ফেইসবুকের এই দুঃসময় শুরু হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব কিছু নথি ফাঁস হয়ে যাওয়ার ফলে। বিবিসি বলছে, প্রতিষ্ঠানটিরই কোনো কর্মী গোপন নথিগুলো ফাঁস করে দিয়েছেন বলে তাদের অনুমান।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, সরকারি ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো ফেইসবুকের কার্যপ্রণালীর ব্যবচ্ছেদ করতে চাইলে তার রশদ জোগাবে ফাঁস হওয়া নথিপত্র। তবে, এখন পর্যন্ত প্রতিটি অভিযোগের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টাও করেছে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী সামাজিক মাধ্যমটি ।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের ‘ফেইসবুক ফাইলস’-এ প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রমের যে বিষয়গুলো সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন উঠেছে, সেগুলো হলো:
তারকাদের ‘বিশেষ খাতির’ করতো ফেইসবুক
জার্নালের প্রতিবেদন বলছে-- সেলিব্রেটি, রাজনীতিবিদ এবং ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ব্যক্তিরা সামাজিক মাধ্যমটিতে কোন বিষয়ে পোস্ট দিতে পারবেন, বা কোনটি দিতে পারবেন না, সেটির জন্য ছিলো ‘ক্রস-চেক’ নামের সম্পূর্ণ আলাদা একটি ব্যবস্থা। জনসাধারণের উপর প্রযোজ্য নীতিমালা খাটতো না ওই ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে।
‘ক্রস-চেক’ ব্যবস্থা নিয়ে সমালোচনাকে “ন্যায্য” বলে স্বীকারও করে নিয়েছে ফেইসবুক। তবে সমালোচনা ন্যায্য হলেও, বাড়তি খাতিরের বিষয়টি স্বীকার করতে নারাজ প্রতিষ্ঠানটি। বরং ফেইসবুকের দাবি, বিশেষ খাতির করার জন্য নয়, কোনো কন্টেন্ট নিয়ে বিষদ যাচাই বাছাইয়ের প্রয়োজন দেখা দিলে, সেক্ষেত্রে “বাড়তি পদক্ষেপ” হিসেবে কাজ করতো ক্রস-চেক।
“হয়তো অধিকারকর্মীরা কোনো বিষয় নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন অথবা কোনো সংবাদকর্মী যুদ্ধক্ষেত্র থেকে খবর পাঠাচ্ছেন”--এমন ঘটনাগুলোর কথা মাথায় রেখে ক্রস-চেক নির্মাণ করা হয়েছিলো বলে দাবি ফেইসবুকের।
ফেইসবুক আরও বলছে, ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনে “অনেক পুরনো তথ্য ছিলো যেগুলো জোড়াতালি দিয়ে ঘটনার বর্ণনা এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে চাপা পড়ে গেছে মূল বিষয়টি; ফেইসবুক নিজেই ক্রস-চেক দিয়ে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা করছিলো”।
সামাজিক মাধ্যমটির পক্ষ থেকে ‘ফেইসবুক ফাইলস’এর বিরোধীতা হলেও, আরও স্বচ্ছতার দাবি উঠেছে প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব ওভারসাইট বোর্ডের কাছ থেকেই ।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, কন্টেন্ট মডারেশন সংক্রান্ত জটিল বিষয়গুলোর সমাধান করতে প্রতিষ্ঠানটি নিজেই নিয়োগ দিয়েছিলো ওই ওভারসাইট বোর্ডকে, এর তহবিলও জোগায় ফেইসবুক।
এক ব্লগ পোস্টে ওভারসাইট বোর্ড বলেছে, প্রকাশিত প্রতিবেদন “প্রতিষ্ঠানটির সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ায় অসামঞ্জস্যের উপর নতুন করে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে”। ক্রস-চেক সিস্টেম কীভাবে কাজ করে, সেই বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যাও চেয়েছে ওভারসাইট বোর্ড।
ক্রস-চেক নিয়ে স্বচ্ছতার এই অভাব, ফেইসবুক “রাজনীতি ও বাণিজ্যিক বিবেচনায় অন্যায়ভাবে প্রভাবিত হয়” এমন সন্দেহ আরও জোরালো করতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছে ওই বোর্ড।
ফেইসবুক কীভাবে কন্টেন্ট মডারেশন করে, তার উপর নজর রাখা শুরু করার পর থেকে, প্রতিষ্ঠানটির নীতিমালায় কী কী পরিবর্তন আনা প্রয়োজন, সেই বিষয়ে ৭০টি পরামর্শ দিয়েছে ওভারসাইট বোর্ড। ফেইসবুক ওই পরামর্শগুলোর আদৌ কোনো প্রয়োগ করে কি না, এখন সেটি যাচাই করতে নতুন দল গঠন করেছে ওভারসাইট বোর্ড।
