ড্রোন পাল্টে দিয়েছে রুয়ান্ডার রক্ত সরবরাহ ব্যবস্থা

ছয় বছর আগেও রক্ত সরবরাহ নিয়ে ব্যপক সমস্যায় ছিল পূর্ব আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডা। তবে, এখন দেশটির রক্ত পাঠানোর পদ্ধতি পুরোপুরি বদলে গেছে। দেশটি এখন ড্রোনের সাহায্যে রোগীদের রক্ত সরবরাহের কাজ করছে।

প্রযুক্তি ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 May 2022, 01:06 PM
Updated : 3 May 2022, 01:06 PM

আফ্রিকান এই ছোট দেশে প্রায় এক কোটি ২০ লাখ মানুষ বাস করে। অন্যান্য দেশের মতোই সেখানে মাঝেমধ্যে গাড়ি দুর্ঘটনা হয়।

এ ছাড়া, নবজাতকের জন্মের পর যখন নতুন মায়েদের অনেক রক্তক্ষরণ হয়, তখনও প্রয়োজন পড়ে রক্তের। পাশাপাশি, রক্তশূন্য শিশুদের জরুরীভিত্তিতে রক্ত দিতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে রোগীর কাছে খুব দ্রুত রক্ত পাঠানো লাগে। যদিও শহরে বসবাস করলে এটি কোনো বড় সমস্যা নয়।

যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ৮০ শতাংশ জনগণই শহরের ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থায় হাসপাতাল ও ব্লাড ব্যাংকের কাছাকাছি থাকেন। এ ছাড়া, আফ্রিকার লিবিয়া, জিবুতি এবং গ্যাবনের মতো দেশের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ জনগণ বাস করেন শহরে।

রুয়ান্ডার ক্ষেত্রে সেই পরিসংখ্যান পুরোপুরি উল্টো। রুয়ান্ডাবাসীর ৮৩ শতাংশ  বাস করে গ্রামাঞ্চলে। তাই, প্রত্যন্ত হাসপাতালে রক্তের প্রয়োজন হলে সেটি আনতে হতো সড়কপথে। এটি কোনো সহজ উপায় নয়। দেশটি পাহাড়ী, হাসপাতালে যাওয়ার রাস্তাও গরম, দীর্ঘ ও অনেক এলাকায় অসমতল।

প্রযুক্তিবিষয়ক সাইট আর্স টেকনিকার প্রতিবেদন বলছে, রক্ত স্বল্প তাপমাত্রায় রাখলে বড়জোর এক মাস বা কিছু বেশি সময় সংরক্ষণ করা যায়।

তবে, প্লাটিলেটের মতো কিছু উপাদান যেগুলো স্থানান্তরের জন্য হাসপাতাল আলাদা করে রাখে, সেগুলো একদিনেই নষ্ট হয়ে যায়। ফলে, মেডিকাল সরঞ্জাম পরিবহনের ক্ষেত্রে এমন ‘দুর্গম যাত্রা’ মোটেও উপযোগী নয়।

মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে রক্ত ব্যবহার না হলে, সেগুলো ফেলে দিতে হয়। এ ছাড়া, প্রয়োজন থেকে বেশি রক্ত চাইছিল হাসপাতালগুলো। “সেখানে ‘ওভারস্টকিং’-এর সমস্যা হচ্ছিল” --বলেছেন মারি পল নিসিংজিওয়ে।

তিনি ‘ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিটিশ কলম্বিয়া (ইউবিসি)’র জনসংখ্যা এবং জনস্বাস্থ্য বিভাগের পিএইচডি প্রার্থী। এ ছাড়া, নিজ দেশ রুয়ান্ডা নিয়েও গবেষণা করছেন তিনি।

ছবি: জিপলাইন

২০১৬ সালে রক্ত সরবরাহ ব্যবস্থা চালু করতে স্যান ফ্রানসিস্কো-ভিত্তিক মার্কিন ড্রোন স্টার্টআপ ‘জিপলাইন’-এর সঙ্গে একটি চুক্তি করে রুয়ান্ডা সরকার।

