পোপ ফ্রান্সিসের প্রয়াণে নতুন পোপ কে হবেন তা নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে থাকার মধ্যে উঠে এসেছে ঘানা, কঙ্গো এবং গিনির তিন আফ্রিকান কার্ডিনালের নাম।
Published : 22 Apr 2025, 11:11 PM
পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুতে শোকার্ত গোটা বিশ্ব। এই শোকের মাঝেই ক্যাথলিক চার্চ পরবর্তী নতুন পোপ বেছে নেওয়ার গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
বিশ্বের ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের নতুন ধর্মগুরু কে হবেন, তা নিয়ে এখন জল্পনা তুঙ্গে। আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে সম্ভাবনাময় তিন আফ্রিকান কার্ডিনালের নাম।
তাদের একজন ঘানার, একজন কঙ্গোর এবং আরেকজন গিনির। এই আফ্রিকানদের কেউ পোপ নির্বাচিত হলে তিনি হতে পারেন এই আধুনিক যুগে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান পোপ।
কিছু বিশ্লেষক বলছেন, নতুন পোপ আফ্রিকা থেকেই আসা উচিত। আফ্রিকা থেকে পরবর্তী পোপ হওয়ার জোরাল সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে। কারণ, খ্রিষ্টধর্মের দ্রুত প্রসার ঘটছে আফ্রিকায়।
বিশ্বের যে কোনও জায়গার চেয়ে আফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলোতেই অনেক বেশি মানুষ ক্যাথলিক ধর্ম গ্রহণ করছে। নিপীড়ন এবং মৃত্যুর শিকার হওয়ার পরও লাখো আফ্রিকান ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাসে আস্থা রাখছে।
ফলে পোপের গুরুদায়িত্বটি একজন আফ্রিকান ধর্মযাজকের হাতেই তুলে দেওয়া উচিত বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ।
২০২৩ সালের ন্যাশনাল ক্যাথলিক রেজিস্টারের তথ্যানুযায়ী, ১৯১০ সালে আফ্রিকায় ক্যাথলিক ছিলেন ১০ লাখের কম, যা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ২৬ কোটি ৫০ লাখে।
ওদিকে, ২০২৪ সালের অক্টোবরে ভ্যাটিকান জানিয়েছিল, কেবল গত বছরেই ৭২ লাখ ৭১ হাজার আফ্রিকান ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষিত হয়েছেন।
এই প্রেক্ষাপটে এবারের নতুন পোপ হওয়ার দৌড়ে সামনের সারির তিন আফ্রিকান প্রার্থী হচ্ছেন: গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের কার্ডিনাল ফ্রিডোলিন অ্যামবোঙ্গো বেসুংগু (৬৫),
ঘানার কার্ডিনাল পিটার কোডো আপ্পিয়াহ টার্কসন (৭৬) ও গিনির কার্ডিনাল রবার্ট সারাহ (৭৯)। তবে সারাহর বয়স ৮০ হতে চলায় তার পোপ হওয়ার সম্ভাবনা কম বলে মনে করা হচ্ছে।
ফ্রিডোলিন অ্যামবোঙ্গো বেসুংগু:
পোপ হওয়ার দৌড়ে নেতৃস্থানীয় প্রার্থী কঙ্গোর প্রজাতন্ত্রের এই কার্ডিনাল। তিনি কিনসাসায় ৭ বছর ধরে আর্চবিশপ হিসাবে কাজ করছেন। তাকে কার্ডিনাল নিযুক্ত করেছিলেন খোদ পোপ ফ্রান্সিস।
সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বেসুংগু রক্ষণশীল মনোভাবের। সমকামী যুগলদের আশীর্বাদ না করার পক্ষে তিনি সরব। তার কথায়, সমকামী দুই মানুষের জোড়া সাংস্কৃতিক প্রথার বিরোধী। ফলে তা অশুভ এবং যুক্তিসঙ্গত নয়।
তবে, ২০২০ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি ধর্মীয় বহুত্ববাদের পক্ষেও কথা বলেছিলেন। তার কথায়, “প্রোট্যাসটেন্টরা প্রোট্যাসটেন্ট থাকুক আর মুসলিমরা মুসলিম। আমরা তাদের সঙ্গে কাজ করব। তবে প্রত্যেককেই তাদের নিজস্ব পরিচয় ধরে রাখতে হবে।”
পিটার টার্কসন:
পোপ হিসাবে পিটারকে বেছে নেওয়া হলে বলা যায় ঘানার এই প্রভাবশালী কার্ডিনালই ১৫০০ বছরের মধ্যে প্রথম আফ্রিকান পোপ হওয়ার ইতিহাস গড়তে পারেন। তার আছে পোপ হওয়ার মতো একইরকম স্বাতন্ত্র্য।
কার্ডিনাল বেসুংগুর মতো তিনিও বলেছিলেন যে, এই পদ তিনি চান না। ২০১৩ সালে পিটার টার্কসন বিবিসি-কে বলেছিলেন, “কেউ পোপ হওয়ার আকাঙ্কা পোষণ করে কিনা সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই।”