‘দাস বাণিজ্য’ নিয়ে নিজস্ব কর্মীদের উদ্বেগের গুরুত্ব দেয়নি ফেইসবুক
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের হাতে থাকা নথিপত্র বলছে, বিভিন্ন সময় ফেইসবুকের মালিকানাধীন প্ল্যাটফর্মগুলোতে দাস বাণিজ্য ও মাদক ব্যবসার পরিষ্কার আলামত চিহ্নিত করেছিলেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা। কিন্তু বেআইনি ও অনৈতিক কাজে নিজস্ব প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার জেনেও, সেই বিষয়ে ফেইসবুকের প্রতিক্রিয়া ও পদক্ষেপ ছিলো ‘দুর্বল’।
বিবিসি’র প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নিজস্ব অ্যাপ স্টোরে ফেইসবুকের সব সেবা নিষিদ্ধ করার হুমকি দিয়েছিলো আরেক প্রভাবশালী মার্কিন প্রতিষ্ঠান অ্যাপল। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন বলছে, নিজস্ব কর্মীদের উদ্বেগ এবং বেআইনি ব্যবসার পরিষ্কার প্রমাণ থাকলেও, অ্যাপল হুমকি দেওয়ার আগ পর্যন্ত সেটি বন্ধ করতে উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেয়নি ফেইসবুক।
ফেইসবুক বলছে, এই বিষয়ে তাদের একটি “বিস্তারিত কৌশল” ছিলো; মানুষের নিরাপত্তা বজায় রাখতে এর অন্তর্ভূক্ত ছিলো একটি “বৈশ্বিক দল যার মধ্যে ছিলো ৫০টি ভাষাভাষির স্থানীয় লোকজন, শিক্ষা উপাদান, স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে অংশীদারিত্ব এবং তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের জন্য তৃতীয় পক্ষ”।
কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, দুইশ’ ৮০ কোটি সেবাগ্রাহকের নিরাপত্তা দেওয়ার মতো সক্ষমতা নেই ফেইসবুকের।
এই প্রসঙ্গে ‘দ্য ফেইসবুক ইফেক্টস’ বইয়ের লেখক ডেভিড কার্কপ্যাট্রিক বিবিসি’র টেক টেন্ট পডকাস্টে জানান, যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে নিজস্ব প্ল্যাটফর্মের “নেতিবাচক প্রভাব সমাধানে” ফেইসবুকের “কোনো সদিচ্ছা আছে বলে মনে হয় না” তার।
“তারা অনেক কিছু করেছে, এর মধ্যে কন্টেন্ট যাচাই করার জন্য কয়েক হাজার লোকের নিয়োগও আছে। কিন্তু ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল থেকে যে পরিসংখ্যানটি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে সেটি হলো, কেবল ২০২০ সালে ভুয়া তথ্যের প্রচার ঠেকাতে তারা যা কিছু করেছে তার মাত্র ১৩ শতাংশ ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে।”
“যে প্রতিষ্ঠানের ৯০ শতাংশ ব্যবসা যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে- এবং যার ফিলিপাইন, পোল্যান্ড, ব্রাজিল, হাঙ্গেরির মতো দেশগুলোর রাজনীতির উপর এতো বেশি নেতিবাচক প্রভাব আছে-- তারা এসবের সমাধান করতে কোনো কিছুই করছে না”।
কার্কপ্যাট্রিকের মতামত-- ফেইসবুক কেবল “যুক্তরাষ্ট্রে জনসংযোগের চাপ” নিয়ে মাথা ঘামায়, কারণ এতে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার মূল্য।
শেয়ার মালিকদের মামলার ঝুঁকিতে আছে ফেইসবুক
নিজের শেয়ার মালিকদের মামলার ঝুঁকিতে আছে ফেইসবুক। ওই শেয়ার মালিকদের অভিযোগ, কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারিতে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ট্রেড কমিশনকে যে পাঁচশ’ কোটি ডলার জরিমানা দেওয়া হয়েছিলো তা ছিলো মাত্রাতিরিক্ত এবং ওই ঘটনায় মার্ক জাকারবার্গকে ব্যক্তিগতভাবে দায়ী হওয়া থেকে রক্ষা করতে পুরো প্রক্রিয়াটি সাজানো হয়েছিলো।
এই প্রসঙ্গে ফেইসবুক বলছে, চলমান আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে কিছু বলার নেই তাদের।
নিজেই নিজের সুনাম করে বেড়াচ্ছে ফেইসবুক!
