তথ্য-প্রমাণ দিয়ে এ প্রশ্নের অল্প কথার উত্তর দেওয়া বেশ কঠিন কাজ। তবে, বিভিন্ন সূত্রের তথ্য বলছে, ‘সম্ভবত না’; উল্টো পুরনো ফোনগুলো নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে তরুণদের মধ্যে।
সফটওয়্যার নির্মাতা ‘সেমরাশ’ বলছে, ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে কথিত ‘ডাম্বফোন’ নিয়ে গুগলে সার্চের হার বেড়েছে ৮৯ শতাংশ। পুরনো নকশার এই ডিভাইসগুলোর বিক্রি নিয়ে তথ্য পাওয়া বেশ কঠিন। তবে, গবেষণা সংস্থা কাউন্টারপয়েন্ট বলেছিল, বিশ্বব্যাপী একশ কোটি ফিচার ফোন বিক্রি হবে ২০২১ সালে।
তুলনা বিচারে ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী বিক্রি হওয়া ফিচার ফোনের সংখ্যা ছিল ৪০ কোটি। অন্যদিকে, বিশ্বব্যাপী একশ ৪০ কোটি স্মার্টফোন বিক্রি হয়েছে ২০২১ সালে। ২০২০ সালের তুলনায় যা ছিল ১২.৫ শতাংশ কম।
এই তরুণ প্রজন্মের ‘ডাম্বফোন’ ব্যবহারকারীদের একজন রবিন ওয়েস্ট। পুরনো ডাম্বফোন ব্যবহার করেন বলে নিজের বন্ধুমহলেও ব্যতিক্রম তিনি; টিকটক বা ইনস্টাগ্রাম স্ক্রল করে পার হয় না তার দিন।
আইফোনের সঙ্গে তুলনা করলে কার্যক্ষমতা নেহাতই কম ফিচার ফোনগুলোর। ফোন কলে আলাপচারিতা আর এসএমএস পাঠানো ছাড়া বাড়তি কোনো ফিচার নেই বললেই চলে। সেই এসএমএস টাইপ করাও এক ঝক্কি! একটু ‘ভালো মানের’ হলে হয়তো তাতে মেলে রেডিও শোনার আর ছবি তোলার সুযোগ। তবে ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযোগের উপায় নেদ ডিভাইসগুলোতে।
৯০ দশকের শেষের দিকে ক্রেতারা যে ফোনগুলো কিনতেন, তেমনটাই হালের ‘বোকাফোন’ গুলো। বছর দুয়েক আগে ওয়েস্ট এমনই এক বোকাফোন কিনেছিলেন হঠাৎ করে। সেকেন্ড-হ্যান্ড ফোনের দোকানে ঘুরছিলেন তিনি, কিন্তু কম দাম দেখে স্মার্টফোনের বদলে কিনে ফেলেন একটা ‘বোকাফোন’।
বিবিসি জানিয়েছে, ওয়েস্টের ফিচার ফোনটি ফরাসী প্রতিষ্ঠান ‘মোবিওয়্যার’-এর, দাম মাত্র ৮ পাউন্ড বা কম-বেশি ১১ ডলার। আর স্মার্টফোন না হওয়ায় মাস শেষে বড় অংকের ফোন বিলও দিতে হয় না ওয়েস্টকে।
নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে ওয়েস্ট বলেন, “একটা বোকাফোন কেনার আগে আমি কখনো বুঝতেই পারিনি যে স্মার্টফোন আমার জীবনের কতোটা দখল করে রেখেছিল। আমার স্মার্টফোনে অনেকগুলো সোশাল মিডিয়া অ্যাপ ছিল। সারাদিন ফোন চালাতাম বলে নিজের অনেক কাজই করা হতো না আমার।”
সবমিলিয়ে কথিত ‘ডাম্বফোন’-এর কদর বাড়ছে বলেই জানিয়েছে বিবিসি। ২০২১ সালের এক গবেষণার সূত্র ধরে বার্তাসংস্থাটি জানিয়েছে, যুক্তরাজ্যের প্রতি দশজন ব্যবহারকারীর মধ্যে একজন ‘ডাম্বফোন’ ব্যবহার করছেন।