আফ্রিকায় চার্চের সংখ্যা বাড়ছে। এ কারণে সেখান থেকে পোপ নির্ধারণ করার ভালো সুযোগ আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে পোপ বেছে নেওয়া উচিত নয়। এ ধরনের বিচার-বিবেচনায় জলঘোলা হওয়ার প্রবণতা থাকে।”
পিটার তুর্কসনই ঘানার প্রথম নাগরিক যিনি কার্ডিনাল হয়েছেন। পোপ জন পল দ্বিতীয়র সময় ২০০৩ সালে তাকে কার্ডিনাল করা হয়েছিল। এক দশক পর পোপ হিসাবে পোপ ফ্রান্সিসকে বেছে নেওয়ার সময় পিটার তুর্কসনকে এ পদে সম্ভাবনাময় একজন প্রার্থী হিসাবেই বিবেচনা করা হয়েছিল।
আফ্রিকার অনেক কার্ডিনালের মতো তুর্কসনও রক্ষণশীল। তবে আফ্রিকান দেশগুলোতে সমকামী সম্পর্ককে অপরাধ হিসাবে গণ্য করার বিরোধিতা করেছেন তিনি।
রবার্ট সারাহ:
সারাহ একজন পরম্পরা বা ঐতিহ্য মেনে চলা অর্থোডক্স কার্ডিনাল। একসময় তিনি পোপ ফ্রান্সিসের মতো একই কাতারের কর্তৃত্ব নিয়ে নিজেকে উপস্থাপন করার চেষ্টা নিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন ভ্যাটিকানের এক পর্যবেক্ষক।
২০২০ সালে সারাহ তৎকালীন অবসরপ্রাপ্ত পোপ বেনেডিক্টের সঙ্গে মিলে ধর্মযাজকীয় ব্রহ্মচর্যর সমর্থনে একটি বই লিখেছিলেন। তার এই প্রচেষ্টাকে পোপ ফ্রান্সিসের কর্তৃত্বে চ্যালেঞ্জ হিসাবেই দেখা হয়ে থাকে।
সারাহ লিঙ্গ মতবাদকে সমাজের জন্য হুমকি বলে নিন্দা করেছেন এবং ইসলামিক মৌলবাদের বিরুদ্ধেও কথা বলেছেন। প্রয়াত পোপ ফ্রান্সিসের জায়গায় নতুন পোপ হিসাবে সারাহকে স্যোশাল মিডিয়ায় সমর্থন দিচ্ছেন রক্ষণশীল খ্রিষ্টানরা।
চার্চের মতবাদ, যৌনতার ক্ষেত্রে তার শক্ত প্রথাগত অবস্থান এবং গণ অভিবাসন ও ইসলামবাদের বিরোধিতার কারণে রক্ষণশীলরা তাকে সমর্থন দিচ্ছে।
এই তিন আফ্রিকান ছাড়াও নতুন পোপ হওয়ার সম্ভাবনার তালিকায় আরও আছেন:
পিয়েত্রো প্যারোলিন:
পোপ ফ্রান্সিসের আমলে ভ্যাটিকানের সেক্রেটারি অব স্টেট ছিলেন নম্রভাষী ইতালীয় কার্ডিনাল পিয়েত্রো প্যারোলিন। তিনি ছিলেন পোপের প্রধান পরামর্শদাতা। চার্চের কেন্দ্রীয় প্রশাসন রোমান কুরিয়ারও প্রধান তিনি।
ডেপুটি পোপ হিসাবে কাজ করা ৭০ বছর বয়সী প্যারোলিনকে পোপ হওয়ার দৌড়ে সামনের সারিতেই বিবেচনা করা যেতে পারে।
প্যারোলিন ৩০ বছর ধরে হলি সি- এর কূটনৈতিক সেবায় কাজ করেছিলেন। পাশাপাশি ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক বিষয়ক আন্ডারসেক্রেটারি অফ স্টেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি ।
সেকারণে প্যারোলিনের কূটনীতিকেই অগ্রাধিকার দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে মনে করেন কেউ কেউ। আর তার সমালোচকরা এটিকে একটি সমস্যা বলেই মনে করে। আর সমর্থকরা একেই তার শক্তি হিসাবে দেখে।
পিয়েত্রো প্যারোলিন বিশ্বব্যাপী সমকামী বিয়ের বিরোধী। ২০১৫ সালে রিপাবলিক অব আয়ারল্যান্ডে সমকামী বিয়েকে স্বীকৃতি দিতে অনুষ্ঠিত ভোটকে তিনি মানবতার পরাজয় আখ্যা দিয়েছিলেন।
লুইস অ্যান্টোনিও গোকিম টগল:
৬৭ বছর বয়সী গোকিম টগল কি প্রথম এশীয় পোপ হবেন? তিনি একজন ফিলিপিনো। প্যারোলিনের সঙ্গে টগলের তফাত হচ্ছে, যাজক হিসাবে তার কয়েক দশকের অভিজ্ঞতা আছে। মানে গণমানুষের মধ্যে সক্রিয় একজন চার্চ লিডার থেকে এসেছেন তিনি।
ফিলিপিন্সে চার্চ খুবই প্রভাবশালী। কারণ, দেশটির প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ ক্যাথলিক। ফিলিপিন্সে বর্তমানে কলেজ অব কার্ডিনালসের রেকর্ড ৫ সদস্য আছে। তারা টগলকে সমর্থন দিলে একটি গুরুত্বপূর্ণ লবিং গ্রুপ হয়ে উঠতে পারে।
লুইস অ্যান্টোনিও গোকিম টগল গর্ভপাতের বিরোধী। গর্ভপাতকে তিনি ‘এক ধরনের খুন’ আখ্যা দিয়েছেন। স্বেচ্ছামৃত্যুর বিরুদ্ধেও তিনি কথা বলে এসেছেন।
তবে ২০১৫ সালে টগল যখন ম্যানিলার আর্চবিশপ ছিলেন, তখন তিনি চার্চকে সমকামী মানুষ, তালাকপ্রাপ্ত এবং একাকী মায়েদের প্রতি কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি পুনর্বিবেচনা করে দেখার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তার কথায়, প্রতিটি মানুষকেই সহমর্মিতা এবং সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা উচিত।