চলতি সপ্তাহেই নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে চমকপ্রদ তথ্য। নিজস্ব ভাবমূর্তি রক্ষা করতে, ফেইসবুকের গুণগান গায়-- ব্যবহারকারীদের নিউজ ফিডে এমন কন্টেন্টের উপস্থিতি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে ফেইসবুক।
মার্কিন সংবাদপত্রটি বলছে, “সামাজিক মাধ্যমটি নিয়ে মানুষকে ইতিবাচক খবর দেখাতেই” প্রজেক্ট অ্যাপ্লিফাই তৈরি করা হয়েছে।
তবে ফেইসবুক বলছে, কোনো পরিবর্তন আসেনি নিউজফিডের “র্যাংকিং সিস্টেমে”।
এই প্রসঙ্গে ফেইসবুক মুখপাত্র জো অসবর্ণ একাধিক টুইটে দাবি করেছেন, পরীক্ষামূলক প্রকল্পটি আসলে “ফেইসবুকের একটি তথ্যভিত্তিক ইউনিট”, যা খুবই ছোট এবং কেবল “তিনটি শহরে” এর প্রয়োগ হয়েছে।
তার দাবি, অন্যান্য প্রযুক্তি ও ভোক্তা পণ্যের ক্ষেত্রে মানুষ যে ব্যবসায়িক দায়িত্ববোধ কেন্দ্রীক উদ্যোগ দেখে, তার মতোই এটি।
কিশোর বয়সীদের উপর ইনস্টাগ্রামের ‘ক্ষতিকর’ প্রভাব সম্পর্কে জানতো ফেইসবুক
যে বিষয়গুলো নিয়ে ফেইসবুক সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হচ্ছে, তার মধ্যে একটি হলো ইনস্টাগ্রাম নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা। কিশোর বয়সীদের উপর ইনস্টাগ্রামের প্রভাব নিয়ে লম্বা সময় ধরে বিষদ গবেষণা করেছে ফেইসবুক। গবেষণার উঠে আসে-- কিশোর বয়সীদের উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে ইনস্টাগ্রাম। কিন্তু, গবেষণার ফলাফল উন্মুক্ত না করে বা জনসাধারণকে না জানিয়ে চেপে গিয়েছিলো সামাজিক মাধ্যমটি।
অন্যদিকে, প্রতিষ্ঠানের গোপন নথি ফাঁস করে দেওয়া ওই ফেইসবুক কর্মী নিজের পরিচয় প্রকাশ করে জনসমক্ষে আসবেন এবং মার্কিন কংগ্রেসকে সহযোগিতা করবেন বলে জানিয়েছে ফক্স নিউজ।
আদৌ ওই ব্যক্তি জনসমক্ষে আসবেন কী না, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করার উপায় এখনও নেই। তবে ফাঁস হওয়া ফেইসবুকের নিজস্ব নথি থেকেই মার্কিন আইন প্রণেতারা চিন্তার অনেক বিষয় পাবেন বলে মন্তব্য করেছে বিবিসি।