উদ্ভাবন নয়, মেটাভার্সে স্রেফ নিজের নাম যোগ করছে ফেইসবুক

সবচেয়ে প্রভাবশালী সামাজিক মাধ্যম হিসেবে পরিচিত ফেইসবুকের কল্যাণে প্রযুক্তি শিল্পে সবচেয়ে আলোচিত শব্দ এখন ‘মেটাভার্স’। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে নতুন এই প্রকল্প নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা ও নাম বদলের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ‘মেটাভার্স’-কে ফেইসবুকের সমার্থক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করলেও তাতে খুশি নন এই প্রযুক্তির অগ্রদূতরা।

প্রযুক্তি ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Nov 2021, 09:12 AM
Updated : 2 Nov 2021, 09:12 AM

২৮ অক্টোবর নাম বদলে ‘মেটা’ হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ফেইসবুক। জুলাই মাস থেকেই বিভিন্ন মাধ্যমে মেটাভার্সকে ফেইসবুকের ভবিষ্যত হিসেবে তুলে ধরে প্রচারণা চালিয়েছেন মার্ক জাকারবার্গসহ প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তারা।

তবে লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, প্রযুক্তি সেবার বাজারে ‘মেটাভার্স’ ধারণাটির সূত্রপাত ফেইসবুকের হাত ধরে হয়নি, এমনকি এই প্রযুক্তি নিয়ে মেতে ওঠা প্রথম প্রতিষ্ঠানও নয় ফেইসবুক। এই প্রযুক্তি নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই কাজ করছেন অন্যান্য প্রযুক্তি উদ্যোক্তারা।

“ওরা আদতে এমন কিছু তৈরি করে নিজের বলে চালানোর চেষ্টা করছে যা আমরা অনেক বছর ধরেই বানাচ্ছি।”-- ফেইসবুকের রিব্র্যান্ডিং প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন রায়ান ক্যাপেল। দুই বছরের বেশি সময় ধরে একাধিক মেটাভার্সে ব্যবহারকারীদের সাক্ষাতের আয়োজন করে আসছেন তিনি। 

এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রয়টার্সকে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি ফেইসবুক।

অক্টোবরের শেষ বৃহস্পতিবার নাম বদল ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছে ফেইসবুক। প্রযুক্তি শিল্পে ফেইসবুকের এই পদক্ষেপকে দেখা হচ্ছে বিতর্ক থেকে দূরত্ব সৃষ্টির কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে। সাবেক কর্মীদের ফাঁস করা তথ্য উপাত্তের উপর ভিত্তি করে ফেইসবুকের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছেন একাধিক দেশের আইনপ্রণেতা ও নীতিনির্ধারকরা। সমালোচনা, বিতর্ক আর আইনপ্রণেতাদের চোখ রাঙানির মধ্যেই মেটাভার্স নিয়ে জোর প্রচারণা শুরু করেছে ফেইসবুক।

মেটাভার্সের মূল ধারণার ভার্চুয়াল জগতে ‘অ্যাভাটার’ হিসেবে ঘুরে ফিরে বাড়তে পারেন একজন ব্যবহারকারী। বন্ধুদের সঙ্গে অ্যাভাটার হিসেবে দেখা করা বা গেইম খেলার সুযোগও পান তারা। মেটাভার্সগুলোর বেশ কয়েকটির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে ব্লকচেইন প্রযুক্তিও।

“আমি মনে করি যেহেতু নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান আগ্রহ দেখাচ্ছে, ফেইসবুক আগেভাগেই নাম পাল্টেছে যতো দ্রুত সম্ভব নতুন ট্রেডমার্ক নিশ্চিত করার জন্য”-- মন্তব্য করেছেন ডিজিটাল মুদ্রা খাতের বিনিয়োগকারী ‘প্র্যাঙ্কসি’। ২০২০ সালেই ভার্চুয়াল মেটাভার্সে জমি কিনেছেন তিনি। 

মেটাভার্স সমনিয়াম স্পেস-এর প্রতিষ্ঠাতা আর্টুর সাইকভ বলেন, তার কাছে মনে হয়েছে ফেইসবুক প্রধান মার্ক জাকারবার্গের নাম পরিবর্তনের ঘোষণা, “তাড়াহুড়ো করে দেওয়া.. মনে হচ্ছে যেন তারা মেটাভার্স গল্পে নিজেদের ঢোকানোর চেষ্টা করছে যেটা এখন লেখা হচ্ছে।” দৈনিক পাঁচ ঘণ্টা সমনিয়াম স্পেসে সময় দেন সাইকভ, ওই মেটাভার্সটির দৈনিক ব্যবহারকারীর সংখ্যা গড়ে এক থেকে দুই হাজার। ২০১৭ সাল থেকে চালু আছে সমনিয়াম স্পেস।

