্থাকে তারা গ্রহণ করতে পারছেন না।

ঐতিহাসিকভাবে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যখন বেসামরিক লোকদের সঙ্গে মুখোমুখি হয়েছে, সেসময় তারা নিজেদের পথ খুঁজে নিয়েছে। অন্যদিকে ইমরান তার কর্মী-সমর্থকদের দাসত্বের চেয়ে মৃত্যুর পথ বেছে নিতে বলেছেন। এই যে অচলাবস্থা, সেখানে সাধারণ পাকিস্তানিরা ভুগছে আর ভুগছেই। 

  • বিবিসি অবলম্বনে