ইনটেলকে হটিয়ে ম্যাকবুকের শীর্ষ প্রসেসর এখন অ্যাপলের

অবশেষে ম্যাকবুক ল্যাপটপের নতুন দুটি সংস্করণ উন্মোচন করেছে টেক জায়ান্ট অ্যাপল। প্রতিষ্ঠানটি নতুন ম্যাকবুকের আগা-গোড়া সব কিছুই নতুন করে ডিজাইন করেছে। তবে, আলোচনার কেন্দ্রে আছে নতুন দুই ম্যাকবুকে ব্যবহৃত অ্যাপলের নিজস্ব ডিজাইনের চিপসেট। বলা হচ্ছে, পিসির প্রসেসর বাজারে ইনটেলের একচ্ছত্র আধিপত্যের জন্য হুমকি হয়ে আবির্ভাব ‘এম১ প্রো’ এবং ‘এম১ ম্যাক্স’ চিপের।

প্রযুক্তি ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Oct 2021, 11:07 AM
Updated : 19 Oct 2021, 11:08 AM

সোমবার ম্যাকবুক প্রো’র ১৪ ইঞ্চি এবং ১৬ ইঞ্চি স্ক্রিনের দুটি মডেল উন্মোচন করেছে অ্যাপল। ১৮ অক্টোবরের আগ পর্যন্ত অ্যাপলের সবচেয়ে শক্তিশালী ল্যাপটপগুলো ছিল ইনটেল চিপ নির্ভর। ২০২০ থেকেই পাল্টাতে শুরু করে সেই দৃশ্যপট। সে বছর ম্যাকবুক এয়ার ও ১৩ ইঞ্চির ম্যাকবুক প্রো ল্যাপটপের মাধ্যমে অভিষেক হয় এম১ চিপের। পরবর্তীতে আইপ্যাড প্রো ট্যাবলেট এবং আইম্যাকেও যোগ হয়েছিল এম১ চিপসেট।

পারফর্মেন্স ও ব্যাটারি লাইফের হিসাবে বেশ সমাদ্রিত হয়েছিল এম১ চিপ। প্রযুক্তিবিষয়ক সাইট সিনেট বলছে, এম১-এর দ্বিতীয় প্রজন্ম এখন ফটোগ্রাফার, ভিডিও এডিটর এবং সফটওয়্যার ডেভেলপারদের মতো সৃজনশীল ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার বেলায় হয়ে উঠেছে অ্যাপলের বাজীর ঘোড়া।

ছবি: অ্যাপল

প্রসেসর বাজারের সংশ্লিষ্টরা এম১ প্রো আর এম১ ম্যাক্সক চিপকে আখ্যা দিচ্ছেন করছেন ‘দানব’ হিসেবে। এম১ প্রো চিপে আছে তিন হাজার তিনশ’ ৭০ কোটি ট্রানজিস্টর। একটি চিপ সার্কিটের মৌলিক অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয় ওই ট্রানজিস্টরগুলোকে। আর এম১ ম্যাক্সে আছে পাঁচ হাজার সাতশ’ কোটি ট্রানজিস্টর। দুটি চিপের ক্ষেত্রেই এম১-এর ‘ইউনিফায়েড মেমোরি আর্কিটেকচার’-এর আরও শক্তিশালী সংস্করণ ব্যবহার করেছে অ্যাপল। এম১ প্রো’র ধারণ ক্ষমতা ৩২ জিবি, আর এম১ প্রো ম্যাক্সের ধারণ ক্ষমতা ৬৪ জিবি।

১০ কোরের সিপিইউ এবং ১৬ কোরের জিপিইউ আছে এম১ প্রো-তে। আর এম১ ম্যাক্সে ১০ কোরের সিপিইউয়ের সঙ্গে আছে ৩২ কোরের জিপিইউ। উভয় চিপেই উচ্চসম্পন্ন কাজগুলো সামলাবে ৮টি ‘পারফর্মেন্স কোর’, বাকি দুটি ‘এফিশিয়েন্সি কোর’ সামলাবে ব্যাকগ্রাউন্ডের চলমান কাজ।