এ প্রসঙ্গে দাম তুলনা করার ওয়েবসাইট ‘আসউইচ ডটকমের’ মোবাইল বিশেষজ্ঞ আর্নেস্ট ডকু বলেন “ডাম্বফোনের পুনরুজ্জীবন পাওয়ার পেছনে টিকটক ভিডিওতে উপস্থিতি, হালের ফ্যাশন এবং নস্টালজিয়ার একটা ভূমিকা আছে।”
আর ফিচার ফোনের এই পুনরুত্থানের পেছনে নোকিয়ারও একটা বড় ভূমিকা আছে বলে জানিয়েছেন ডকু। নোকিয়া ৩৩১০ ফোনটির প্রথম সংস্করণ বাজারে এনেছিল ২০০০ সালে, প্রায় ২২ বছর আগে। ২০১৭ স্মার্টফোনটি নতুন করে বাজারে ছাড়ে নোকিয়া। আর তাতেই গতি পেয়েছে ‘বোকাফোন’-এর পুনরুত্থান।
“সর্বাধুনিক প্রযুক্তির স্মার্টফোনের দুনিয়াতে নোকিয়া ৩৩১০-কে সাশ্রয়ী বিকল্প হিসেবে বাজারজাত করেছিল,” যোগ করেন ডকু।
অ্যাপল বা স্যামসাংয়ের সর্বাধুনিক ডিভাইসের মতো ফিচার ফোনগুলোর প্রযুক্তি সক্ষমতা যে নেই, সে বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছেন ডকু। পারফর্মেন্স আর আধুনিকতার বিবেচনায় ফিচার ফোনগুলো পিছিয়ে থাকলেও, ডিভাইসগুলো হালের স্মার্টফোনকে “ব্যাটারি লাইফ আর দীর্ঘস্থায়ীত্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে পেছনে ফেলতে পারে” বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
ওয়েস্টের মতোই বোকাফোনের ব্যবহার শুরু করে স্মার্টফোনের প্রতি আকর্ষণ হারিয়েছেন মনোবিজ্ঞানী প্রাসেমেক ওলেইনিজাক। বছর পাঁচেক আগে দীর্ঘস্থায়ী ব্যাটারির কথা ভেবে নোকিয়া ৩৩১০ কিনেছিলেন তিনি। কিন্তু ডিভাইসটির অন্যান্য ইতিবাচক দিকগুলো নতুন করে জানতে বেশি সময় লাগেনি তার।
“কিন্তু এখন আমার হাতে নিজের এবং পরিবারের জন্য অনেক সময় আছে। একটা বড় সুবিধা হচ্ছে, আমি আর লাইকিং, শেয়ারিং, কমেন্টিং অথবা অন্য মানুষের কাছে নিজের জীবনের বর্ণনা দেওয়ায় আসক্ত নই। আমরা জীবনে এখন ব্যক্তিগত গোপনতাও আছে।”-- যোগ করেন তিনি।
তবে, পরিবর্তনের প্রথম সময়টা যে কঠিন ছিল, সেটাও মেনে নিয়েছেন পোল্যান্ডের ‘লডজ’ শহরের বাসিন্দা ওলেইনিজাক। “আগে আমি ভ্রমণের সময় স্মার্টফোনে সবকিছুর ‘চেক-ইন’ দিতাম, সেটা বাসস্টপ হোক আর রেস্তোঁরা। এখন সেটা সম্ভব নয়। কিন্তু আমি এতে মানিয়ে নিয়েছি।”
এমন ডাম্বফোনের নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি নিউ ইয়র্কের প্রতিষ্ঠান ‘লাইট ফোন’। এ ধরনের ডিভাইসগুলোর মধ্যে খানিকটা আলাদা এই প্রতিষ্ঠানের ডিভাইসগুলো; গান ও পডকাস্ট শোনার সুবিধা আছে ডিভাইসগুলোতে। ব্লুটুথ হেডফোন ব্যবহারের সুবিধাও আছে এতে। তবে, তাদের ডিভাইসে কখনোই সামাজিক মাধ্যমের অ্যাপ, খবরের ‘ক্লিকবেইট’, ইমেইল, ইন্টারনেট ব্রাউজার বা “অস্থিরতা সৃষ্টিকারী ইনফিনিটি ফিড” থাকবে না বলে প্রতিশ্রুতি দেয় প্রতিষ্ঠানটি।