অন্যদিকে, এখনই যারা মেটাভার্স ব্যবহার করছেন, তারা ফেইসবুকের কর্মকাণ্ডের বিরোধীতা করতে পারেন বলে আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন ভার্চুয়াল দুনিয়া ‘ডিসেন্ট্রাল্যান্ড’-এর যোগাযোগ প্রধান ডেভ কার। কন্টেন্টের উপর ফেইসবুকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শঙ্কিত ওই ব্যবহারকারীরা। সাম্পতিক সময়ে ফেইসবুকের বিরুদ্ধে কিশোর বয়সীদের উপর ইনস্টাগ্রামের বিরূপ প্রভাব অগ্রাহ্য করা আর কন্টেন্ট মডারেশনে ব্যর্থতার অভিযোগ যেন ঘি ঢালছে ওই শঙ্কার আগুনে।

“নিজেরা যে ভার্চুয়াল দুনিয়ায় আছেন তার ভবিষ্যত নিজেরাই নির্ধারণ করতে চান যেসব মানুষ, তারা নিজেদের শৈল্পিক সৃষ্টির মালিকানা ধরে রাখতে চান এবং তার (মেটাভার্স) মধ্যে ইচ্ছে মতো ঘুরে বেড়াতে চান, তারা বিকেন্দ্রিক সংস্করণকেই বেছে নেবেন”-- যোগ করেন কার। ‘ডিসেন্ট্রাল্যান্ডের ভার্চুয়াল দুনিয়া বিকেন্দ্রিক হলেও ফেইসবুকের মেটাভার্স কেন্দ্রিভূত হবে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।

ডিসেন্ট্রাল্যান্ডও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২০১৭ সালে, দৈনিক সাত হাজার নিয়মিত ব্যবহারকারী আছে সেবাটির। ব্যবহারকারীর ডেটা বেচে কামাই করে এবং ব্যবহারকারীরা কোন কন্টেন্ট দেখবে সেটা নিয়ন্ত্রণ করে এমন সামাজিক মাধ্যমের বিকল্প হিসেবে নিজস্ব প্ল্যাটফর্মকে বিবেচনা করেন এর নির্মাতারা।  

রয়টার্স জানিয়েছে, বিদ্যমান মেটাভার্স প্ল্যাটফর্মগুলোর একটা বড় অংশ ব্লকচেইন প্রযুক্তিনির্ভর। এর ফলে কেন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয় ওই প্ল্যাটফর্মগুলোতে। ক্রিপ্টোকারেন্সি প্রযুক্তির মূলভিত্তিই হল ব্লকচেইন। ব্লকচেইন নির্ভর মেটাভার্সে ব্যবহারকারীরা ক্রিপ্টোকারেন্সি দিয়ে ‘নন-ফাঞ্জিবল টোকেন (এনএফটি)’ হিসেবে ভার্চয়াল জায়গা-জমি ও ডিজিটাল বস্তু বেচা-কেনা করে থাকেন। 

ফেইসবুকের সাম্প্রতিক পদক্ষেপকে মেটাভার্স প্রযুক্তির অগ্রদূতদের সবাই নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন, এমনটাও নয়। রয়টার্স বলছে, ফেইসবুকের সাম্প্রতিক ঘোষণা ও প্রচারণা ভার্চুয়াল দুনিয়া নিয়ে সাধারণ ব্যবহারকারীদের আগ্রহ বাড়াতে পারে এবং একাধিক ভার্চুয়াল দুনিয়া সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। 

এনএফটি প্রতিষ্ঠান ‘এনএফটি৪২’-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা ট্রিস্টান লিটলফিল্ড জানান, ফেইসবুকের প্রাথমিক ঘোষণা নিয়ে তার প্রতিক্রিয়া নেতিবাচক ছিল কারণ ব্যবহারকারীদের ডেটা বেচে কামাই করা পছন্দ নয় তার। তবে, “ফেইসবুকের মতো একটি দানবীয় প্রতিষ্ঠান কয়েকশ’ কোটি ডলার বিনিয়োগ করলে তা ইতিবাচকও হতে পারে” বলে মন্তব্য করেন তিনি। কারণ হিসেবে এই প্রযুক্তিতে নতুন মুখের আবির্ভাবের উপর জোর দেন লিটলফিল্ড।