১৪ ইঞ্চি ম্যাকবুক প্রো’র সর্বনিম্ন দাম হবে এক হাজার নয়শ ৯৯ ডলার। এম১ প্রো চিপ থাকবে এতে। ১৬ ইঞ্চির মডেলটির দাম শুরু হবে দুই হাজার চারশ’ ৯৯ ডলার থেকে। তবে এই মডেলটির জন্য এম১ প্রো এবং এম১ ম্যাক্সের মধ্য থেকে নিজের প্রয়োজন মতো চিপ বেছে নিতে পারবেন ক্রেতা।

বর্তমান প্রযুক্তি জগতে শক্তিশালী প্রসেসর বানানো খুব কঠিন বা অভিনব কিছু নয়। তবে একইসঙ্গে শক্তিশালী কিন্তু বিদ্যুৎ খরচের বেলায় সাশ্রয়ী-- বাজারে এমন প্রসেসর খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন কাজ। এক্ষেত্রে আলাদা গুরুত্ব পাচ্ছে এম১ প্রো এবং এম১ ম্যাক্স। টানা ভিডিও দেখলেও এম১ প্রো-চালিত ম্যাকবুক চলবে ১৭ ঘণ্টা আরা এম১ ম্যাক্স চালিত ম্যাকবুক চলবে ২১ ঘণ্টা। সিনেট বলছে, অ্যাডোবির লাইটরুম ক্লাসিক ফটো এডিটিং সফটওয়্যার ব্যবহারের ক্ষেত্রে ইনটেল চিপ নির্ভর ল্যাপটপের তুলনায় দ্বিগুণ সময় চলবে নতুন এম১ নির্ভর ম্যাকবুকগুলো।

ছবি: অ্যাপল

প্রযুক্তি বোদ্ধারা বলছেন, এম১ প্রো আর এম১ ম্যাক্সের বদৌলতে ম্যাকবুকের ক্ষেত্রে ইনটেল নির্ভরতা কাটিয়ে উঠার সুযোগ পাচ্ছে অ্যাপল। অ্যাপল ইনটেল চিপ নির্ভর ম্যাকবুক বাজারজাতকরণ শুরু করেছিল ২০০৬ সালে। ২০২০ সালে এম১ চিপের ঘোষণা দেওয়ার সময় মার্কিন প্রতিষ্ঠানটি বলেছিল, ম্যাকবুকের সব মডেল থেকে ইনটেল হটাতে দুই বছর সময় নেবে প্রতিষ্ঠানটি। ইনটেল চিপের জন্য লেখা সফটওয়্যার সহজেই অনুবাদ করে নিতে পারে এম-সিরিজের চিপগুলো। তবে ইনটেল নির্ভর ম্যাকবুকের জন্য পাঁচ বছর সফটওয়্যার আপডেট দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে অ্যাপল।

১৮ অক্টোবরের ‘আনলিশড’ ইভেন্ট মূলত নতুন ম্যাকবুক উন্মোচনের জন্যই আয়োজন করেছিল অ্যাপল। প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে বেশি বিক্রিত পণ্যের জায়গাটি আইফোন দখল করে নিলেও অ্যাপলের ভোক্তাপণ্য ব্যবসার একটা বড় অংশ ম্যাকবুক কেন্দ্রিক। বিশেষ করে, বেশি পয়সা খরচ করে প্রিমিয়াম ল্যাপটপ চান, এমন ক্রেতাদের কাছে বরাবরই আলাদা কদর ছিল ম্যাকবুক প্রো’র।

ইনটেল আই৯ চিপ নির্ভর ১৬ ইঞ্চির ম্যাকবুকের সঙ্গে তুলনা করলে, সিপিইউ পারফর্মেন্সের হিসাবে ১৬ ইঞ্চির ম্যাকবুকের এম১ প্রো আর এম১প্রো ম্যাক্স চিপ দ্বিগুণ গতি সম্পন্ন। আর অ্যাপল বলছে, গ্রাফিক্সের গতি হিসাব করলে এম১ প্রো ল্যাপটপগুলো হবে আড়াই গুণ বেশি গতির; চারগুণ বেশি গতি পাওয়া যাবে এম১ ম্যাক্স চালিত ম্যাকবুকে।