লাইট ফোনের দাবি, আর্থিক সাফল্যের বিবেচনায় ২০২১ ছিল তাদের সবচেয়ে সফল বছর। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে তাদের বিক্রি বেড়েছিল ১৫০ শতাংশ। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, ‘ডাম্বফোন’ হিসেবে বেশ ব্যয়বহুল প্রতিষ্ঠানটির ডিভাইসগুলো, দাম ৯৯ ডলারের ঘরে।
লাইট ফোনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা কাইওয়েই ট্যাং জানিয়েছেন, ব্যাকআপ ডিভাইস হিসেবে ব্যবহারের কথা মাথায় রেখে নিজেদের ফোনগুলোর নকশা করেছিলেন তারা। যারা স্মার্টফোন থেকে দু-একদিনের জন্য ছুটি নিতে চান তাদের কথা ভেবেছিল লাইট ফোন। কিন্তু এখন প্রতিষ্ঠানের অর্ধেক ক্রেতাই ডিভাইসগুলোকে তাদের মূল ফোন হিসেবে ব্যবহার করছেন বলে জানিয়েছেন ট্যাং।
এ প্রসঙ্গে ট্যাং বলেন “এখন যদি এলিয়েনরা পৃথিবীতে আসে তবে তারা ভাববে যে মোবাইল ফোনগুলোই হচ্ছে উচ্চতর প্রজাতি যারা মানুষদের নিয়ন্ত্রণ করছে। আর এটা থামবেও না, পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকবে। ভোক্তারা বুঝতে পারছেন যে কোথাও একটা সমস্যা আছে, আর আমরা তাদের একটা বিকল্প দেওয়ার চেষ্টা করছি।”
আরও চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছেন ট্যাং। তার পণ্যের ক্রেতাদের একটা বড় অংশের বয়স ২৫ থেকে ৩৫-এর মধ্যে। ক্রেতাদের বয়স আরও বেশি হবে বলে প্রথমে ভেবেছিলেন তিনি।
ব্যবহারকারীদের মধ্যে এই স্মার্টফোন বিমুখ আচরণের যৌক্তিক ব্যাখ্যা আছে বলে জানিয়েছেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স গবেষক প্রফেসর স্যান্ড্রা ওয়াচার।
স্মার্টফোনগুলো সবসময় নোটিফিকেশন, আপডেট আর সর্বশেষ সংবাদ দিয়ে ব্যবহারকারীর “মনোযোগ ধরে রাখতে চায়”। এতে সারাদিনের কাজে মনোযোগ ব্যাহত হয়। দিন শেষে ব্যবহারকারীর মানসিক অবস্থার উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
প্রফেসর ওয়াচার আরও বলেন, “এটা স্বাভাবিক যে আমাদের মধ্যেই অনেকে এখন সহজ প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকছেন এবং তারা মনে করেন যে ডাম্বফোন ব্যবহার করে জটিলতামুক্ত দিনগুলোতে ফিরে যেতে পারবেন । এতে একটা কাজে পুরো মনোযোগ দেওয়ার জন্য আরও সময় পাবেন তারা। এটা মানুষের অস্থিরতাও কমিয়ে আনতে পারে।”
কিন্তু তারপরও অনেক মানুষ তার পছন্দে বিভ্রান্ত বলে জানিয়েছেন লন্ডনের রবিন ওয়েস্ট। “সবাই মনে করে এটা একটা অস্থায়ী বিষয়। তারা বলে, তো তুমি স্মার্টফোন কবে কিনছো? এ সপ্তাহেই নাকি?”