কোনো বিতরণ হাব থেকে স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোয় আকাশপথে রক্ত সরবরাহ করতে পারে জিপলাইনের স্বয়ংক্রিয় ড্রোন। গন্তব্যে পৌঁছে ‘আইভি ব্যাগ’-এর মধ্যে থাকা রক্ত প্যারাশুটের সাহায্যে নামানোর পরপরই ড্রোনটি আবার ফিরে যায়।

বর্তমানে, জিপলাইনের দুটি হাব রয়েছে রুয়ান্ডায়। এদের প্রত্যেকটি দৈনিক প্রায় পাঁচশ বার পর্যন্ত রক্ত সরবরাহ করতে পারে।

এই প্রথম বারের মতো প্রমাণ হয়েছে, ড্রোনের মাধ্যমে রক্ত পাঠানোর সেবা, রক্ত সরবরাহের গতি বাড়িয়ে দেয় এবং এতে মেডিকেল সরঞ্জামের ব্যবহার বা অপচয় কমিয়ে আনা যায়।

স্বাস্থ্য সাময়িকী ‘ল্যানসেট গ্লোবাল হেলথ’-এর এপ্রিল সংখ্যার জন্য প্রবন্ধে লিখতে গিয়ে, ২০১৭ ও ২০১৯ সালের মাঝামাঝি প্রায় ১৩ হাজার ড্রোন অর্ডার বিশ্লেষণ করেছেন নিসিংজিওয়ে।

ওই বিশ্লেষণেই তিনি জানতে পারেন, অর্ডারের অর্ধেকই ড্রোনের মাধ্যমে সরবরাহ হতে ৪১ মিনিট বা তার চেয়ে কম সময় লেগেছে। এ ছাড়া, রক্ত নষ্ট হওয়ার হারও কমেছে।

আফ্রিকায় ‘মেডিকাল ডেলিভারি ড্রোন’ বিষয়ক প্রথম বিশ্লেষণ এটি। যদিও উচ্চ-আয়ের কোনো দেশে এমন ড্রোন বিষয়ক গবেষণা একেবারেই স্বাভাবিক বিষয়। কারণ সেখানে ওষুধ এবং অন্যান্য সামগ্রী স্থানান্তরে ড্রোন ব্যবহৃত হয়।

“আশ্চর্যের বিষয় যে, আসলেই আফ্রিকার ব্যবস্থায় ড্রোন ডেলিভারি সম্ভব!” --বলেছেন নিসিংজিওয়ে। তার গবেষণা দলের সঙ্গে জিপলাইনের কোনো সম্পর্ক নেই বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে আর্স টেকনিকা।

“এটি খুবই ভালো, এবং কেবল যে রুয়ান্ডার জন্য ভালো, তা নয়” --বলেছেন টিমোথি অ্যামুকেলে। তার গবেষণা দলের সঙ্গেও জিপলাইনের কোনো সম্পর্ক নেই এবং এর আগে নামিবিয়া ও উগান্ডার প্রকল্পে একটি মেডিকাল ড্রোন দল পরিচালনা করেছেন এরা।

অ্যামুকেলে ‘আইকন ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস’-এর গ্লোবাল মেডিকেল ডিরেক্টর। বিভিন্ন রোগবিষয়ক গবেষণার কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি।

বৈশ্বিক মেডিসিন খাতে ‘ড্রোন অ্যাপ্লিকেশন’-এর বিষয়টি নজরে ছিল অনেক বছর ধরেই। তবে, গবেষকদের পর্যাপ্ত ডেটার অভাবে, সেটি বাস্তবায়ন হয়নি।

২০০৯ সালে, ‘র‍্যাপিড এসএমএস’ নামে পরিচিত একটি ফোন-ভিত্তিক প্রোগ্রাম চালু করেছিল দেশটির সরকার। ওই প্রোগ্রামের সাহায্যে মা ও শিশু মৃত্যুহার ট্র্যাক করা যায়।

২০১৩ সাল নাগাদ, প্রায় ১৫ হাজার গ্রামের সঙ্গে ডাক্তার, হাসপাতাল ও অ্যাম্বুলেন্সের সংযোগ স্থাপন করেছে র‍্যাপিড এসএমএস।

দেশটি তার ৯০ শতাংশ জনগণকে সার্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে এসেছে।