আর মেশিন লার্নিং সক্ষমতার ক্ষেত্রে ইনটেল আই৯ মেশিনের তুলনায় এম১ চিপ পাঁচগুণ বেশি শক্তিশালী বলে জানিয়েছে অ্যাপল। বেশ কয়েক বছর ধরে আইফোন ও আইপ্যাডে ব্যবহৃত এ সিরিজ চিপের এআই অ্যাক্সেলেরেটর উন্নয়ন করেছে অ্যাপল। সিনেট জানিয়েছে, এম সিরিজ চিপেও সেই প্রযুক্তি নিয়ে এসেছে অ্যাপল। অন্যদিকে, উৎপাদন প্রক্রিয়ার জটিলতার কারণে চিপে এআই অ্যাক্সেলেরেটর যোগ করতে ধীর গতিতে এগিয়েছে ইনটেল।

ছবি: অ্যাপল

এম সিরিজ চিপের এআই প্রযুক্তি নিয়ে অ্যাপল মুখপাত্র রোমান স্কুরাতোভস্কি বলেন, “অ্যাপলের এআই হার্ডওয়্যার এম১ নির্ভর ম্যাকের গতি ও সক্ষমতা দ্বিগুণ করে”। এম১-এর সঙ্গে তুলনা করলে এম১ প্রো সিপিইউয়ের পারফর্মেন্স ৭০ শতাংশ বেশি, ১০০ শতাংশ বেশি জিপিইউ পারফর্মেন্স।

সিনেট জানিয়েছে, এম১-এর মতো এম১ প্রো এবং এম১ ম্যাক্সে নির্মাণ করা হয়েছে ৫ ন্যানোমিটার উৎপাদন প্রযুক্তি ব্যাবহার করে। স্মার্টফোনসহ বিভিন্ন বহনযোগ্য ডিভাইসের জন্য চিপ নির্মাণেও ওই একই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।

ম্যাকবুক প্রো’র নতুন মডেলগুলোর উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের মধ্যে আরও আছে উন্নত ক্যামেরা, ম্যাগসেইফ চার্জিং প্রযুক্তি এবং এইচডিএমআই পোর্ট। নতুন ল্যাপটপ আর চিপের সঙ্গে ‘এয়ারপড ৩’-এর ঘোষণাও দিয়েছে অ্যাপল।

অ্যাপলে নতুন দুই ম্যাকবুককে হার্ডওয়্যার ও পারফর্মেন্সের হিসেবে ‘আলোড়ন সৃষ্টিকারী’ বললে হয়তো ভুল বলা হবে না। সর্বনিম্ন দামকে ‘বেঞ্চমার্ক’ হিসেবে বিবেচনা করলে, ১৪ ইঞ্চির মডেলটির দাম এক হাজার নয়শ’ ৯৯ ডলার এবং ১৬ ইঞ্চির মডেলটির দাম পড়বে দুই হাজার চারশ ৯৯ ডলার। কিন্তু সর্বনিম্ন দামের বেঞ্চমার্ক ভুলে কার্যক্ষমতা ও হার্ডওয়্যার বিবেচনায় নিয়ে দাম হিসেব করলে এক ভিন্ন রকমের আলোড়নের অনুভূতি হতে পারে আগ্রহী ক্রেতার।

নতুন ম্যাকবুকের সবচেয়ে ‘হাই-এন্ড কাস্টোমাইজড’ মডেলে থাকবে ৬৪ জিবির ‘ইউনিফায়েড মেমোরি’ ৮ টেরাবাইটের এসএসডি স্টোরেজ, ১৪০ ওয়াটের ইউএসবি-সি অ্যাডাপ্টর এবং এম১ ম্যাক্স চিপ। অ্যাপলের ওয়েবসাইট বলছে, এই সংস্করণটির দাম হবে ছয় হাজার ৯৯ ডলার। এই মডেলটির সঙ্গে ফাইনাল কাট প্রো এবং লজিক প্রো সফটওয়্যার কেনার পরামর্শ দিচ্ছে অ্যাপল। ওই দুই সফটওয়্যারের দাম যোগ করলে এম১ ম্যাক্স চিপের ১৬ ইঞ্চির ম্যাকবুকের দাম গিয়ে পৌঁছায় ছয় হাজার ছয়শ’ ডলারে।